আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী

বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ যত সমুদ্রপথ

বিশ্বের সিংহভাগ আমদানি-রপ্তানির প্রধান মাধ্যম সমুদ্রপথ। তবে সম্প্রতি এই নিরাপদ পথটিই হয়ে উঠেছে অস্থির । রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় কৃষ্ণসাগরে দীর্ঘস্থায়ী সংকট, পানামা খালে খরা কিংবা লোহিত সাগরে হুতি বিদ্রোহীদের হামলায় অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। বিশ্ববাণিজ্যে সমুদ্রপথের গুরুত্ব এতে নতুনভাবে উঠে এসেছে। এ প্রেক্ষিতে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ নিয়ে আমাদের এই বিশেষ আয়োজন ।

ভূমধ্যসাগর, সুয়েজ খাল ও লোহিত সাগর

এটি পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ও ব্যস্ততম বাণিজ্যিক পথ। এটি উত্তর-পশ্চিম ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার দেশসমূহকে সুয়েজ খালের মাধ্যমে এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত করেছে। ১৮৫৯ থেকে ১৮৬৯ সালের মধ্যে এক দশকে সুয়েজ খাল খনন করা হয়। এটি চালু হওয়ার পর থেকে বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ এই পথ দিয়ে সম্পন্ন হয়।

অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক পণ্য খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি-রপ্তানিতে এ পথের গুরুত্ব অদ্বিতীয়। শুধু মধ্যপ্রাচ্যই নয়, দক্ষিণ এশিয়া ও চীনের বহু উৎপাদক প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য এই পথ দিয়ে ইউরোপে রপ্তানি করে। এ পথের উল্লেখযোগ্য বন্দরগুলো হলো— পর্তুগালের লিসবন, স্পেনের জিব্রাল্টার, আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স, গ্রিসের এথেন্স, সৌদি আরবের জেদ্দা, লেবাননের বৈরুত, মিশরের পোর্ট সৈয়দ ও আলেকজান্দ্রিয়া ।

পানামা খাল

পানামা খাল প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে আটলান্টিক মহাসাগরের সংযোগ স্থাপন করে। যুক্তরাষ্ট্র ১৯০৪ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে এটির খননকাজ সম্পন্ন করে। একই বছরের ১৫ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে এটির উদ্বোধন হয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব থেকে পশ্চিম উপকূলে ১৫ হাজার কিলোমিটার এবং উত্তর আমেরিকার উপকূল থেকে দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে যেতে সাড়ে ৬ হাজার কিলোমিটার পথ কম পাড়ি দিতে হয়। একইসঙ্গে এশিয়া, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার জাহাজগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পথের প্রায় ৩,৭০০ কিলোমিটার কমে গিয়েছে ।

বিশ শতকের শেষ অবধি খালটি যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৯৯ সালে এর পুরো নিয়ন্ত্রণ পানামার হাতে চলে যায়। শত বছরের পুরোনো এ খালের মাধ্যমে দেড় শতাধিক দেশের প্রায় দুহাজার বন্দরের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। বিশ্বের সমুদ্রভিত্তিক বাণিজ্যের ৫ শতাংশ এ পথ দিয়ে পরিচালিত হয়। বিশেষ করে উত্তর আমেরিকার সঙ্গে পূর্ব এশিয়া ও ওশেনিয়ার বাণিজ্য বিস্তারে এ পথের ভূমিকা অনন্য ।

উত্তর আটলান্টিক সমুদ্রপথ

উত্তর আটলান্টিক সমুদ্রপথের দুপ্রান্তে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ও শিল্পোন্নত দেশসমূহের অবস্থান। পূর্বপ্রান্তের সঙ্গে সুয়েজ খাল ও পশ্চিম প্রান্তের সঙ্গে পানামার মাধ্যমে প্রশান্ত মহাসাগরীয় সমুদ্রপথের যোগাযোগের ফলে পথটির বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব অত্যাধিক। এ পথে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ও বোস্টন বন্দর, কানাডার মন্ট্রিল ও কুইবেক বন্দর, যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ও ব্রিস্টল বন্দরসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বন্দর।

পৃথিবীর প্রায় চার ভাগের তিন ভাগ বাণিজ্যিক জাহাজ এ পথ দিয়ে চলাচল করে। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের অসংখ্য কারখানার কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য এ পথ দিয়ে সরবরাহ হয়ে থাকে। সমুদ্রপথটির উভয় প্রান্তের দেশগুলোর মধ্যে মতাদর্শগত সাদৃশ্য বিদ্যমান থাকায় এরা পরস্পর মিত্র ও নানা বাণিজ্যিক চুক্তিতে আবদ্ধ ।

উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় পথ

উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূল ও পানামা খাল থেকে প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে এশিয়ার পূর্ব উপকূল এবং অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত এ পথ। উত্তর আমেরিকা, পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ওশেনিয়ার দেশগুলো এ পথে বাণিজ্য সম্পাদন করে। পানামা খালের মাধ্যমে এ পথের সঙ্গে উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের সংযোগ স্থাপিত হয়েছে ।

দক্ষিণ আটলান্টিক সমুদ্রপথ

দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ব উপকূলের সঙ্গে ইউরোপের পশ্চিম উপকূল, উত্তর আমেরিকার উত্তর-পূর্ব উপকূল এবং আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের সংযোগ স্থাপন করেছে দক্ষিণ আটলান্টিক সমুদ্রপথ ৷ দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যকার বাণিজ্যে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো, উরুগুয়ের মন্টিভিডিও, আর্জেন্টিনার বুয়েন্স এয়ারস, দক্ষিণ আমেরিকার কেপটাউন সমুদ্রপথের উল্লেখযোগ্য বন্দর ৷

উত্তমাশা অন্তরীপ

দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ বা ‘কেপ অব গুড হোপ’ সরু হয়ে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবেশ করেছে। ১৪৮৮ সালে পর্তুগিজ নাবিক বার্থোলোমিউ ডিয়াজ এটি আবিষ্কার করেন। সুয়েজ খাল খননের আগে ইউরোপ থেকে ভারতে আসার জন্য উত্তমাশা অন্তরীপের সমুদ্রপথই ছিল একমাত্র অবলম্বন। বর্তমানে আফ্রিকার সঙ্গে ইউরোপ, এশিয়া ও ওশেনিয়ার বাণিজ্য বিস্তারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে এ পথ ৷

দক্ষিণ চীন সাগর

দক্ষিণ চীন সাগর পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরকে ভারত মহাসাগরের আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথের সঙ্গে যুক্ত করেছে। সুন্দা প্ৰণালি ও ও মালাক্কা প্রণালির কাছেই এই সাগরের অবস্থান ৷ এর জলসীমা ৩৫ লক্ষ বর্গ কিমি সামগ্রিক বিশ্ব বাণিজ্যের এক-তৃতীয়াংশ দক্ষিণ চীন সাগর হয়ে পরিচালিত হয়। বাণিজ্যিক ও ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে চীনের সঙ্গে ফিলিপাইন, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া ও ব্রুনাইয়ের মধ্যে বিরোধ চলছে ।

কৃষ্ণসাগর

অধিকাংশ পূর্ব ইউরোপীয় ও ককেশাসীয় দেশগুলোর একমাত্র সমুদ্রপথ কৃষ্ণসাগর। এটি বসফরাস প্রণালি ও দার্দানেলিস প্রণালির মাধ্যমে দেশগুলোর সঙ্গে ভূমধ্যসাগরের সংযোগ ঘটিয়েছে। রাশিয়ার জনবহুল ও কৃষিসমৃদ্ধ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে বাণিজ্যের জন্য একমাত্র সুবিধাজনক জলপথ হলো কৃষ্ণসাগর । অন্যদিকে, সারাবিশ্বে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য সরবরাহে কৃষ্ণসাগর, বসফরাস প্রণালি ও দার্দানেলিস প্রণালি অতি গুরুত্বপূর্ণ।

হরমুজ প্রণালি

বিশ্বব্যাপী পেট্রোলিয়াম পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ একটি সমুদ্রপথ ‘হরমুজ প্রণালি’ । প্রণালিটি পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগর ও আরব সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। অন্যদিকে, আরব উপদ্বীপকে ইরান থেকে পৃথক করেছে। বৈশ্বিক জ্বালানি তেল রপ্তানির পাঁচ ভাগের এক ভাগ এই প্রণালি দিয়ে সম্পন্ন হয়। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তরল প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদক কাতার এলপিজি গ্যাসের প্রায় পুরোটাই এই প্রণালি দিয়ে বহির্বিশ্বে রপ্তানি করে।

মালাক্কা প্রণালি

মালয়েশিয়া উপদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত সরু জলপথের নাম মালাক্কা প্রণালি । ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে মূল শিপিং চ্যানেল এটি। ইউরোপ, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে এশিয়া প্যাসেফিক অঞ্চলের সংক্ষিপ্ততম সমুদ্র রুট এটি। সমুদ্রপথে বিশ্বের তেল পরিবহনের চার ভাগের এক ভাগ এই প্রণালি দিয়ে সম্পাদিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র তার ২১ শতাংশেরও বেশি পণ্য এই প্রণালি দিয়ে চীন থেকে আমদানি করে। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের প্রায় ৬০ শতাংশ সম্পন্ন হয় মালাক্কা প্রণালির মাধ্যমে ।

বাব-এল মান্দেব প্ৰণালি

লোহিত সাগর ও সুয়েজ খাল দিয়ে ভারত মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যে একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হিসেবে কাজ করে বাব-এল মান্দেব প্রণালি এটি লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরকে সংযুক্ত করেছে। আরব উপদ্বীপ থেকে তেল বাণিজ্যে এ প্রণালি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

জিব্রাল্টার প্রণালি

ভূমধ্যসাগরের তীরে স্পেন উপকূলে ব্রিটিশশাসিত একটি ভূখণ্ড জিব্রাল্টার। অঞ্চলটি ব্রিটিশদের অন্যতম সামরিক ও নৌঘাঁটি। এর দৈর্ঘ্য ৬০ কিমি ও প্রস্থ ১৪.৩ কিমি ৷ প্রণালিটি ইউরোপের স্পেন ও আফ্রিকার মরক্কোকে পৃথক করেছে। আর আটলান্টিক মহাসাগরকে ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে।

মানবসভ্যতার উৎকর্ষের পেছনে সমুদ্রপথের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে সমুদ্রপথ ব্যবহার করা হচ্ছে। মহাসাগরগুলো জুড়ে চলাচলকারী পণ্যবাহী ট্যাংকার জাহাজগুলো যেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ধমনী। আধুনিক যুগেও সমুদ্রপথ সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে রয়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button