ভাষা ও বাংলা ভাষা

ভাষা ও বাংলা ভাষা

প্রাণিজগতে একমাত্র মানুষের ভাষা আছে। শরীর ও স্নায়ুবিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, ভাষা ব্যবহারের জন্য মানুষের স্নায়ুতন্ত্র, তার মস্তিষ্ক ও অন্যান্য প্রত্যঙ্গ যেভাবে তৈরি হয়েছে, অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না। ভাষার সাহায্যে আমরা কথা বলি। ভাষার মাধ্যমে আমরা প্রকাশ করি আমাদের অভিজ্ঞতা, নানা ধরনের আবেগ, বিভিন্ন প্রকার অনুভূতি, যেমন- হিংসা, বিদ্বেষ, ভাললালাগা ও ভালােবাসা, ঘৃণা, ক্ষোভ ইত্যাদি। ভাষার আরও কাজ রয়েছে। ভাষা আমাদের শিক্ষার মাধ্যম, ভাষার সাহায্যে আমরা অন্যের সঙ্গে তর্কবিতর্ক করি। ভাষাকে দেশগঠনের হাতিয়ার হিসেবেও গ্রহণ করা হয়। দেশগঠন বলতে দেশের ও মানুষের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে বােঝায়। এই অগ্রগতি বা কল্যাণসাধন কীভাবে করা যাবে, কীভাবে দেশের মানুষের মঙ্গল করা সম্ভব—সেসব কথা ভাষার মাধ্যমে মানুষের কাছে তুলে ধরতে হয়। ভাষা দুই প্রকার-(ক) মৌখিক ভাষা (Oral Language) ও (খ) লিখিত ভাষা (Written Language)।

ক) মৌখিক ভাষা : আদিতে লেখার ব্যবস্থা বা লিখিত ভাষার প্রচলন ছিল না। মুখের ভাষাই তখন মানুষের একমাত্র প্রকাশমাধ্যম ছিল। এখনাে বিশ্বের বহু ভাষা মৌখিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃগােষ্ঠীগুলাের প্রত্যেকেরই ভাষা আছে। কিন্তু তাদের সব ভাষার লিখন-ব্যবস্থা নেই; মুখে-মুখে সেগুলাে প্রচলিত আছে। যেসব ভাষা লেখার কোনাে ব্যবস্থা নেই সেগুলােই হলাে মৌখিক ভাষা।

খ) লিখিত ভাষা : মুখের ভাষার সীমাবদ্ধতা আছে। যে-ব্যক্তি তা ব্যবহার করে তার জীবন শেষ হলে এ ভাষার সঙ্গে আর পরিচিত হওয়া যায় না। তার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধির সঙ্গে অন্য মানুষের পরিচিত হওয়ার কোনাে সুযােগ থাকে না। কোনােকিছুর কাছে হার স্বীকার করা মানুষের ধর্ম নয় । মানুষ চেষ্টা করেছে তার ভাষাকে ধরে রাখতে, যাতে ব্যক্তির মৃত্যুর পরও ভাষা বেঁচে থাকে। এভাবেই একদিন আবিষ্কৃত হয়েছে লিখন-ব্যবস্থা (Writing-System)। বিশ্বের ভাষাগুলাে লেখার নানা ব্যবস্থা রয়েছে। আপাত মনে হয়, ভাষাসমূহের লিখনব্যবস্থা বহু এবং একটির সঙ্গে আর-একটির কোনাে মিল নেই। কিন্তু সে-ধারণা বাস্তব নয়। ভাষার লিখন-ব্যবস্থা প্রধানত তিন প্রকার :

আরও পড়ুন :  সাধারণ জ্ঞান : সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ জ্ঞান

বর্ণভিত্তিক (Alphabetic): বিশ্বের অনেক ভাষারই বর্ণ আছে; যেমন-বাংলা, ইংরেজি, রুশ, হিন্দি, তামিল প্রভৃতি। এসব ভাষার লিখনব্যবস্থা হলাে বর্ণভিত্তিক।

অক্ষরভিত্তিক (Syllabic) : অক্ষর (Syllable) বলতে বােঝায় কথার টুকরাে অংশ। কথা বলার সময় আমরা এ-অংশই উচ্চারণ করি। একে উচ্চারণের একক (unit) ধরা হয়। একে দল-ও বলে। অক্ষর অনুযায়ী যেসব ভাষা লেখার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তাকে বলে অক্ষরভিত্তিক লিখনরীতি। যেমন- জাপানি ভাষা।

ভাবাত্মক (Idiographic) : বিশ্বে এমন কিছু ভাষা আছে যেগুলাে লেখার জন্য বর্ণ কিংবা অক্ষর কোনােটিই ব্যবহার করা হয় না। অনেকটা ছবি এঁকে এসব ভাষা লেখা হয়। এই লিখন-ব্যবস্থাই হলাে ভাবাত্মক। চীনা, কোরীয় ভাষা এ পদ্ধতিতে লেখা হয়।

ভাষার উপাদান

ভাষার প্রধান উপাদান চারটি—(ক) ধ্বনি, (খ) শব্দ, (গ) বাক্য ও (ঘ) বাগর্থ। নিচে এগুলাে আলােচনা
করা হলাে।

ক) ধ্বনি (Sound) : বাতাসে আঘাতের ফলে ধ্বনির সৃষ্টি হয়। কিন্তু সব ধ্বনিই ভাষার ধ্বনি নয়। ভাষায় তাকেই ধ্বনি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে যা বাগৰ (Speech Organs)-এর সাহায্যে তৈরি হয়। বাগযন্ত্রের ক্ষমতা অসীম। এর সাহায্যে আমরা পশু-পাখির ডাক থেকে নানারকম ডাক ডাকতে বা অনুকরণ করতে পারি। কিন্তু এসব ভাষার ধ্বনি নয়। ভাষার ধ্বনি শুধু বাগযন্ত্রের সাহায্যে উৎপাদিত হলে চলবে না, তাকে অবশ্যই অর্থপূর্ণ হতে হবে। পশু-পাখির ডাক কিংবা এজাতীয় কোনাে ডাককে আমরা বলি আওয়াজ (noise)। ভাষার একটি ধ্বনির স্কুলে আর-একটি ধ্বনি বদলে দিলে নতুন অর্থবােধক শব্দ তৈরি হয়। যেমন-কাল। এখানে ক্ ধ্বনিটি বদলিয়ে খৃ বললেই সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ বহন করে এমন শব্দ তৈরি হয়। যেমন-খাল, গাল, তাল, ঢাল, মাল, শাল ইত্যাদি। এভাবে আমরা খৃগ তু মৃ শ ধ্বনি পাই। ধ্বনির উপলব্ধি ভাষাভাষীদের মনেই রয়েছে এবং সাক্ষর ও নিরক্ষর সব মানুষই তা
জানে, বােঝে ও ব্যবহার করে।

আরও পড়ুন :  প্রেম ও দ্রোহের কবি নজরুল বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি

খ) শব্দ (Word) : এক বা একাধিক ধ্বনি মিলে শব্দের সৃষ্টি হয়। যেমন-মানুষ। এখানে পাঁচটি ধ্বনি আছে : ম্+আ++উ+শ(ষ) লক্ষ করাে, এ-উদাহরণে শেষ ধ্বনিটি বােঝাতে তালব্য-শ লিখে প্রথম বন্ধনীতে মূর্ধন্য-ষ লেখা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, মূর্ধন্য-ষ ধ্বনি নয়, বর্ণ।

গ) বাক্য (Sentence) : বাক্য বলতে কথা বা বাচন (Speech)-কে বােঝায়। ভাষার উপাদান হিসেবে ধরলে বাক্যের স্থান তৃতীয়। ধ্বনি দিয়ে যা শুরু হয়েছিল শব্দে এসে তা আরও সংহত হয়। বাক্যে এসে পরিপুর্ণ না হলেও এটি অনেকটাই পূর্ণতা পায়। প্রতিটি বাক্যই কেউ উৎপাদন করে আর কেউ শােনে। বাক্যের সঙ্গে তাই দুজনের সম্পর্ক রয়েছে—ব (Speaker) ও শােভা (Hearer)। এই দুই পক্ষের মধ্যে কোনাে ঘাটতি থাকলে চলে না। বঙ্গ যা বলে তাতে শ্রোতার সব কৌতূহল মিটতে হয়। এজন্য বলা হয় : যা উক্তি হিসেবে সম্পূর্ণ এবং যাতে শ্রোতা পরিপূর্ণভাবে তৃপ্ত হয় তা-ই হলাে বাক্য। যেমনআমরা গ্রামে বাস করি। মহৎ গুণই মানুষকে বড় করে।

ঘ) বগি (Semantics) : অভিধানে শব্দের অর্থ থাকে। কিন্তু সেই শব্দ যখন বিশেষ পরিবেশে ব্যবহার করা হয় তখন তার অর্থ বদলে যায়। একই কথা বলা চলে বাক্যপ্রসঙ্গে। আমরা শব্দের সাহায্যে যে-বাক্য তৈরি করি, তার অর্থ বাক্যে গিয়ে পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন- ‘পােড় একটি শব্দ। এর অর্থ দগ্ধ হওয়া’ (আগুনে তার খড়ের ঘর পুড়ে গেছে)। শব্দটি দিয়ে যখন বাক্য তৈরি করে বলা হয় : “আমার মন পুড়ছে- তখন এ-পােড়া’ দন্ধ হওয়া নয়। ভাষার শব্দ ও বাক্যের এসব অর্থের আলােচনাই হলাে ৰাগৰ্থ।

প্রকাশমাধ্যম ও ভাষা

ভাষা মানুষের ভাব প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম নয়। এজন্য আরও কিছু মাধ্যম রয়েছে। ভাষা আবিষ্কারের পূর্বে নানারকম অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে, কখনাে আবার ছবি এঁকে মানুষ নিজেকে প্রকাশ করেছে। এজন্য নানা ধরনের চিহ্ন এবং সংকেতও ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা মুখ বা চেহারার নানা ভঙ্গি করে হাসি, কান্না, বিস্ময়, জিজ্ঞাসা ইত্যাদি বােঝাতে পারি। মাথা নেড়ে হাঁ বা না বোঝাতে পারি। এজাতীয় ভাষাকে বলে অঙ্গভঙ্গির ভাষা (Gesture Language)। রাস্তায় দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশ হাতের ইশারায় গাড়ি থামায়, আবার চলার নির্দেশ দেয়। রাস্তার দুপাশে অনেক নির্দেশ থাকে কোন দিকে গাড়ি চলবে, কোন দিকে গাড়ি চলবে না, রাস্তা সােজা না বাঁকা, পথচারী কীভাবে রাস্তা পার হবে ইত্যাদি। যারা কথা বলতে ও শুনতে পায় তাদের আমরা বলি মূক ও বধির। তাদের ব্যবহারের জন্য এক ধরনের ভাষা। আছে। হাতের আঙুল ব্যবহার করে, কখনাে আঙুল মুখে ছুঁয়ে, কখনাে আবার হাত মাথায় উঠিয়ে, কখনাে বুকে হাত দিয়ে তারা তাদের ভাব প্রকাশ করে। ভাষার মধ্যে এই যােগাযােগও পড়ে। একে বলে সংকেত ভাষা (Sign Language)। ইশারা ভাষা হিসেবেও তা পরিচিত।

আরও পড়ুন :  শরীরের কোন অংশ পুড়ে গেলে করণীয়

মাতৃভাষা ও বাংলা ভাষা

মাতৃভাষা অর্থ মায়ের ভাষা। অন্যভাবে বলা যায়, আমরা মায়ের কাছ থেকে যে-ভাষা শিখি তা-ই হলাে আমাদের মাতৃভাষা (Mother Language)। শিশু সব সময়ই যে মায়ের কাছ থেকে ভাষা শেখে তা নয়। কখনাে কখনাে এর ব্যতিক্রম ঘটে। মায়ের মতাে যে শিশুকে প্রতিপালন করে কিংবা জন্মের পর থেকে যার সেবায় ও যত্নে শিশু ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে তার ভাষাই শিশু প্রথম শেখে। বাঙালি মায়ের সন্তান জন্মের পর থেকে স্প্যানিশ বা জার্মানভাষী মায়ের পরিচর্যায় বড় হলে তার প্রথম ৰা মাতৃভাষা কখনাে বাংলা হবে না, হবে স্প্যানিশ বা জার্মান। তাই বলা হয়, শিশু প্রথম যে-ভাষা শেখে তা-ই তার প্রথম ভাষা (First Language) বা মাতৃভাষা। সাধারণত দেখা যায় যে, বাঙালি মায়ের শিশুর মাতৃভাষা বাংলা, ইংরেজ মায়ের

Leave a Reply