অর্থ বা টাকা জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণের জন্য অর্থের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা—সব কিছুর জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যখন এই অর্থপ্রাপ্তির বাসনা সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন তা হয়ে ওঠে অনর্থের মূল। তাই প্রাচীনকাল থেকেই বলা হয়ে আসছে—“অর্থই অনর্থের মূল।”
আসলে অর্থ নিজে কখনো ভালো বা মন্দ নয়। মানুষের ব্যবহার ও মনোভবই অর্থকে অর্থবোধক বা অনর্থবোধক করে তোলে। যখন কেউ শুধুমাত্র অর্থপ্রাপ্তির মোহে অন্যের ক্ষতি করে, তখনই অর্থ হয়ে ওঠে সমাজবিধ্বংসী এক অস্ত্র। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অর্থের লোভেই বহু যুদ্ধ হয়েছে, রাজ্য ধ্বংস হয়েছে, ভাই ভাইয়ের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। শকুন্তলার স্বামী দুষ্মন্ত রাজাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল অর্থলোভী মন্ত্রী; টাকার জন্যই কৌরবরা দ্রৌপদীকে পণ করেছিল পাশাখেলায়।
মানুষ যখন অর্থকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে, তখন সে মানবিক গুণাবলি বিসর্জন দেয়। তার হৃদয় থেকে সহানুভূতি, ন্যায়বোধ ও সত্যনিষ্ঠা বিলীন হয়ে যায়। সে তখন শুধু লাভ-লোকসানের হিসাব করে, মানুষের চোখে নয়, পণ্যের দামে দেখে সমাজকে। দুর্নীতি, ঘুষ, অবৈধ ব্যবসা, চুরি, ডাকাতি—এই সবের মূলেও থাকে অর্থলালসা। বহু মানুষ অন্যায়ভাবে ধনী হতে গিয়ে পতনের অতল গহ্বরে নিপতিত হয়েছে।
তবে একথাও সত্য, অর্থ ছাড়াও জীবন অচল। সমস্যা তখনই সৃষ্টি হয়, যখন অর্থ উপার্জনের পদ্ধতি অসৎ হয় এবং অর্থকে জীবনের শেষ কথা ধরে নেওয়া হয়। অর্থ যখন নিয়ন্ত্রক নয়, নিয়ন্ত্রিত—তখনই তা কল্যাণকর হয়। কিন্তু অর্থ যখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জীবনের চালক হয়ে ওঠে, তখন তা অনর্থ ডেকে আনে। এই অনর্থ হতে পারে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, এমনকি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও।
ধর্মগ্রন্থগুলোতেও অর্থলালসার পরিণাম নিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টধর্ম—সব ধর্মেই বলা হয়েছে, অতিলোভ মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। “অল্পে সন্তুষ্টি” আর “সৎ পথে উপার্জন”—এই শিক্ষাই দিয়েছে আমাদের ধর্ম ও নৈতিকতা।
অর্থের প্রয়োজনীয়তা যেমন অস্বীকার করা যায় না, তেমনি এও মানতে হবে যে সীমাহীন অর্থলোভ মানবজীবনে অনর্থ ডেকে আনে। তাই আমাদের উচিত অর্থের দাস না হয়ে অর্থকে নিয়ন্ত্রণ করা। সৎপথে উপার্জন, পরিমিত জীবনযাপন ও মানবিক গুণাবলির চর্চার মাধ্যমেই আমরা অর্থের আশীর্বাদকে অনর্থে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারি। মনে রাখতে হবে—“অর্থ উপকারের মাধ্যম, কিন্তু লোভে পড়লে অনর্থের কারণ।”
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ : “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: অর্থ সম্পদের বিনাশ আছে, কিন্তু জ্ঞান সম্পদ কখনও বিনষ্ট হয় না
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: মিথ্যা শুনিনি ভাই / এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: জাল কহে, “পঙ্ক আমি উঠাব না আর” / জেলে কহে, “মাছ তবে পাওয়া হবে ভার”
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: সবলের পরিচয় আত্মপ্রসারে, আর দুর্বলের স্বস্তি আত্মগোপনে
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: যাহা চাই ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, আছে যার ভুরি ভুরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে