ভাবসম্প্রসারণ : “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”

মানুষের জীবনে ক্ষুধার অনুভূতি এক অত্যন্ত তীব্র এবং শিকারী অনুভূতি। ক্ষুধার রাজ্যে, পৃথিবী যেন কেবল একটি গদ্যময় স্থান, যেখানে সৌন্দর্য, রূপ, কল্পনা — সব কিছুই তুচ্ছ হয়ে পড়ে। ক্ষুধার যখন প্রকোপ হয়, তখন পৃথিবীর সমস্ত রূপ সৌন্দর্য, ফুলের রঙ, চাঁদের আলো, সবই যেন অসাড়, নিরস এবং প্রাণহীন হয়ে ওঠে। ক্ষুধার তীব্রতা তখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায়, যেখানে মানুষের মন আর কোনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে তৃপ্তি পায় না। তাকে তখন প্রয়োজন শুধু একটি খাবারের, পেটভরার। পেটভরার পরই তার অন্তরে আসবে প্রশান্তি, আনন্দ, তৃপ্তি এবং পৃথিবী তার চোখে সুন্দর হয়ে উঠবে।

প্রকৃতি তার অপার সৌন্দর্য নিয়ে সব সময় মানুষের সামনে উপস্থিত থাকে। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা নানান রং, মিষ্টি সুর, জ্যোৎস্নার মায়াজাল—সব কিছুই আমাদের মনকে সান্ত্বনা দেয়। সারা পৃথিবীকে দেখতে, উপভোগ করতে মানুষের হৃদয়ে সবসময় স্থান থাকে। কিন্তু যখন ক্ষুধা মানুষের দেহে আক্রমণ করে, তখন সে সৌন্দর্য আর অনুভূতির কোনোই গুরুত্ব থাকে না। ক্ষুধার কাছে সে যেন এক অন্ধ, খালি চোখে পৃথিবীকে দেখে। এমনকি পূর্ণিমার চাঁদকেও সে মনে করে ঝলসানো রুটির মতো। চাঁদের স্নিগ্ধ, শান্তির আলো তার চোখে কোনোভাবে মধুর মনে হয় না, কারণ তার পেটে খিদে, তার মনেও শান্তি নেই। খাদ্যই তখন তার একমাত্র প্রয়োজন, আর কিছুই না।

এটা বুঝতে হবে, ক্ষুধা মানুষের মানবিকতা, সৌন্দর্যবোধ এবং আনন্দের অনুভূতিকে নষ্ট করে দেয়। পৃথিবীর চল্লিশ শতাংশ মানুষ আজও ক্ষুধার কষাঘাতে বাঁচে। তারা দারিদ্র্যের কারণে সমস্ত সৌন্দর্য, কল্পনা ও সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলে। তাদের জন্য জীবন হয়ে ওঠে কঠিন সংগ্রাম, যেখানে তাদের আনন্দ, স্বপ্ন, এবং সৃষ্টির আনন্দ কেবল গৌণ হয়ে যায়। তাদের কাছে সব কিছুই ধূসর, বিবর্ণ, এবং নির্মম হয়ে যায়। তীব্র ক্ষুধা তাদের জীবনে একটি অন্ধকার ছড়িয়ে দেয়, যা কেবল তাদের শারীরিকই নয়, মানসিক ও আত্মিক অবস্থা কাবু করে ফেলে।

ক্ষুধার রাজ্যে বসবাসরত মানুষদের জীবনে সত্যিই কাব্যের সৌন্দর্য, নান্দনিকতা বা রূপের গুরুত্ব থাকে না। তাদের কাছে চাঁদ, সূর্য, ফুল—সবই তুচ্ছ হয়ে যায়। কারণ ক্ষুধা তখন তাদের একমাত্র বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায়। তারা যখন পেট ভরে খেতে পায়, তখন তার অন্তর সঞ্জীবিত হয়, রঙের খেলা তার মনের আকাশে উদিত হয়। তখন তাদের জীবন সঠিক অর্থ খুঁজে পায়, বিশ্ব তাদের কাছে সুন্দর হয়ে ওঠে।

অতএব, মানব জীবনের প্রথম চাহিদা হওয়া উচিত ক্ষুধার নিবৃত্তি। যখন ক্ষুধা দূর হয়, তখন মানুষের জীবন রূপ লাভ করে, সৌন্দর্য ফিরে আসে, এবং পৃথিবীকে তার এক পূর্ণাঙ্গ চিত্রে দেখতে পায়। ক্ষুধার দুঃখ কাটিয়ে উঠলেই মানুষ প্রকৃত আনন্দের সন্ধান পাবে। তাই, মানবজীবনের প্রথম সাধনা হোক ক্ষুধা মেটানোর সাধনা।

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ : “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: অর্থ সম্পদের বিনাশ আছে, কিন্তু জ্ঞান সম্পদ কখনও বিনষ্ট হয় না

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: মিথ্যা শুনিনি ভাই / এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: জাল কহে, “পঙ্ক আমি উঠাব না আর” / জেলে কহে, “মাছ তবে পাওয়া হবে ভার”

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: সবলের পরিচয় আত্মপ্রসারে, আর দুর্বলের স্বস্তি আত্মগোপনে

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: যাহা চাই ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, আছে যার ভুরি ভুরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে