ভাবসম্প্রসারণ : স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনো শেখে নি বাঁচিতে

মানুষের জীবন শুধুই দেহে শ্বাসপ্রশ্বাসের নাম নয়। শুধু নিজের জন্যে খাওয়া, ঘুমানো, নিজের আঙিনায় সুখ খোঁজার নাম ‘বাঁচা’ নয়। প্রকৃত জীবন শুরু হয় তখন, যখন কেউ নিজের সীমানা ছাড়িয়ে অন্যের জীবনে আলো জ্বালাতে শেখে। যারা কেবল নিজের স্বার্থের মেঘে আকাশ ঢেকে রাখে, তাদের হৃদয়ের রোদ কোনোদিন প্রস্ফুটিত হয় না। তারা দেহে বাঁচে, কিন্তু মননে মৃত।

এই পৃথিবী একটি বিরাট হৃদয়ের প্রতিকৃতি, যেখানে প্রতিটি মানুষের অস্তিত্ব অন্য মানুষের সঙ্গে অদৃশ্য বন্ধনে জড়িত। “আমি শুধু আমারই” — এই মনোভাব মানুষকে ছোট করে, সংকীর্ণ করে, নিঃস্ব করে তোলে। আত্মকেন্দ্রিকতা এক বিষবৃক্ষ, যার ফল কেবল বিষাদ ও নিঃসঙ্গতা। যেমন খাঁচার পাখি উড়তে জানে না, তেমন স্বার্থপর মানুষও জীবনের বিস্তার বোঝে না। সে বন্দী থাকে নিজের গড়া স্বার্থের কারাগারে। অথচ মানুষের জীবন ঠিক নদীর মতো—চলতে চলতেই তার সৌন্দর্য। এক জায়গায় থেমে গেলে সে শুধু জলাশয় হয়ে পড়ে, নষ্ট হয় তার স্বতঃস্ফূর্ত গতি ও প্রাচুর্য।

সত্যিকার বেঁচে থাকা মানে অন্যের মুখে হাসি ফোটানো, অপরের দুঃখে কাঁধ দেওয়া, পরের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। আত্মত্যাগেই জীবনের পূর্ণতা। জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলো গড়ে ওঠে তখনই, যখন মানুষ নিজেকে হারিয়ে অন্যের মাঝে খুঁজে পায়। “যে প্রাণে ত্যাগ নেই, সে প্রাণ প্রাণ নয়”—এই সত্যকে যিনি উপলব্ধি করেন, তিনিই প্রকৃত অর্থে জীবনের আস্বাদ গ্রহণ করতে পারেন।

নিজস্ব সুখের বৃত্তে আবদ্ধ মানুষ মাটির প্রদীপের মতো—নিজেকে জ্বালায়, কিন্তু চারপাশ অন্ধকারেই রেখে দেয়। আর যে ব্যক্তি নিঃস্বার্থভাবে চারদিকে আলো বিলায়, সে হয় সূর্যের মতো—সবাইকে উষ্ণতা দেয়, নিজেও দীপ্তিমান হয়। বড় হওয়া মানেই নিজের সীমানা ছেড়ে বৃহৎ মানুষের জগতে প্রবেশ করা, ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’য় উত্তরণ।

তাই বলা যায়—যে কেবল নিজের কথা ভাবে, সে কখনো বাঁচে না। সে টিকে থাকে, কিন্তু জীবনের গন্ধ পায় না। বাঁচা মানে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার এক নিরন্তর সাধনা, যেখানে মানুষ খোঁজে পরার্থে নিজেকে উৎসর্গ করার পরম আনন্দ।

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ : “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: অর্থ সম্পদের বিনাশ আছে, কিন্তু জ্ঞান সম্পদ কখনও বিনষ্ট হয় না

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: মিথ্যা শুনিনি ভাই / এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: জাল কহে, “পঙ্ক আমি উঠাব না আর” / জেলে কহে, “মাছ তবে পাওয়া হবে ভার”

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: সবলের পরিচয় আত্মপ্রসারে, আর দুর্বলের স্বস্তি আত্মগোপনে

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: যাহা চাই ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, আছে যার ভুরি ভুরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল

✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে