যাকাতুল ফিতর হলো ঈদুল ফিতরের দিনে প্রদানযোগ্য একটি বাধ্যতামূলক দান, যা ইসলামে প্রতিটি সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য ফরজ করা হয়েছে। এটি রমজান মাসের রোজার শুদ্ধি ও সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে আনন্দ ভাগাভাগি করার উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়।
ইসলামে এর গুরুত্ব
ইসলামে যাকাতুল ফিতর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। এটি রোজার কিছু ঘাটতি পূরণ করে এবং সমাজে দারিদ্র্য বিমোচনে সাহায্য করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“রাসূলুল্লাহ (সা.) রমজানের রোজাকে পবিত্র ও গরিবদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য ফিতরা প্রদানকে আবশ্যিক করেছেন।” (আবু দাউদ, হাদিস: ১৬০৯)
এটি ঈদের দিন গরিব ও দুস্থ মানুষদের জন্য খাবারের সংস্থান করে, যাতে তারা ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে।
যাকাতুল ফিতর প্রদানকারীর যোগ্যতা
কারা যাকাতুল ফিতর দিতে বাধ্য?
যাকাতুল ফিতর প্রদান বাধ্যতামূলক তাদের জন্য যারা নিম্নলিখিত শর্ত পূরণ করে—
- মুসলমান হওয়া: যাকাতুল ফিতর শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য ফরজ।
- স্বাধীন হওয়া: দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও ইসলামের মূলনীতিতে স্বাধীন ব্যক্তির জন্য ফিতরা ফরজ বলা হয়েছে।
- সামর্থ্যবান হওয়া: যে ব্যক্তি নিজের ও পরিবারের মৌলিক চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত সম্পদ রাখে, তিনি ফিতরা দিতে বাধ্য।
- ঈদের আগের সন্ধ্যায় জীবিত থাকা: কোনো ব্যক্তি যদি ঈদের আগের সন্ধ্যায় জীবিত থাকেন, তাহলে তার জন্য ফিতরা ওয়াজিব হয়।
কোন সম্পদের উপর এটি ওয়াজিব?
যাকাতুল ফিতর দেওয়ার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সম্পদের মালিক হতে হয় না, বরং যার নিত্যপ্রয়োজনের অতিরিক্ত পরিমাণ সম্পদ বা খাদ্য থাকে, তিনিই এর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। ইসলামী আইন অনুযায়ী, যদি কারও কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে, তবে তিনি ফিতরা দিতে বাধ্য হবেন।
যাকাতুল ফিতরের পরিমাণ
কী পরিমাণ দিতে হবে?
যাকাতুল ফিতরের নির্দিষ্ট পরিমাণ রয়েছে, যা রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্ধারণ করে দিয়েছেন। মূলত এটি খাবারদ্রব্য হিসেবে নির্ধারিত, তবে বর্তমান সময়ে এর নগদ মূল্যের হিসাব করাও প্রচলিত।
বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রীর ভিত্তিতে নির্ধারিত পরিমাণ
হাদিস অনুযায়ী, যাকাতুল ফিতরের নির্ধারিত পরিমাণ হলো এক ‘সা’ খাবার, যা প্রায় ৩.২৫ কেজি হয়ে থাকে। নিম্নলিখিত খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে এটি আদায় করা যায়—
- গম – ১.৬২৫ কেজি (অর্ধ ‘সা’)
- গমের আটা – ১.৬২৫ কেজি
- খেজুর – ৩.২৫ কেজি
- কিসমিস – ৩.২৫ কেজি
- যব – ৩.২৫ কেজি
নগদ অর্থের মাধ্যমে পরিশোধ করা যাবে কি না?
অনেক ইসলামী স্কলার নগদ অর্থের মাধ্যমে যাকাতুল ফিতর আদায়কে বৈধ মনে করেন, যাতে দরিদ্র ব্যক্তিরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যয় করতে পারেন। তবে মূলত খাদ্যশস্য দেওয়াই সুন্নত পদ্ধতি। নগদ অর্থের পরিমাণ প্রতি বছর বাজারদরের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।
যাকাতুল ফিতরের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি
কে এই দান গ্রহণ করতে পারেন?
যাকাতুল ফিতর শুধুমাত্র সেইসব ব্যক্তি গ্রহণ করতে পারবেন, যারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল। ইসলামic শরিয়াহ অনুযায়ী, নিম্নলিখিত ব্যক্তিরা এর উপযুক্ত—
- গরিব ও অভাবী ব্যক্তিরা – যারা মৌলিক চাহিদা মেটাতে অক্ষম।
- মিসকিন (চরম দারিদ্র্যগ্রস্ত ব্যক্তি) – যাদের খাদ্য নেই এবং কারও সাহায্য ছাড়া চলতে পারেন না।
- ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি – যারা বৈধ কারণে ঋণগ্রস্ত হয়েছেন এবং তা পরিশোধ করতে অক্ষম।
- মুসলিম বন্দী মুক্তির জন্য – যারা অন্যায়ভাবে বন্দি রয়েছেন এবং মুক্তির জন্য সহায়তা প্রয়োজন।
- অসহায় পথচারী – যারা ভ্রমণে আর্থিক কষ্টে রয়েছেন এবং সাহায্যের প্রয়োজন।
কাদেরকে দেওয়া নিষিদ্ধ?
নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের যাকাতুল ফিতর দেওয়া বৈধ নয়—
- স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে দিতে পারবেন না।
- স্বচ্ছল ও ধনী ব্যক্তি।
- নিজের সন্তান, পিতা-মাতা, দাদা-দাদি, নানি-নানাকে দেওয়া যাবে না।
- নাবালিগ বা অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান, যদি সে স্বচ্ছল হয়।
যাকাতুল ফিতর প্রদানের সময়
কখন আদায় করা উত্তম?
যাকাতুল ফিতর আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট সময় রয়েছে, এবং এটি সময়মতো আদায় করাই উত্তম।
- উত্তম সময়: ঈদের দিনের ফজরের পর থেকে ঈদের নামাজের আগে পর্যন্ত।
- সর্বোত্তম পদ্ধতি: ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে গরিবদের মধ্যে ফিতরা বিতরণ করা।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“ঈদের নামাজের আগে ফিতরা প্রদান করাই উত্তম, আর যদি নামাজের পর দেওয়া হয়, তাহলে তা সাধারণ দান হিসেবে গণ্য হবে।” (আবু দাউদ, হাদিস: ১৬০৯)
আরও পড়ুন : ঈদের নামাজের সঠিক নিয়ম ও দোয়া
কখন আদায় না করলে তা গণ্য হবে না?
যাকাতুল ফিতর ঈদের নামাজের আগেই দেওয়া উচিত। তবে কেউ যদি—
- ঈদের নামাজের পর দেয়, তাহলে এটি সাধারণ দান হিসেবে গণ্য হবে এবং যাকাতুল ফিতরের আদায় হিসেবে গণ্য হবে না।
- অপেক্ষা করতে করতে ঈদ চলে যায়, তাহলে তার ওপর গুনাহ হতে পারে, কারণ এটি সময়মতো আদায় করা ফরজ।
তবে কেউ যদি ঈদের আগের ২-৩ দিন আগে ফিতরা প্রদান করে, তাহলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে, কারণ কিছু সাহাবি রমজানের শেষ কয়েক দিনে এটি প্রদান করতেন।
যাকাতুল ফিতরের ইসলামিক দলিল ও হাদিস
কুরআন থেকে দলিল
কুরআনে বলা হয়েছে—
“যে ব্যক্তি তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে, সে সফলকাম হলো।” (সূরা আল-আ’লা: ১৪)
যাকাতুল ফিতর আত্মার পরিশুদ্ধির একটি মাধ্যম, যা আমাদের রোজার ত্রুটিগুলো দূর করে এবং গরিবদের ঈদের আনন্দে শরিক করতে সহায়তা করে।
হাদিস থেকে দলিল
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
“রাসুলুল্লাহ (সা.) রোজার শুদ্ধির জন্য ও গরিবদের খাদ্যের সংস্থান করতে যাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন।” (আবু দাউদ, হাদিস: ১৬০৯)
অন্য একটি হাদিসে এসেছে—
“যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে ফিতরা প্রদান করলো, সেটি গ্রহণযোগ্য দান। আর যে ব্যক্তি নামাজের পরে দিলো, সেটি সাধারণ সদকা হয়ে যাবে।” (বুখারি ও মুসলিম)
ইসলামিক পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা
- ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন, যাকাতুল ফিতর প্রদান করা বাধ্যতামূলক এবং এটি ঈদের আগেই দেওয়া উত্তম।
- ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, যাকাতুল ফিতর ঈদের নামাজের আগেই প্রদান করতে হবে, তবে কেউ চাইলে আগেই দিতে পারেন।
যাকাতুল ফিতরের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা
যাকাতুল ফিতর ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কল্যাণমূলক ব্যবস্থা। এটি দারিদ্র্য কমানোর একটি কার্যকর উপায়, যা দরিদ্র ও অসহায় ব্যক্তিদের সহায়তা করে।
- ঈদের দিনে সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা হয় – যাকাতুল ফিতর মূলত খাদ্যশস্য বা অর্থ প্রদান করার মাধ্যমে দরিদ্রদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
- আর্থিক ভারসাম্য বজায় রাখে – ধনী ও গরিবের মধ্যে সম্পদের বণ্টন নিশ্চিত করে এবং সমাজে আর্থিক ভারসাম্য আনে।
- দরিদ্রদের ঈদের আনন্দে শরিক করা – এটি দরিদ্রদের ঈদের দিনে দুঃখ-কষ্ট ভুলে আনন্দ উদযাপনের সুযোগ দেয়।
মুসলিম সমাজে সম্প্রীতি বৃদ্ধি
যাকাতুল ফিতর সমাজে মানবিকতা ও সহমর্মিতার শিক্ষা দেয়।
- সহানুভূতি বৃদ্ধি করে – এটি ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার বন্ধন গড়ে তোলে।
- অসচ্ছলদের প্রতি দয়া প্রদর্শন – সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি গরিবদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পান।
- সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরি করে – এটি ধনীদের মনে করিয়ে দেয় যে, তাদের সম্পদের একটি অংশ গরিবদের প্রাপ্য।
উপসংহার
যাকাতুল ফিতর শুধু দানের একটি ব্যবস্থা নয়; এটি ইসলামের এক মহান আদর্শ যা মানুষের আত্মশুদ্ধি ও সমাজের কল্যাণে ভূমিকা রাখে।
- এটি রোজার ঘাটতি পূরণ করে এবং আত্মশুদ্ধি অর্জনে সাহায্য করে।
- এটি দরিদ্রদের সহায়তা করে এবং ঈদের আনন্দ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়।
- সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে।
তাই, প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের উচিত যথাযথভাবে যাকাতুল ফিতর প্রদান করা, যেন সমাজে কেউ ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয়।