ঈদুল ফিতর

ঈদের দিন সুন্নাতসমূহ: কী করলে সওয়াব বেশি পাবেন?

ঈদের দিন সুন্নাতসমূহ: কী করলে সওয়াব বেশি পাবেন?

ইসলামে ঈদের দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দের একটি বিশেষ দিন। এই দিনটি মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমতের প্রতীক। ঈদুল ফিতর আসে রমজানের দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর, আর ঈদুল আজহা আসে কুরবানির ত্যাগের মহিমা নিয়ে। প্রতিটি ঈদই মুসলমানদের জন্য নতুন আনন্দ, পারস্পরিক সৌহার্দ্য, দান-সদকা এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের দিন।

ঈদের দিন ইসলামের নির্দেশিত কিছু সুন্নাত রয়েছে, যা পালন করলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায় এবং ঈদের পূর্ণ ফজিলত পাওয়া সম্ভব হয়। এই সুন্নাতগুলো আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নিজে পালন করেছেন এবং তাঁর উম্মতদের জন্য রেখে গেছেন। তাই ঈদের আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে এসব সুন্নাত পালন করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ঈদের দিনের গুরুত্ব ও ফজিলত

ঈদের দিন মুসলমানদের জন্য বিশেষ নেয়ামত এবং আনন্দের উৎসবের দিন। এটি কেবল আনন্দ-উল্লাসের জন্য নয়, বরং ইবাদত, দান-সদকা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং আল্লাহর রহমত লাভের দিন।

আরও পড়ুন : ঈদুল ফিতরের যাকাতুল ফিতর: কে, কত ও কাকে দিতে হবে?

ক. ঈদের দিনের গুরুত্ব

  • আল্লাহর পক্ষ থেকে উপহার: রমজানের এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতর আসে আল্লাহর পুরস্কার হিসেবে। ঈদুল আজহা আসে ত্যাগ ও কুরবানির শিক্ষা নিয়ে।
  • ঈদের নামাজের ফজিলত: ঈদের নামাজ জামাতে আদায় করা ওয়াজিব। এটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক।
  • ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করা: ঈদের দিন ধনী-গরিব, ছোট-বড়, সবাই একসঙ্গে মিলিত হয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে।

খ. ঈদের দিনের ফজিলত

  1. গুনাহ মাফের সুযোগ:
    • হাদিসে বলা হয়েছে, ঈদের দিন যারা খাঁটি মন থেকে ইবাদত করে, তাদের পূর্বের গুনাহ মাফ করা হয়।
  2. আল্লাহর নিকট প্রিয় দিন:
    • ঈদের দিন আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি বিশেষ দয়া ও অনুগ্রহ করেন।
  3. সদকা ও দান করার ফজিলত:
    • ঈদের দিন গরিব-দুঃখীদের সহযোগিতা করলে আল্লাহর বিশেষ রহমত লাভ করা যায়।
  4. আনন্দ ও ইবাদতের সংমিশ্রণ:
    • ইসলাম একমাত্র ধর্ম যেখানে আনন্দ ও ইবাদত একসঙ্গে পালন করা হয়।
আরও পড়ুন :  নিফাকের কুফল ও পরিণতি বর্ণনা কর

ঈদের দিনের সুন্নাতসমূহ

নবী মুহাম্মাদ (সা.) ঈদের দিনে কিছু বিশেষ আমল করতেন, যা সুন্নাত হিসেবে পরিচিত। এই সুন্নাতগুলো পালন করলে ঈদের পূর্ণ ফজিলত পাওয়া যায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়।

(ক) ঈদের নামাজের আগের সুন্নাত

১. ফজরের নামাজ আদায় করা

  • ঈদের দিনের সকাল ফজরের নামাজ দিয়ে শুরু করা সুন্নাত।
  • ফজরের নামাজ আদায়ের পর তাসবিহ-তাহলিল, কুরআন তেলাওয়াত ও দোয়া করা উত্তম।

২. তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া

  • নবীজি (সা.) ঈদের দিন খুব ভোরে জেগে উঠতেন।
  • এটি একটি বরকতময় সকাল, তাই এ সময় অধিক ইবাদত করা উচিত।

৩. গোসল করা

  • ঈদের দিন পবিত্রতার জন্য গোসল করা সুন্নাত।
  • এটি আত্মবিশ্বাস বাড়ায় ও শরীরকে সতেজ করে।

৪. মিসওয়াক করা

  • নবী (সা.) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্ব দিতেন।
  • ঈদের দিনে দাঁত পরিষ্কারের জন্য মিসওয়াক বা টুথব্রাশ করা উত্তম।

৫. সুন্দর পোশাক পরিধান করা

  • নবী (সা.) ঈদের দিনে পরিষ্কার, সুন্দর এবং উত্তম পোশাক পরতেন।
  • যদি সম্ভব হয়, নতুন পোশাক পরা ভালো।

৬. সুগন্ধি ব্যবহার করা

  • ঈদের দিন সুগন্ধি বা আতর ব্যবহার করা সুন্নাত।
  • এটি মনকে প্রফুল্ল ও সতেজ করে।

৭. খেজুর বা মিষ্টি খাওয়া (ঈদুল ফিতরের জন্য)

  • নবীজি (সা.) ঈদুল ফিতরের দিনে নামাজে যাওয়ার আগে বিজোড় সংখ্যায় (৩, ৫, ৭) খেজুর খেতেন।
  • যদি খেজুর না থাকে, তবে মিষ্টিজাতীয় কিছু খাওয়া যেতে পারে।
  • ঈদুল আজহার ক্ষেত্রে নামাজের আগে না খেয়ে কুরবানির পর মাংস খাওয়া উত্তম।
আরও পড়ুন :  ঈদের নামাজের সঠিক নিয়ম ও দোয়া

(খ) ঈদের নামাজের সময়কার সুন্নাত

১. নির্দিষ্ট মাঠে বা মসজিদে যাওয়া

  • নবী (সা.) ঈদের নামাজ ঈদগাহে আদায় করতেন।
  • যদি কোনো কারণে সম্ভব না হয়, তবে মসজিদে নামাজ পড়া যায়।

২. ঈদগাহে যাওয়ার আগে তাকবির বলা

  • ঈদুল ফিতরের জন্য: “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।”
  • ঈদুল আজহার জন্য ৯ জিলহজ ফজরের নামাজ থেকে ১৩ জিলহজ আসরের নামাজ পর্যন্ত তাকবির বলা সুন্নাত।

৩. ভিন্ন পথে ঈদগাহ যাওয়া ও আসা

  • নবী (সা.) ঈদগাহে এক পথে যেতেন এবং অন্য পথে ফিরে আসতেন।
  • এর পেছনে হেকমত হলো, বেশি মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করা, বেশি কল্যাণ লাভ করা।

(গ) ঈদের নামাজের পরের সুন্নাত

১. পরস্পর কোলাকুলি ও শুভেচ্ছা বিনিময়

  • ঈদের নামাজের পর আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সাথে কুশল বিনিময় করা উত্তম।
  • “ঈদ মোবারক” বলা যেতে পারে।

২. আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে দেখা করা

  • ঈদের দিনে আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাৎ করা, খোঁজ-খবর নেওয়া এবং সম্পর্ক দৃঢ় করা সুন্নাত।

৩. দান-সদকা করা

  • গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করা ঈদের অন্যতম বড় শিক্ষা।
  • ঈদুল ফিতরের আগে ফিতরা দেওয়া বাধ্যতামূলক।
  • ঈদুল আজহায় কুরবানির মাধ্যমে ত্যাগের শিক্ষা অর্জন করা হয়।

৪. আনন্দ-উৎসব করা (ইসলামী সীমার মধ্যে)

  • ঈদের দিনে হালাল ও শালীন আনন্দ করা সুন্নাত।
  • গান-বাজনা, অপচয়, অহংকার ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।

ঈদের সুন্নাত পালন করার ফজিলত

ঈদের দিন নবীজির (সা.) সুন্নাতগুলো পালন করলে বহু সওয়াব পাওয়া যায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব হয়। নিচে সুন্নাত পালন করার কিছু ফজিলত তুলে ধরা হলো—

আরও পড়ুন :  ঈদুল ফিতর ২০২৫: তারিখ, গুরুত্ব ও ইসলামী দৃষ্টিকোণ

১. গুনাহ মাফ হওয়ার সুযোগ

  • হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি ঈদের রাতে এবং ঈদের দিন ইবাদত করে, আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন।
  • সুন্নাত পালন করলে ছোট ছোট গুনাহগুলো মোচন হয়।

২. জান্নাতের প্রতিশ্রুতি

  • নবীজি (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরে, সে আমার সঙ্গে জান্নাতে থাকবে।”
  • ঈদের সুন্নাত পালনের মাধ্যমে জান্নাতের পথে অগ্রসর হওয়া যায়।

৩. ঈদের নামাজের সওয়াব বৃদ্ধি

  • যারা ঈদের নামাজের আগে গোসল করে, সুগন্ধি ব্যবহার করে, খেজুর খেয়ে যায়, তাকবির বলে এবং নামাজ আদায় করে—তারা আল্লাহর কাছ থেকে বিশেষ পুরস্কার লাভ করে।

৪. আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন

  • নবীজির (সা.) সুন্নাত পালন করা মানে আল্লাহর আদেশ মানা।
  • কুরআনে বলা হয়েছে:
    “তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমার (নবীজির) অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।” (সূরা আলে ইমরান: ৩১)

৫. সামাজিক সৌহার্দ্য ও ঐক্য সৃষ্টি

  • ঈদের দিন কোলাকুলি, শুভেচ্ছা বিনিময়, দান-সদকা করা সামাজিক সম্প্রীতি বাড়ায়।
  • ধনী-গরিব, ছোট-বড় সবাই একত্রে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারে।

৬. রোজার ও কুরবানির ইবাদতের পূর্ণতা লাভ

  • ঈদুল ফিতরের সুন্নাতগুলো পালন করলে রমজানের ইবাদত পূর্ণতা পায়।
  • ঈদুল আজহার সুন্নাত ও কুরবানি করলে ত্যাগের মহিমা পরিপূর্ণ হয়।

উপসংহার

ঈদ শুধু আনন্দের দিন নয়, এটি ইবাদত ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের দিন। ঈদের দিনে সুন্নাত অনুসরণ করলে দুনিয়া ও আখিরাতে অনেক উপকারিতা পাওয়া যায়। তাই আমাদের উচিত, নবীজির (সা.) সুন্নাতগুলো মেনে ঈদের দিনকে আরও বরকতময় করা। এতে ঈদের আনন্দ যেমন বাড়বে, তেমনি আল্লাহর বিশেষ রহমতও লাভ করা যাবে।