বাংলাদেশ বিষয়াবলী

বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ

৮ মে ২০২৪ বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ‘ পদ্ধতি চালু করে । ক্রলিং পেগ চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করে। প্রথম দিনেই ডলারের দাম ৭ টাকা বা ৬.৩৬% বাড়িয়ে মধ্যবর্তী এ দর নির্ধারণ করা হয় ১১৭ টাকা । বিনিময় হার-পদ্ধতি এবং ক্রলিং পেগ নিয়ে এবারের আয়োজন ।

বিনিময় হারের ইতিহাস

মানুষ যখন ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে, তখন থেকেই বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ব্যবস্থা চালু হয়। ৫০০ বছর আগে বিশ্বের প্রথম বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় বাজার চালু হয় আমস্টারডামে। ১৮৭৫ সালে বিনিময় হার নির্ধারণে স্বর্ণ মান ব্যবস্থা চালু হয় । অর্থাৎ একটি দেশের মজুতে যত সোনা রয়েছে, ঠিক ততো মুদ্রাই তারা ছাপতে পারবে। এ ব্যবস্থা ভেঙে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। ১৯৩১ সালে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড প্রথম পরিত্যাগ করে গ্রেট ব্রিটেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১-১২ জুলাই ১৯৪৪ যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটন উডস শহরের অর্থনৈতিক সম্মেলন থেকে উদ্ভব হয় ব্রেটন উডস ব্যবস্থার। এর লক্ষ্য ছিল স্থিতিশীল বিনিময় হার ব্যবস্থার প্রবর্তন । ১৫ আগস্ট ১৯৭১ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ব্রেটন উডস ব্যবস্থা বাতিল করে দেন ।

মার্কিন ডলার সোনায় রূপান্তরের ক্ষমতা বাতিল করার এ পদক্ষেপকে বলা হয় ‘গোল্ডেন উইন্ডো’ বন্ধ করা, যাকে অনেকে ‘নিক্সন শক’ বলে থাকেন। এরপর ১ মার্চ ১৯৭৩ থেকে যে যার মতো করে বিনিময় ব্যবস্থা অনুসরণ করা শুরু করে । আর এভাবেই বিশ্বে যাত্রা শুরু হয় ভাসমান বা ফ্লোটিং বিনিময় হারের । আর যারা দুর্বল, তারা বেছে নেয় স্থির বিনিময় হারকে । সেই বিনিময় হারের আরেক সংস্করণ ‘ক্রলিং পেগ’ ।

বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

স্বাধীনতার পূর্বে বাংলাদেশের মধ্যবর্তী মুদ্রা ছিল ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং। ১ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তানি রুপির পরিবর্তে বাংলাদেশি মুদ্রা হিসেবে টাকাকে জাতীয় মুদ্রা করা হয় । একই সাথে বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয় পাউন্ড প্রতি ১৮.৯৬৭৭ টাকা। তবে মধ্যবর্তী মুদ্রা হিসেবে ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিংকেই ধরে রাখে। ২৩ জানুয়ারি ১৯৭২ পাউন্ডের বিনিময় হার ডলারের সঙ্গে ভাসমান বা ফ্লোটিং করা হয়। তখন দেশে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৭.২৭০২৭ টাকা ।

স্বাধীনতার পর প্রথম ১৭ মে ১৯৭৫ টাকার বিপরীতে পাউন্ডের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৩০ টাকা । বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এটিই সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন। বিনিময় হার ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে ১১ জানুয়ারি ১৯৮৩। এ সময় পাউন্ডের পরিবর্তে মার্কিন ডলারকে মধ্যবর্তী মুদ্রা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। ২৪ মার্চ ১৯৯৪ IMF চুক্তির অনুচ্ছেদ ৮ অনুসারে চলতি হিসাব লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি টাকা রূপান্তরযোগ্য ঘোষণা করা হয়।

এক্সচেঞ্জ রেট সার্কুলার নম্বর ১ এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক ৩১ মে ২০০৩ থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ টাকা-ডলার বিনিময়হারকে সম্পূর্ণরূপে রাজারভিত্তিক (Floating Regime) করার ঘোষণা করে। সর্বশেষ ৮ মে ২০২৪ বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা-ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু করে। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর থেকে মুদ্রা ভাসমান করার পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৮৬ বার টাকার অবমূল্যায়ন এবং ২ বার অতিমূল্যায়ন করা হয় ।

মুদ্রা বিনিময়ের পদ্ধতি

সাধারণত ডলার বা অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে দুই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়— হার্ড পেগ (Hard Peg) এবং সফট পেগ (Soft Peg)।

  • হার্ড পেগ পদ্ধতিতে সরকার বৈদেশিক মুদ্রার মান নিজে ঠিক করে দেয় ৷
  • সফট পেগ পদ্ধতিতে বাজারের ওপরে মুদ্রার মান ছেড়ে দেওয়া হয় । তবে সরকার বা ব্যাংক চাইলে সফট পেগ পদ্ধতিতে ডলারের একটি সম্ভাব্য দাম ধরে দিতে পারে ।
  • এছাড়া অনেক দেশে ডলারের মান সম্পূর্ণ বাজারমুখী রাখতে এবং হস্তক্ষেপবিহীন মান নির্ধারণে ভাসমান বিনিময় হার ব্যবহার করা হয় ৷

ক্রলিং পেগ : ইংরেজি শব্দ ‘ক্রলিং’ (Crawling)-এর বাংলা অর্থ ‘হামাগুড়ি দেওয়া’, আর ‘পেগ’ (Peg) শব্দটির নানা অর্থ হলেও অর্থনীতির মুদ্রা ব্যবস্থায় এর অর্থ ‘নির্দিষ্ট সীমা’ । অর্থাৎ হামাগুড়ি দেওয়ার সুযোগ থাকবে, তবে নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে। এ দৃষ্টিতে বলা যায়, ‘ক্রলিং পেগ হলো বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি, যেখানে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বিদেশী মুদ্রার দাম ওঠানামা করার অনুমতি দেওয়া হয়।

নিয়ন্ত্রিত বা বেঁধে দেওয়া বিনিময় হার থেকে উন্মুক্ত বাজার দরে প্রবেশের আগের ধাপটিই মূলত ‘ক্রলিং পেগ’ । অর্থনীতিতে নিজ দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন প্রকট আকার ধারণ করলে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার মান নির্ণয় করা হয়। কোনো দেশে ডলারের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মূল্য কত হবে সেটির একটি সীমা ঠিক করে দেওয়া

ক্রলিং পেগের কাজ : মুদ্রার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মুদ্রা কর্তৃপক্ষ ক্রলিং পেগ গ্রহণ করে, প্রধানত যখন মুদ্রাস্ফীতি বা অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে অবমূল্যায়নের হুমকি দেখা দেয় । কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমন্বিত পদ্ধতিতে মুদ্রা বিক্রি ও ক্রয় করে হস্তক্ষেপ করে, সমমূল্যকে ব্যান্ডে থাকার অনুমতি দেয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button