টমাস হবস

টমাস হবস: এক বিশাল দার্শনিকের পরিচিতি

টমাস হবস: এক বিশাল দার্শনিকের পরিচিতি

টমাস হবস (Thomas Hobbes) ১৬তম শতাব্দীর ইংরেজী দার্শনিক ছিলেন, যিনি রাজনীতি, মনোবিজ্ঞান এবং সমাজ তত্ত্বে গভীর অবদান রেখেছেন। তার নাম আজও আলোচনা হয়, বিশেষত তার বিখ্যাত রচনা লেভিয়াথান (Leviathan) এর জন্য। হবসের তত্ত্বগুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল “মানব প্রকৃতির সম্পর্ক” এবং “রাজনৈতিক শাসনের মৌলিকতা”।

হবসের জীবনী

টমাস হবস ৫ এপ্রিল, ১৫৮৮ সালে ইংল্যান্ডের ওয়েস্টারশায়ারে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ সে সময়ে ইংল্যান্ড গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন ছিল। হবসের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন ছিল তেজস্বী এবং তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষিত হন। সেখানে তিনি প্রাচীন গ্রিক, ল্যাটিন এবং দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।

তার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা লেভিয়াথান (Leviathan), যা ১৬৫১ সালে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে তিনি সমাজের আদর্শ অবস্থার আলোচনা করেছেন, যা রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে পরিচিত।

হবসের দর্শন

হবসের দর্শন মূলত মানব প্রকৃতি এবং সামাজিক সংগঠন নিয়ে ছিল। তার মতে, মানবজাতি প্রাকৃতিক অবস্থায় অস্থির এবং বিশৃঙ্খল। তার তত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষ তার স্বার্থপরতা ও শক্তির জন্য প্রাকৃতিক অবস্থায় একে অপরের প্রতি প্রতিযোগিতা করে এবং এভাবে সৃষ্টি হয় “সর্বগ্রাসী যুদ্ধ”।

আরও পড়ুন :  ফিনটেক : আর্থিক খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার

হবসের মতে, মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব কেবলমাত্র একটি শক্তিশালী শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে। তিনি একে “লেভিয়াথান” বলে উল্লেখ করেন, যা প্রাকৃতিক অবস্থার পরিণতি থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়। লেভিয়াথান ধারণাটি এক প্রকার অত্যাচারী রাষ্ট্র বা শাসককে প্রতিস্থাপন করে, যা জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম।

১. প্রাকৃতিক অবস্থা এবং সামাজিক চুক্তি

হবসের মতে, মানুষের প্রাকৃতিক অবস্থা ছিল বিশৃঙ্খল এবং নিরবিচ্ছিন্ন যুদ্ধের। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মানুষ একটি সামাজিক চুক্তি স্বাক্ষর করে, যেখানে তারা তাদের কিছু স্বাধীনতা relinquish করে একটি শক্তিশালী শাসককে ক্ষমতা দেয়। এর মাধ্যমে সভ্য সমাজের সূচনা হয়।

২. রাজনৈতিক শাসনের প্রকৃতি

হবসের মতে, সুষ্ঠু রাজনৈতিক শাসন শুধুমাত্র শক্তিশালী শাসকের অধীনে সম্ভব। তার মতে, শাসকের হাতে অগণিত ক্ষমতা থাকা উচিত, যাতে সে জনগণের স্বার্থে নিরাপত্তা প্রদান করতে পারে।

হবসের মূল তত্ত্ব

নীচে হবসের দর্শনের প্রধান কয়েকটি ধারণার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো:

ধারণাবর্ণনা
প্রাকৃতিক অবস্থাহবসের মতে, মানুষ প্রাকৃতিক অবস্থায় একে অপরের প্রতি শত্রুতা ও প্রতিযোগিতার মনোভাব পোষণ করে।
সামাজিক চুক্তিএই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ তাদের কিছু স্বাধীনতা relinquish করে এবং একটি শক্তিশালী শাসককে ক্ষমতা দেয়।
লেভিয়াথানএটি হবসের একটি জনপ্রিয় তত্ত্ব, যেখানে তিনি একটি শক্তিশালী শাসক বা রাষ্ট্রকে মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের একমাত্র উপায় হিসেবে উল্লেখ করেন।
প্রাকৃতিক অধিকারহবসের মতে, মানুষের কিছু মৌলিক অধিকার রয়েছে, কিন্তু সেগুলো সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে কিছুটা সীমাবদ্ধ করা হয়।
আরও পড়ুন :  স্বল্পোন্নত দেশ এখন ৪৫টি

হবসের প্রভাব

টমাস হবসের দর্শন রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন আনে। তার তত্ত্বগুলি শুধু ইংল্যান্ড নয়, পুরো ইউরোপে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। তার চিন্তাধারা পরবর্তীতে জন লক, জ্যঁ-জাক রুশো, এবং কার্ল মার্কসের মতো দার্শনিকদের কাজের ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়।

হবসের রাজনৈতিক দর্শন ও তার প্রভাব

তত্ত্বপ্রভাবিত ব্যক্তিত্বযুগ
প্রাকৃতিক অবস্থাজন লক, জ্যঁ-জাক রুশোআধুনিক যুগ
সামাজিক চুক্তিরুশো, লকআধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রভাব
লেভিয়াথানম্যাকিয়াভেলি, কার্ল মার্কসরাষ্ট্রীয় শক্তির ধারণা

হবসের সমালোচনা

যদিও টমাস হবসকে একজন মহান দার্শনিক হিসেবে মানা হয়, তবে তার তত্ত্বগুলির বেশ কিছু সমালোচনা রয়েছে। বিশেষত তার একনায়ক শাসনের ধারণা আজও বিতর্কিত। অনেক দার্শনিক যেমন জন লক, তারা হবসের দর্শনকে পরিবর্তন করে, যেখানে জনগণের অধিকার এবং স্বাতন্ত্র্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন :  Current Affairs February 2023 PDF কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ফেব্রুয়ারি ২০২৩ পিডিএফ

অন্যদিকে, ২০ শতকের রাজনৈতিক তত্ত্ববিদেরা হবসের শাসন ব্যবস্থার ভিত্তিতে গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর জোর দেন। তাছাড়া, তার মানব প্রকৃতির ব্যাখ্যারও সমালোচনা করা হয়েছে, যেখানে তিনি মানুষের প্রকৃতিকে কেবলমাত্র স্বার্থপর ও অস্থির হিসেবে চিত্রিত করেছেন।

উপসংহার

টমাস হবসের দর্শন রাজনীতি ও সমাজতত্ত্বের ক্ষেত্রে এক অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছে। তার তত্ত্বগুলির মধ্যে বিশেষভাবে সমাজের আদর্শ অবস্থা, রাজনৈতিক শক্তি এবং শাসক ক্ষমতার ধারণাগুলি আজও বর্তমান আধুনিক রাজনীতিতে প্রতিফলিত হয়। যদিও তার দর্শনে কিছু সমালোচনা রয়েছে, তবুও তার চিন্তাভাবনা সমকালীন রাজনীতি এবং সমাজ তত্ত্বের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা তৈরি করেছে।

তার রচনা লেভিয়াথান আধুনিক রাষ্ট্রীয় চিন্তাধারার পক্ষে একটি দিকনির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হয় এবং তার আদর্শ রাষ্ট্রশক্তির প্রচার এখনও অনেক দার্শনিকদের প্রভাবিত করছে।