রসায়ন হল পদার্থের গঠন, ধর্ম ও পরিবর্তন সংক্রান্ত বিজ্ঞান। আমাদের চারপাশের প্রতিটি বস্তু এবং প্রতিটি পরিবর্তনই কোনো না কোনোভাবে রসায়নের সাথে জড়িত। এই বিজ্ঞান শুধু গবেষণাগারেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ।
প্রাচীনকাল থেকে মানুষ রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন নতুন বস্তু তৈরি করে আসছে। আগুন আবিষ্কার থেকে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিকাশ পর্যন্ত, প্রতিটি ক্ষেত্রেই রসায়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
এই আলোচনায় আমরা রসায়নের পরিধি ও ক্ষেত্রসমূহ বিশদভাবে অন্বেষণ করব এবং দেখব কীভাবে এটি আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে ও উন্নত করে তুলেছে।
রসায়নের পরিধি বা ক্ষেত্রসমূহ (The Scopes of chemistry) :
যেখানে পদার্থ আছে সেখানেই রসায়ন আছে। বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাসীয় পদার্থ থাকে। বায়ুমণ্ডলে কিছু কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন অনবরত ঘটছে। আমরা যে মাটির উপরে বসবাস করছি সে মাটিতেও প্রতি মুহূর্তে ঘটে যাচ্ছে অসংখ্য পরিবর্তন। শুধু বর্তমান সময় কেন, সুদূর অতীতেও এই পরিবর্তন ঘটেছে।
যখন এ পৃথিবীর প্রথম জন্ম হলাে তখন পৃথিবী এমন ছিল না, পৃথিবী ছিল খুবই উত্তপ্ত। সেখানে কোনাে বাতাস ছিল না। ছিল না কোনাে জীবের অস্তিত্ব। কোটি কোটি বছর ধরে ঘটেছে। ও অসংখ্য রাসায়নিক পরিবর্তন। সৃষ্টি হয়েছে বায়ুমণ্ডল, সৃষ্টি হয়েছে পানি, সৃষ্টি হয়েছে হাজারাে রকমের পদার্থ। এই সবকিছু মিলে পৃথিবীকে জীবজগতের জন্য বসবাস উপযােগী করেছে।
মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদ তা ক্ষুদ্র অণুজীব (যেমন- ব্যাকটেরিয়া, অ্যামিবা ইত্যাদি) হােক আর বৃহৎ উদ্ভিদ বা প্রাণীই হােক সকলের দেহই বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি। প্রতিটি দেহ হলাে এক একটি বড় রাসায়নিক কারখানা। এখানে প্রতি মুহূর্তেই ঘটে চলেছে অসংখ্য রাসায়নিক বিক্রিয়া। আর সে জন্যই আমরা বেঁচে আছি।
আবার, সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে তৈরি করে চলেছে আমাদের ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সামগ্রী। যেমন- তুমি যে জামাকাপড় পরছ, যে পেস্ট দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করছ, যে চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছ বা ত্বকে যে কসমেটিকস ব্যবহার করছ তা সবই রসায়নের অবদান।
এছাড়া আমরা পরিষ্কারের কাজে সাবান, টয়লেট ক্লিনার, জীবন রক্ষার জন্য ব্যবহার করছি বিভিন্ন ধরনের ওষুধসামগ্রী। আমাদের খাদ্য চাহিদাকে পূরণ করার জন্য ফসলের ক্ষেতে ব্যবহার করছি সার ও কীটনাশক। যানবাহনে ব্যবহার করছি পেট্রল, ডিজেলএসবই শিল্প ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে তৈরি করা হচ্ছে।
সত্যি কথা বলতে কি রসায়নের পরিধি এ ক্ষুদ্র পরিসরে লিখে শেষ করা যাবে না। 1.02 টেবিলের সাহায্যে রসায়নের কিছু অতি প্রয়ােজনীয় ক্ষেত্রের উদাহরণ দেওয়া হলাে
রসায়নের কিছু ক্ষেত্র
বস্তু/পদার্থ | উপাদান | উৎস ও রাসায়নিক পরিবর্তন |
বায়ু | প্রধানত অক্সিজেন | আমরা শ্বাস নেওয়ার সময় যে বায়ু গ্রহণ করি সেই বায়ুর অক্সিজেন শরীরের ভেতরে খাদ্য উপাদানের সাথে বিক্রিয়া করে শক্তি উৎপাদন করে। |
খাবারের পানি | পানিসহ বিভিন্ন খনিজ লবণ | পানি আমাদের শরীরে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। এটি শরীরের মধ্যে বিভিন্ন পদার্থের দ্রাবক হিসেবেও কাজ করে। জীবের শরীরের বেশির ভাগই পানি। শরীরের বিষাক্ত পদার্থ এ পানিতে দ্রবীভূত হয়ে প্রস্রাব ও ঘামের সাহায্যে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। খাবারের পানিতে পানি ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের খনিজ লবণ যেমন- ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি ধাতুর লবণ থাকে, যা আমাদের শরীরের জন্য বিশেষ উপকারী। |
সার | নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম | উল্লিখিত মৌলগুলাে উদ্ভিদের জন্য খুব প্রয়ােজনীয় উপাদান। বিভিন্ন সারে এসব মৌলের যৌগ থাকে। তাই বিভিন্ন ধরনের সার উদ্ভিদের প্রয়ােজনীয় পুষ্টি প্রদান করে। ফলে ফসলের উৎপাদন ভালাে হয়। |
কাগজ | সেলুলােজ | কাগজের আবিষ্কার মানব সভ্যতার এক অনন্য অবদান। বাঁশ, আখের ছােবড়া ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে সেলুলােজ থাকে। কাগজ তৈরির কারখানায় এই সমস্ত বস্তুকে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে কাগজ তৈরি করা হয়। |
MCQ (বহুনির্বাচনী প্রশ্ন ও উত্তর)
- রসায়ন কিসের অধ্যয়ন?
a) শুধুমাত্র গ্যাসীয় পদার্থের
b) শুধুমাত্র কঠিন পদার্থের
c) পদার্থ ও তাদের পরিবর্তনের
d) শুধুমাত্র জীবজগতেরউত্তর: c) পদার্থ ও তাদের পরিবর্তনের - পৃথিবীর শুরুর দিকে এর অবস্থা কেমন ছিল?
a) শীতল ও বাতাসময়
b) খুবই উত্তপ্ত এবং অক্সিজেনবিহীন
c) মানব বসবাসের উপযোগী
d) বরফে আবৃতউত্তর: b) খুবই উত্তপ্ত এবং অক্সিজেনবিহীন - জীবজগতের প্রতিটি দেহ আসলে কী?
a) এক ধরণের রাসায়নিক কারখানা
b) একটি ধাতব বস্তু
c) কেবলমাত্র জৈবিক গঠনের বস্তু
d) পরিবর্তনশীল নয়উত্তর: a) এক ধরণের রাসায়নিক কারখানা - বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন কীভাবে তৈরি হয়েছিল?
a) আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে
b) রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে
c) সূর্যালোকের কারণে
d) কোনো পরিবর্তন ছাড়াই স্বাভাবিকভাবেউত্তর: b) রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে - আমাদের শরীরে অক্সিজেন কী কাজে লাগে?
a) খাবারের স্বাদ বৃদ্ধিতে
b) শক্তি উৎপাদনে
c) শরীরের আর্দ্রতা ধরে রাখতে
d) কেবলমাত্র শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্যউত্তর: b) শক্তি উৎপাদনে - জীবের শরীরের কত শতাংশ পানি থাকে?
a) ১০-২০%
b) ৩০-৪০%
c) ৫০-৬০%
d) ৭০-৮০%উত্তর: d) ৭০-৮০% - শরীরের বিষাক্ত পদার্থ কীভাবে বের হয়?
a) খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে
b) প্রস্রাব ও ঘামের মাধ্যমে
c) নিঃশ্বাসের মাধ্যমে
d) শরীরের কোনো পরিবর্তন ছাড়াইউত্তর: b) প্রস্রাব ও ঘামের মাধ্যমে - বিভিন্ন রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে কী তৈরি হয়?
a) শুধু গ্যাস
b) নতুন নতুন বস্তু ও উপাদান
c) শুধুমাত্র কঠিন পদার্থ
d) কেবলমাত্র জীবদেহউত্তর: b) নতুন নতুন বস্তু ও উপাদান - কোন বস্তুটি রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি হয়?
a) বালু
b) কাগজ
c) পাথর
d) বায়ুউত্তর: b) কাগজ - সারের মধ্যে কোন উপাদান থাকে না?
a) নাইট্রোজেন
b) অক্সিজেন
c) কার্বন
d) সিলিকনউত্তর: d) সিলিকন - পানি শরীরে কীভাবে কাজ করে?
a) কেবল তৃষ্ণা নিবারণ করে
b) বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে
c) শুধুমাত্র পরিশোধক হিসেবে কাজ করে
d) খাদ্যের মূল উৎস হিসেবেউত্তর: b) বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে - কোন পদার্থটি শরীরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ লবণ?
a) সেলুলোজ
b) ক্যালসিয়াম
c) নাইট্রোজেন
d) হাইড্রোজেনউত্তর: b) ক্যালসিয়াম - আমাদের ব্যবহৃত জামাকাপড় কী থেকে তৈরি?
a) খনিজ পদার্থ
b) রাসায়নিক পদার্থ
c) শুধু প্রাকৃতিক উপাদান
d) শুধুমাত্র উদ্ভিদের অংশউত্তর: b) রাসায়নিক পদার্থ - রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি জিনিস কোনটি?
a) বালু
b) কাঁচ
c) কাঠ
d) লোহাউত্তর: b) কাঁচ - বায়ুমণ্ডলের প্রধান উপাদান কোনটি?
a) অক্সিজেন
b) হাইড্রোজেন
c) নাইট্রোজেন
d) কার্বন ডাই অক্সাইডউত্তর: c) নাইট্রোজেন - শরীরে শক্তি উৎপাদনে কোন গ্যাস গুরুত্বপূর্ণ?
a) নাইট্রোজেন
b) অক্সিজেন
c) হাইড্রোজেন
d) হিলিয়ামউত্তর: b) অক্সিজেন - কোন পদার্থ জীবদেহের প্রধান উপাদান?
a) লোহা
b) প্লাস্টিক
c) প্রোটিন
d) কাচউত্তর: c) প্রোটিন - রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে কী সৃষ্টি হয়?
a) কেবল গ্যাস
b) নতুন পদার্থ
c) শুধুমাত্র কঠিন বস্তু
d) কোনো পরিবর্তন হয় নাউত্তর: b) নতুন পদার্থ - খাদ্য উৎপাদনে রসায়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কী?
a) মাটির রাসায়নিক গঠন পরিবর্তন করা
b) সারের মাধ্যমে গাছের পুষ্টি বৃদ্ধি
c) কীটনাশকের মাধ্যমে ফসল রক্ষা করা
d) উপরের সবগুলোউত্তর: d) উপরের সবগুলো - কোন পদার্থটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে রাসায়নগত পরিবর্তনের ফলে তৈরি হয়?
a) চিনি
b) পানি
c) বাতাস
d) পাথরউত্তর: a) চিনি
উপসংহার
রসায়নের পরিধি এতই বিস্তৃত যে একে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা কঠিন। আমাদের চারপাশের প্রতিটি বস্তু ও প্রতিটি পরিবর্তনের মূলেই রসায়নের অবদান রয়েছে। জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে—শরীরের জৈবিক প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে খাদ্য উৎপাদন, চিকিৎসা, পোশাক, নির্মাণ, জ্বালানি এবং বিভিন্ন প্রযুক্তির বিকাশ পর্যন্ত—রসায়ন অপরিহার্য।
প্রাকৃতিক পরিবর্তন থেকে শুরু করে মানবসৃষ্ট আবিষ্কার পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাসায়নিক বিক্রিয়ার ভূমিকা অনস্বীকার্য। রসায়নের সঠিক প্রয়োগ আমাদের জীবনকে উন্নত, নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করেছে। তবে এর অপব্যবহার যেমন দূষণ, ক্ষতিকর রাসায়নিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদির দিকে আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে।
অতএব, রসায়ন শুধু বিজ্ঞান নয়; এটি মানব সভ্যতার অগ্রগতির অন্যতম মূল চাবিকাঠি। এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে আমরা একটি উন্নত ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে পারি।