রোজা রাখার নিয়ত ও ইফতারের দোয়া

রমজান মাসে মুসলমানদের জন্য রোজা পালন করা ফরজ। রোজা রাখার জন্য সঠিক নিয়ত ও ইফতারের দোয়া জানা গুরুত্বপূর্ণ। এই লেখায় আমরা রোজার নিয়ত, ইফতারের দোয়া, বাংলা অর্থসহ আরবি উচ্চারণ, এবং রোজা সম্পর্কিত আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আলোচনা করব।
রোজা রাখার নিয়ত
রোজার নিয়ত (নিয়াহ) হলো মনের ইচ্ছা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রোজা রাখার সংকল্প। রোজা শুরুর আগে নিয়ত করতে হয়, যা সাধারণত সাহরির সময় করা হয়।
রোজার নিয়তের আরবি, বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ
আরবি | বাংলা উচ্চারণ | বাংলা অর্থ |
---|---|---|
نَوَيْتُ أَنْ أَصُومَ غَدًا لِلَّهِ تَعَالَى | নাওয়াইতু আন আসূমা গাদান লিল্লাহি তা’আলা | আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আগামীকাল রোজা রাখার নিয়ত করলাম। |
রোজার নিয়ত মুখে পড়া জরুরি নয়, তবে মনে মনে সংকল্প করলেই চলে। তবুও অনেকে নিয়তটি পড়তে পছন্দ করেন।
ইফতারের দোয়া
সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতারের সময় দোয়া পড়া সুন্নত। হাদিসে এসেছে, ইফতারের সময় দোয়া কবুল হয়। তাই ইফতার করার সময় বিশেষভাবে এই দোয়া পড়া উচিত।
আরো পড়ুন : সালাত: ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত
ইফতারের দোয়ার আরবি, বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ
আরবি | বাংলা উচ্চারণ | বাংলা অর্থ |
---|---|---|
اللَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَبِكَ آمَنْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ وَعَلَى رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ | আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু, ওয়া বিকা আমানতু, ওয়া আলাইকা তাওয়াক্কালতু, ওয়া আলা রিজকিকা আফতারতু | হে আল্লাহ! আমি তোমার সন্তুষ্টির জন্য রোজা রেখেছি, তোমার উপর ঈমান এনেছি, তোমার ওপর ভরসা করেছি এবং তোমার দেয়া রিজিক দিয়ে ইফতার করছি। |
রোজার গুরুত্ব ও উপকারিতা
রোজা শুধুমাত্র ইসলামিক বিধান নয়, এটি মানুষের আত্মশুদ্ধি ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রোজার উপকারিতা
- আত্মিক উপকারিতা:
- তাকওয়া বৃদ্ধি পায়
- আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয়
- গুনাহ মাফ হয়
- আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়
- শারীরিক উপকারিতা:
- পরিপাকতন্ত্র বিশ্রাম পায়
- শরীরের টক্সিন দূর হয়
- ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়
- মানসিক উপকারিতা:
- ধৈর্য ও সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়
- মানসিক প্রশান্তি আসে
- স্ট্রেস কমে যায়
- সামাজিক উপকারিতা:
- দরিদ্রদের কষ্ট বোঝার সুযোগ হয়
- দান-খয়রাত করার মানসিকতা গড়ে ওঠে
- সমাজে সহমর্মিতা বৃদ্ধি পায়
- একতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি পায়
রোজা রাখার কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম
- সাহরি খাওয়া: সাহরি খাওয়া সুন্নত এবং বরকতময়। সাহরি খেলে রোজা রাখার শক্তি পাওয়া যায় এবং এটি বরকতের কারণ।
- নিয়ত করা: রোজার আগে নিয়ত করা জরুরি। নিয়ত ছাড়া কোনো ইবাদত গ্রহণযোগ্য নয়।
- হারাম থেকে বিরত থাকা: মিথ্যা বলা, গিবত করা, ঝগড়া করা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে।
- ইফতার দ্রুত করা: সূর্যাস্তের পর দেরি না করে ইফতার করা সুন্নত।
- গোপন পাপ থেকে বেঁচে থাকা: রোজার মূল উদ্দেশ্য হলো আত্মশুদ্ধি, তাই লোভ-লালসা থেকে মুক্ত থাকা জরুরি।
যেসব কারণে রোজা ভেঙে যায়
কারণ | ব্যাখ্যা |
---|---|
ইচ্ছাকৃতভাবে খাওয়া বা পান করা | যদি কেউ রোজার মধ্যে ভুলবশত না খেয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু খায়, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে। |
মাস্টারবেশন বা যৌন সম্পর্ক | এতে রোজা ভেঙে যায় এবং কাজা করতে হয়। |
ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা | কেউ যদি নিজ ইচ্ছায় বমি করে, তাহলে রোজা ভেঙে যাবে। |
মাসিক বা প্রসবজনিত রক্তপাত | নারীদের মাসিক চলাকালীন রোজা রাখা নিষিদ্ধ। |
রোজা ভাঙলে করণীয়
যদি কোনো কারণে রোজা ভেঙে যায়, তবে সেই দিনের রোজা কাজা করতে হবে। তবে যদি ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ভাঙা হয়, তাহলে কাফফারা আদায় করতে হবে।
কাফফারার নিয়ম
- দুই মাস একটানা রোজা রাখতে হবে।
- যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে ৬০ জন গরিব মানুষকে খাওয়াতে হবে।
রোজা সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
1. রোজার জন্য নিয়ত করতেই হবে কি?
উত্তর: হ্যাঁ, রোজার জন্য নিয়ত করা আবশ্যক। কারণ, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
“নিশ্চয়ই সমস্ত আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।” (সহিহ বুখারি: ১)
তবে নিয়ত মনে করলেই যথেষ্ট, আলাদাভাবে মুখে উচ্চারণ করা জরুরি নয়।
2. ভুলবশত খেলে রোজা ভাঙবে কি?
উত্তর: না, যদি কেউ ভুলবশত খেয়ে ফেলে বা পানি পান করে, তাহলে তার রোজা নষ্ট হবে না। রাসুল (সা.) বলেছেন—
“যদি কেউ ভুলক্রমে রোজা অবস্থায় খেয়ে ফেলে, তবে সে রোজা পূর্ণ করুক। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য রিজিক।” (সহিহ মুসলিম: ১১৫৫)
তবে ইচ্ছাকৃতভাবে খেলে রোজা ভেঙে যাবে এবং তা কাযা করতে হবে।
3. মাসিক চলাকালীন নারীরা কি রোজা রাখতে পারবেন?
উত্তর: না, নারীদের মাসিক চলাকালীন রোজা রাখা নিষিদ্ধ। হাদিসে এসেছে—
“আমাদের (নারীদের) জন্য হায়েজ (মাসিক) অবস্থায় নামাজ পড়া ও রোজা রাখা হারাম করা হয়েছে।” (সহিহ বুখারি: ১৯৫১)
তবে পরে ওই দিনের রোজা কাজা করে নিতে হবে।
4. রোজা রাখলে কি ওজন কমে যায়?
উত্তর: হ্যাঁ, রোজা রাখলে ওজন কমতে পারে, তবে এটি নির্ভর করে খাদ্যাভ্যাসের উপর। যদি কেউ ইফতার ও সেহরিতে অতিরিক্ত ও অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করে, তাহলে ওজন কমার পরিবর্তে বেড়েও যেতে পারে। তবে স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ ও পর্যাপ্ত পানি পান করলে রোজা দেহের বিপাকক্রিয়া উন্নত করে ওজন কমাতে সহায়তা করে।
5. ইফতারের সময় কী দোয়া পড়তে হয়?
উত্তর: ইফতারের সময় সুন্নত দোয়া হলো—
📜 اللَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَبِكَ آمَنْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ وَعَلَى رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ
🔹 উচ্চারণ: “আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া বিকা আমানতু ওয়া আলাইকা তাওয়াক্কালতু ওয়া আলা রিজকিকা আফতারতু।”
🔹 অর্থ: “হে আল্লাহ! আমি তোমারই সন্তুষ্টির জন্য রোজা রেখেছি, তোমার উপর ঈমান এনেছি, তোমার উপর ভরসা করেছি এবং তোমারই দেওয়া রিজিক দ্বারা ইফতার করছি।”
6. রোজার সময় ওষুধ খাওয়া যাবে কি?
উত্তর: সাধারণত রোজার সময় মুখে বা নাক দিয়ে কোনো ধরনের খাবার, পানি বা ওষুধ প্রবেশ করালে রোজা ভেঙে যায়। তবে যদি কেউ অসুস্থ হয় এবং রোজা রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়, তাহলে পরে সেই রোজাটি কাযা করে নিতে হবে।
7. রোজা ভেঙে গেলে কী করতে হবে?
উত্তর: রোজা ভেঙে গেলে পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে করণীয় ঠিক হবে—
- ভুলবশত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ভেঙে গেলে: শুধু কাযা করতে হবে।
- ইচ্ছাকৃতভাবে ভেঙে ফেললে: কাযা ছাড়াও কাফফারা দিতে হবে। কাফফারা হিসেবে পরপর ৬০ দিন রোজা রাখতে হবে অথবা ৬০ জন দরিদ্রকে খাওয়াতে হবে।
8. রোজা অবস্থায় দাঁত ব্রাশ করা যাবে কি?
উত্তর: হ্যাঁ, রোজা অবস্থায় দাঁত ব্রাশ করা যাবে, তবে সাবধান থাকতে হবে যাতে টুথপেস্ট বা পানি গিলে না ফেলা হয়। রাসুল (সা.) মেসওয়াক ব্যবহার করতেন, যা দাঁত পরিষ্কারের একটি সুন্নত পদ্ধতি।
9. সাহরি না খেলে কি রোজা হবে?
উত্তর: হ্যাঁ, সাহরি না খেলেও রোজা হবে। তবে সাহরি খাওয়া সুন্নত এবং এতে বরকত রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন—
“সাহরির খাবার খাও, কারণ এতে বরকত রয়েছে।” (সহিহ বুখারি: ১৯২৩)
10. যাত্রাপথে রোজা রাখা বাধ্যতামূলক কি?
উত্তর: না, যদি কেউ সফরে থাকে এবং রোজা রাখা কষ্টকর হয়, তবে সে রোজা না রেখে পরে তা কাযা করতে পারে। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন—
“আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অসুস্থ অথবা সফরে থাকবে, সে যেন অন্য কোনো দিনে রোজা পূরণ করে নেয়।” (সুরা বাকারা: ১৮৫)
11. রোজা রেখে ইনহেলার ব্যবহার করা যাবে কি?
উত্তর: না, ইনহেলার ব্যবহারের মাধ্যমে সরাসরি ওষুধ ফুসফুসে প্রবেশ করে, যা রোজার নিয়ম অনুযায়ী নিষিদ্ধ। তবে যদি শ্বাসকষ্ট গুরুতর হয়, তাহলে পরে রোজাটি কাযা করতে হবে।
12. রোজা রেখে রক্তদান করলে রোজা ভেঙে যাবে কি?
উত্তর: না, রক্তদান করলে রোজা ভাঙবে না। তবে বেশি রক্ত দিলে শরীর দুর্বল হয়ে যেতে পারে, তাই এটি এড়ানো ভালো।
13. কোন কোন কারণে রোজার কাযা ও কাফফারা দুটোই দিতে হয়?
উত্তর: ইচ্ছাকৃতভাবে খাওয়া-দাওয়া, পান করা বা সহবাস করলে রোজা ভেঙে যায় এবং এতে শুধু কাযা নয়, কাফফারাও দিতে হয়। কাফফারা হিসেবে ৬০ দিন একটানা রোজা রাখতে হবে, অন্যথায় ৬০ জন দরিদ্রকে খাওয়াতে হবে।
14. রোজার ফজিলত সম্পর্কে হাদিস কী বলে?
উত্তর: রোজা সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে—
📜 রাসুল (সা.) বলেছেন— “যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখে, তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।” (সহিহ বুখারি: ৩৮)
এছাড়া, রোজাদারদের জন্য জান্নাতের একটি বিশেষ দরজা থাকবে, যার নাম রাইয়ান। এটি শুধুমাত্র রোজাদারদের জন্য সংরক্ষিত, অন্য কেউ এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (সহিহ বুখারি: ১৮৯৬)
উপসংহার
রোজা আত্মশুদ্ধির অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় বিধান নয়, বরং আত্মনিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপায়। সঠিক নিয়ম মেনে রোজা রাখলে মানুষ আধ্যাত্মিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে উপকৃত হয়। তাই প্রতিটি রোজাদারের উচিত নিয়ম মেনে সাহরি খাওয়া, নিয়ত করা এবং ইফতারের সময় দোয়া পড়া। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রোজার সঠিক শিক্ষা গ্রহণের তাওফিক দান করুন। আমিন।