ধর্ম

হজ: ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ

হজ ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি মুসলমানদের জন্য ফরজ একটি ইবাদত, যা শারীরিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমানকে জীবনে অন্তত একবার সম্পন্ন করতে হয়। হজ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ‘ইচ্ছা’ বা ‘গমন’, তবে ইসলামী পরিভাষায় এটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সম্পাদিত একটি ধর্মীয় বিধান।

হজ পালনের মাধ্যমে মুসলমানরা আত্মশুদ্ধি লাভ করেন এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেন। এটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষ একই পোশাকে, একই নিয়মে, একই স্থানে আল্লাহর আরাধনা করে। এটি ধৈর্য, ত্যাগ, সাম্য ও একত্ববাদের প্রতীক।

হজ পালনের শর্তাবলী

হজ সম্পাদনের জন্য নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করা আবশ্যক। এগুলো হলো:

  1. ইসলাম গ্রহণ করা: হজ শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য ফরজ।
  2. সামর্থ্য থাকা: হজ পালনের জন্য শারীরিক ও আর্থিক সামর্থ্য থাকা আবশ্যক।
  3. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া: শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক ও মানসিকভাবে সুস্থ ব্যক্তির ওপর হজ ফরজ।
  4. নির্দিষ্ট সময়: হজ শুধুমাত্র ইসলামিক বর্ষপঞ্জির ৮-১২ জিলহজ তারিখে সম্পন্ন করা হয়।
  5. স্বাধীনতা: পরাধীন বা অন্যের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তি হজ সম্পন্ন করতে পারবে না।
  6. নারীদের জন্য মাহরাম: কোনো নারীর জন্য হজে যাওয়ার ক্ষেত্রে মাহরাম থাকা বাধ্যতামূলক।

হজের প্রধান কার্যক্রম

হজ পালনের সময় নির্দিষ্ট কিছু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হয়। প্রতিটি ধাপের আলাদা তাৎপর্য রয়েছে:

  1. ইহরাম ধারণ: হজের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মে বিশুদ্ধ হয়ে বিশেষ সেলাইবিহীন কাপড় (পুরুষদের জন্য) পরিধান করতে হয়। নারীদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো পোশাকের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও শালীন পোশাক পরিধান করতে হয়। ইহরামের সময় কিছু বিষয় নিষিদ্ধ থাকে, যেমন চুল কাটা, সুগন্ধি ব্যবহার, ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি।
  2. তাওয়াফ: কাবা শরীফকে সাতবার ঘড়ির বিপরীত দিক থেকে প্রদক্ষিণ করা হয়, যা হজের অন্যতম প্রধান রীতি। এটি আল্লাহর ঘরের প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসার প্রতীক।
  3. সাই: সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাতবার দৌড়ানোর মাধ্যমে হাজিরা হজরত হাজেরা (আ.)-এর ত্যাগ ও ধৈর্যের স্মরণ করেন। এটি আমাদের জীবনের সংকট মোকাবিলায় ধৈর্য ও আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখার শিক্ষা দেয়।
  4. আরাফার ময়দানে অবস্থান: এটি হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ৯ জিলহজ তারিখে হাজিরা আরাফার ময়দানে অবস্থান করেন এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। এটি আত্মশুদ্ধির সর্বোচ্চ পর্যায়, যেখানে হাজিরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান এবং তাঁর রহমত লাভের আশা করেন।
  5. মুজদালিফায় রাত্রিযাপন: আরাফার দিন শেষে হাজিরা মুজদালিফায় রাত্রিযাপন করেন এবং শয়তানের বিরুদ্ধে প্রতীকী যুদ্ধের জন্য পাথর সংগ্রহ করেন। এটি আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা ও আনুগত্যের শিক্ষা দেয়।
  6. শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ: মিনায় তিনটি স্তম্ভ (জামারাত)-এ পাথর নিক্ষেপ করা হয়, যা শয়তানের বিরুদ্ধে প্রতীকী যুদ্ধের অংশ। এটি ইঙ্গিত করে যে, মুসলমানদের নিজেদের জীবনে শয়তানের প্ররোচনা থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
  7. কুরবানি: হজের অংশ হিসেবে পশু কুরবানি করা হয়, যা মুসলমানদের ত্যাগ ও আনুগত্য প্রকাশ করে। এটি হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.)-এর আত্মত্যাগের মহিমা স্মরণ করিয়ে দেয়।
  8. তাওয়াফে জিয়ারত: হজের চূড়ান্ত ধাপে পুনরায় কাবা শরীফের তাওয়াফ করা হয়, যা আল্লাহর সাথে সংযোগ স্থাপনের প্রতীক।

হজের তাৎপর্য

হজ মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সাম্য ও আনুগত্যের শিক্ষা দেয়। এটি আত্মশুদ্ধির একটি মাধ্যম, যা মুসলমানদের পাপমুক্ত করে এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে। হজে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি মুসলমান একটি অভিন্ন পোশাক পরিধান করে, যা সামাজিক শ্রেণিবিভেদ দূর করে এবং সকলকে এক কাতারে নিয়ে আসে। এটি মানবজীবনে ত্যাগের গুরুত্ব বোঝায় এবং ধৈর্য, সহমর্মিতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষা প্রদান করে।

আরো পড়ুন : সাওম (রোজা): ইসলামিক দৃষ্টিকোণ, গুরুত্ব ও উপকারিতা

হজ মুসলমানদের মনে করিয়ে দেয় যে, এই দুনিয়ার সমস্ত কিছু ক্ষণস্থায়ী, এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো আখিরাতে সফলতা লাভ করা। এটি আমাদের জীবনের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর সামনে জবাবদিহিতার বোধ সৃষ্টি করে।

উপসংহার

হজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা মুসলমানদের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। এটি আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের প্রতীক। যেসব মুসলমানের আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ্য রয়েছে, তাদের উচিত জীবনে অন্তত একবার হজ পালন করা। হজ শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় রীতি নয়, বরং এটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সাম্য ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রতীকও বটে। এটি মুসলমানদের মনে করিয়ে দেয় যে, মানবজীবনের আসল লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং আখিরাতে সফল হওয়া।

হজ বিষয়ক ২০টি MCQ

  1. হজ ইসলামের কত নম্বর স্তম্ভ?
    a) প্রথম
    b) তৃতীয়
    c) পঞ্চম
    d) সপ্তম
    উত্তর: c) পঞ্চম
  2. হজ ফরজ হওয়ার প্রধান শর্ত কোনটি?
    a) আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ্য থাকা
    b) বিবাহিত হওয়া
    c) হজ সম্পর্কে জানাশোনা থাকা
    d) মক্কায় বসবাস করা
    উত্তর: a) আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ্য থাকা
  3. হজ কখন পালন করা হয়?
    a) মহররম মাসে
    b) রমজান মাসে
    c) জিলহজ মাসে
    d) সফর মাসে
    উত্তর: c) জিলহজ মাসে
  4. হজে প্রথম যে কাজটি করতে হয় তা কী?
    a) কাবা শরীফ তাওয়াফ
    b) শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ
    c) ইহরাম ধারণ
    d) কুরবানি করা
    উত্তর: c) ইহরাম ধারণ
  5. কাবা শরীফের তাওয়াফ কয়বার করতে হয়?
    a) ৩ বার
    b) ৫ বার
    c) ৭ বার
    d) ৯ বার
    উত্তর: c) ৭ বার
  6. সাই কোথায় করা হয়?
    a) কাবা শরীফে
    b) আরাফার ময়দানে
    c) সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে
    d) মুজদালিফায়
    উত্তর: c) সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে
  7. আরাফার ময়দানে অবস্থান করা বাধ্যতামূলক কোন দিনে?
    a) ৭ জিলহজ
    b) ৮ জিলহজ
    c) ৯ জিলহজ
    d) ১০ জিলহজ
    উত্তর: c) ৯ জিলহজ
  8. মুজদালিফায় হাজিরা কী করেন?
    a) কুরবানি করেন
    b) পাথর সংগ্রহ করেন
    c) সাই করেন
    d) তাওয়াফ করেন
    উত্তর: b) পাথর সংগ্রহ করেন
  9. হজের সময় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করা হয় কোথায়?
    a) আরাফার ময়দানে
    b) মিনার জামারাতে
    c) মুজদালিফায়
    d) কাবা শরীফের সামনে
    উত্তর: b) মিনার জামারাতে
  10. হজের সময় পশু কুরবানি করা হয় কেন?
    a) হাজিদের খাবারের জন্য
    b) ইসলামের ঐতিহ্য হিসেবে
    c) হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর স্মরণে
    d) উৎসব পালনের জন্য
    উত্তর: c) হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর স্মরণে
  11. তাওয়াফে জিয়ারত কখন করা হয়?
    a) ৮ জিলহজ
    b) ৯ জিলহজ
    c) ১০ জিলহজ
    d) ১১ জিলহজ
    উত্তর: c) ১০ জিলহজ
  12. নারীদের জন্য হজে যাওয়ার ক্ষেত্রে কী বাধ্যতামূলক?
    a) মাহরাম থাকা
    b) সাদা পোশাক পরিধান করা
    c) তাওয়াফ বেশি করা
    d) নামাজ বেশি পড়া
    উত্তর: a) মাহরাম থাকা
  13. ইহরাম কী?
    a) একটি বিশেষ দোয়া
    b) সেলাইবিহীন পোশাক
    c) মক্কার একটি স্থান
    d) হজের সময় পড়া কুরআনের অংশ
    উত্তর: b) সেলাইবিহীন পোশাক
  14. হজ ইসলামের কোন শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি প্রতিফলিত করে?
    a) সামাজিক ন্যায়বিচার
    b) অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি
    c) মানবজাতির ঐক্য
    d) শারীরিক সুস্থতা
    উত্তর: c) মানবজাতির ঐক্য
  15. হজে গিয়ে মুসলমানরা একই পোশাক পরে কেন?
    a) সৌন্দর্যের জন্য
    b) কষ্ট কমানোর জন্য
    c) ধনী-গরিবের বিভেদ দূর করার জন্য
    d) শরীর গরম রাখার জন্য
    উত্তর: c) ধনী-গরিবের বিভেদ দূর করার জন্য
  16. কোনটি হজের ফরজ কাজ?
    a) হজ পালন শেষে কাবা শরীফের দরজা চুম্বন করা
    b) সাফা-মারওয়া দৌড়ানো
    c) কুরবানি করা
    d) আরাফাতে অবস্থান করা
    উত্তর: d) আরাফাতে অবস্থান করা
  17. হজে যাওয়া কি প্রত্যেক মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক?
    a) হ্যাঁ, যেকোনো পরিস্থিতিতে
    b) না, শুধুমাত্র সামর্থ্যবানদের জন্য
    c) না, এটি শুধু পুরুষদের জন্য
    d) হ্যাঁ, বছরে একবার করা বাধ্যতামূলক
    উত্তর: b) না, শুধুমাত্র সামর্থ্যবানদের জন্য
  18. যে ব্যক্তি হজের কার্যক্রম সম্পন্ন করেন, তাকে কী বলা হয়?
    a) হাজি
    b) মুসলিম
    c) ওমরাহ পালনকারী
    d) সফরকারী
    উত্তর: a) হাজি
  19. কোনটি হজের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য?
    a) ব্যক্তিগত খ্যাতি অর্জন করা
    b) পাপ থেকে মুক্তি লাভ করা
    c) আর্থিক লাভ করা
    d) সমাজে উচ্চ মর্যাদা পাওয়া
    উত্তর: b) পাপ থেকে মুক্তি লাভ করা
  20. হজের মাধ্যমে একজন মুসলমান কী অনুভব করতে পারেন?
    a) শারীরিক কষ্ট
    b) পার্থিব জীবনের মূল্য
    c) আল্লাহর নৈকট্য ও আত্মশুদ্ধি
    d) অর্থনৈতিক উন্নতি
    উত্তর: c) আল্লাহর নৈকট্য ও আত্মশুদ্ধি

এই বিভাগ থেকে আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button