সরকারের শ্রেণিবিভাগ
সরকারের ধারণার উৎপত্তির সময়কাল থেকে বিভিন্ন দার্শনিক সরকারকে বিভিন্নভাবে ভাগ করেছেন। আধুনিককালে সরকারের ধরন নিম্নরূপ :
সরকার | |||
ক্ষমতা বণ্টনের নীতির ভিত্তিতে | আইন ও শাসন বিভাগের সম্পর্কের ভিত্তিতে | ||
এককেন্দ্রিক সরকার | যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার | সংসদীয় সরকার | রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার |
ক্ষমতা বণ্টনের নীতির ভিত্তিতে সরকারের শ্রেণিবিভাগ কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের নীতির ভিত্তিতে সরকার দুই ধরনের হতে পারে। যথা – এককেন্দ্রিক সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার।
এককেন্দ্রিক সরকার
যে শাসনব্যবস্থায় সরকারের সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে এবং কেন্দ্র থেকে দেশের শাসন পরিচালিত হয়, তাকে এককেন্দ্রিক সরকার বলে। এতে কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন করা হয় না। এ সরকার ব্যবস্থায় আঞ্চলিক সরকারের কোনাে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। রাষ্ট্রে বিভিন্ন প্রদেশ বা প্রশাসনিক অঞ্চল থাকতে পারে। তবে তারা কেন্দ্রের প্রতিনিধি বা সহায়ক হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশ, জাপান, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশে এককেন্দ্রিক সরকার প্রচলিত আছে।
এককেন্দ্রিক সরকারের গুণ
এককেন্দ্রিক সরকারের বিশেষ কতগুলাে গুণ আছে। যেমন
- সহজ সাংগঠনিক ব্যবস্থা : এককেন্দ্রিক সরকারের সংগঠন সরল প্রকৃতির। এতে কেন্দ্রের হাতে সব ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের কোনাে ঝামেলা নেই। কেন্দ্রে কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে সহজেই তা সমগ্র দেশে বাস্তবায়ন করা যায়। এ ছাড়া সারা দেশে অভিন্ন আইন, নীতি ও পরিকল্পনা বলবৎ করা হয়। ফলে সাংগঠনিক সামঞ্জস্য থাকে।
- জাতীয় ঐক্যের প্রতীক :এই সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রের ভিতরে বিভিন্ন প্রদেশ বা অঞ্চল থাকলেও তাদের কোনাে স্বায়ত্তশাসন নেই। ফলে সারা দেশের জন্য একই প্রশাসনিক নীতি ও আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হয়,যা জাতীয় সংহতি ও অখণ্ডতা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
- মিতব্যয়িতা : এককেন্দ্রিক সরকারে প্রশাসনিক ব্যয় কম। কারণ এতে কেবল কেন্দ্রে সরকার গঠন করা হয়। এখানে কেন্দ্রীয় সরকার সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং তা ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন হয়। স্তরে স্তরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রয়ােজন হয় না বলে এতে খরচ কমে।
- দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ : কোনাে আঞ্চলিক সরকারের সাথে পরামর্শ বা আঞ্চলিক স্বার্থ বিবেচনার দরকার হয় না বলে এককেন্দ্রিক সরকারের পক্ষে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় । সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনাে জটিলতা তৈরি হয় না।
- ছােট রাষ্ট্রের উপযােগী : এককেন্দ্রিক সরকার ভৌগােলিক দিক দিয়ে অপেক্ষাকৃত ছােট ও অভিন্ন কৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রের জন্য বেশি উপযােগী। যেমন- বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা।
এককেন্দ্রিক সরকারের ত্রুটি
এককেন্দ্রিক সরকারে সুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনি কতগুলাে ত্রুটিও রয়েছে। যেমন
- কাজের চাপ : এককেন্দ্রিক সরকারে কেন্দ্রের হাতে সকল ক্ষমতা ন্যস্ত থাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের উপর কাজের বেশি চাপ থাকে। সরকারের সব কাজ কেন্দ্রীয় সরকারকে করতে হয় বলে প্রশাসকগণ রুটিন কাজের চাপে জনহিতকর কাজের প্রতি প্রয়ােজনীয় সময় দিতে পারে না।
- স্থানীয় নেতৃত্ব বিকাশের অনুকূল নয় : এ ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয়ভাবে ক্ষমতার চর্চা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক পর্যায়ে জনগণের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোেগ থাকে না। ফলে স্থানীয় নেতৃত্ব গড়ে উঠার সুযাগ থাকে না।
- স্থানীয় উন্নয়ন ও সমস্যার প্রতি অবহেলা : এককেন্দ্রিক সরকারে সারা দেশের জন্য অভিন্ন পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা থাকতে পারে, যার প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে নজর দেওয়া সম্ভব হয় না। আবার অঞ্চলগুলাে দূরে থাকার কারণে কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় সমস্যাগুলাে ঠিকভাবে বুঝতে ও সমাধান করতে পারে না।
- বড় রাষ্ট্রের জন্য অনুপযােগী : বড় রাষ্ট্রের জন্য এককেন্দ্রিক সরকার সুবিধাজনক নয়। বড় রাষ্ট্রে এক অঞ্চলের সঙ্গে আরেক অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কম-বেশি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এই পার্থক্যগুলাে একত্রিত করে সবকিছু কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে একা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারকে নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সরকারের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস বাড়ে। এ কারণে অঞ্চলগুলাের বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
- কেন্দ্রের স্বেচ্ছাচারিতা : এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে কেন্দ্রের স্বেচ্ছাচারিতার সম্ভাবনা থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার
যুক্তরাষ্ট্র বলতে সেই ধরনের সরকারকে বােঝায়, যেখানে একাধিক অঞ্চল বা প্রদেশ মিলে একটি সরকার গঠন করে। এ ধরনের সরকার ক্ষমতা বণ্টনের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এতে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার কিছু অংশ প্রদেশ বা আঞ্চলিক সরকারের এবং জাতীয় বিষয়গুলাে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকে। ফলে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় উভয় সরকারই মৌলিক ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র থেকে দেশ পরিচালনা করে। অর্থাৎ এতে দ্বৈত সরকারব্যবস্থা থাকে। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা প্রভৃতি দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার পদ্ধতি রয়েছে।
আরো পড়ুন :
- বাংলাদেশ সরকারের স্বরূপ ও বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ
- বাংলাদেশের সংবিধানের সংশােধনীসমূহ
- বাংলাদেশের সংবিধান ও বাংলাদেশের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
- উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
- অলিখিত সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
- লিখিত সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
- সংবিধানের শ্রেণিবিভাগ
- সংবিধান প্রণয়ন পদ্ধতি
- সংবিধানের ধারণা ও গুরুত্ব
- আইন ও শাসন বিভাগের সম্পর্কের ভিত্তিতে সরকারের শ্রেণিবিভাগ
- পৌরনীতি ও নাগরিকতা | পৌরনীতি ও নাগরিকতা বিষয়ের পরিসর বা বিষয়বস্তু
- পরিবার কি | পরিবারের শ্রেণিবিভাগ | পরিবারের কার্যাবলি
- রাষ্ট্র কাকে বলে? রাষ্ট্রের উপাদান কয়টি ও কি কি ?
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের গুণ
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বেশ কিছু গুণ আছে । যথা :
- জাতীয় ঐক্য ও আঞ্চলিক স্বাতন্ত্রের সমন্বয় ঘটায় : এ ধরনের সরকার আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র ও ভিন্নতা বজায় রেখে জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলে। এতে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ও ভিন্নতাকে স্বীকৃতি দিয়ে সেগুলােকে লালন করা হয়। ফলে এ ব্যবস্থায় বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠে।
- কেন্দ্রীয় সরকারের কাজের চাপ কমায় : এ সরকারব্যবস্থায় সংবিধানের মাধ্যমে কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করে দেওয়া হয়। ফলে কেন্দ্রের কাজের চাপ কমে যায় এবং কেন্দ্রের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন সহজ হয়।
- আঞ্চলিক সমস্যা সমাধানের উপযােগী : যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আঞ্চলিক সরকার সহজেই অঞ্চলের সমস্যাগুলাে বুঝতে এবং তা চিহ্নিত করে সমাধান করতে পারে।
- রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি ও স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশে সহায়ক : যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় জনগণ দুটি সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখায় এবং দুই প্রকার আইন ও আদেশ মেনে চলে। ফলে জনগণ রাজনৈতিকভাবে অধিকতর সচেতন হয়ে উঠে। এ ধরনের ব্যবস্থা স্থানীয় নেতৃত্ব বিকাশে খুবই সহায়ক।
- কেন্দ্রের স্বেচ্ছাচারিতা লােপ পায় : কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের ফলে কেন্দ্র নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না। ফলে কেন্দ্রের স্বেচ্ছাচারী হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ত্রুটি
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারে নিমােক্ত ত্রুটি দেখা দিতে পারে :
- জটিল প্রকৃতির শাসন : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের গঠনপ্রণালি জটিল প্রকৃতির। এ যেন সরকারের ভিতর সরকার। ফলে কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ, ক্ষমতা বণ্টন, আইন প্রণয়ন ও প্রয়োেগ প্রভৃতি বিষয়ে জটিলতা দেখা দেয় ।
- ক্ষমতার দ্বন্দ্ব : এতে ক্ষমতার এখতিয়ার নিয়ে কেন্দ্র, প্রদেশ এমনকি বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত সৃষ্টি হতে দেখা যায় ।
- দুর্বল সরকার : ক্ষমতা বণ্টনের ফলে জাতীয় ও আঞ্চলিক সরকার উভয়েই দুর্বল অবস্থায় থাকে। জরুরি অবস্থায় অনেক সময় দ্রুত ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। আঞ্চলিক সরকারের মতামতের প্রয়ােজন হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি হয়।
- বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রদেশগুলাে স্বতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসিত। এ কারণে সুযােগ বুঝে প্রয়ােজনে কোনাে অঞ্চল বা প্রদেশ বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা করতে পারে।
- ব্যয়বহুল : এতে দ্বৈত সরকার কাঠামাে থাকায় প্রশাসনের ব্যয় বৃদ্ধি পায়।