প্রাচীন বাংলার জনপদ
ইতিহাস-বিষয়ক আলােচনায় যুগের বিভাজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে এ যুগ বিভাজন নির্ণয় করা হয়ে থাকে । ঐতিহাসিকগণ খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ শতক থেকে খ্রিষ্টীয় তেরাে শতক পর্যন্ত সময়কালকে বাংলার ইতিহাসের প্রাচীন যুগ বলে মনে করেন। আবার কেউ কেউ খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ শতক থেকে খ্রিষ্টীয় ছয় শতক পর্যন্ত সময়কালকে আদি ঐতিহাসিক যুগ এবং খ্রিষ্টীয় সাত শতক থেকে তেরাে শতক পর্যন্ত সময়কালকে প্রাক-মধ্যযুগ বলেও যুগ বিভাজন করে থাকেন।
বাংলাদেশের ভৌগােলিক বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব :
এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে বাংলাদেশের অবস্থান। প্রাচীনকাল থেকে অনেকবার বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে। ফলে এর সীমারেখারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ইংরেজরা ভারতবর্ষ থেকে চলে যাবার পর ১৯৪৭ সালে বাংলা দুই ভাগে বিভক্ত হয়। এর পশ্চিমাংশ ভারত আর পূর্বাংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। পাকিস্তানের অন্তর্গত বাংলাদেশের নাম হয় প্রথমে পূর্ববাংলা ও পরে পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এ রাষ্ট্রের নতুন নাম হয় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের উত্তরে রয়েছে বিশাল হিমালয় পর্বতমালা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের বিশাল নীল জলরাশি। দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার ছাড়া সমগ্র দেশটির বাকি সীমারেখা ঘিরে রেখেছে ভারত। বাংলাদেশের মােট আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলােমিটার। এর অধিকাংশ অঞ্চলই সমভুমি। অসংখ্য নদ-নদী আর খাল-বিল ছড়িয়ে আছে এদেশের বুকজুড়ে। মূল নদ-নদীগুলাে হচ্ছে পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, তিস্তা ও করতােয়া।
কোন দেশের মানুষের জীবনাচরণ ও ইতিহাসের ওপর সে দেশের ভৌগােলিক বৈশিষ্ট্যের প্রভাব অপরিসীম। এ জন্যই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জীবনধারা, আচার-আচরণে এত বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের বিশাল সমভূমি আর প্রচুর নদ-নদী থাকায় এদেশের যােগাযােগ ও মালামাল পরিবহনের একটি বড় মাধ্যম নদীপথ। বিদেশি আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য নৌযুদ্ধে পারদর্শী হয়ে ওঠে বাংলার সৈন্যরা। পাশাপাশি উর্বর ভূমির কারণে কৃষিভিত্তিক সমাজও গড়ে ওঠে।
এখানকার আবহাওয়া নাতিশীতােষ্ণ। ভৌগােলিক পরিবেশ দেশবাসীকে কোমল আর শান্ত স্বভাবের করেছে। আবার ঋতুবৈচিত্র্যের কারণে ঝড়-জলােচ্ছাসের সাথে যুদ্ধ করতে হয় বাংলাদেশের মানুষকে তাই। ওঠে সংগ্রামী। ফলে মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম করেছে। শুধু স্বভাব চরিত্র নয়, বাংলার অধিবাসীদের খাদ্য তালিকা, পােশাক, ঘর-বাড়ি সবকিছুই এদের ভৌগােলিক বৈশিষ্ট্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। বৈচিত্র্যময় এই প্রাকৃতিক অবস্থান প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলার মানুষকে কিছুটা বাড়তি
জনপদ
বাংলা নামের একটি অখণ্ড দেশের জন্ম একবারে হয়নি। এর যাত্রা শুরু হয় জনপদগুলাের মধ্য দিয়ে। উল্কীর্ণ শিলালিপি ও বিভিন্ন সাহিত্যগ্রন্থে প্রায় বােলােটি জনপদের কথা জানা যায়। তবে প্রতিটি অঞ্চলের সীমা সবসময় একই রকম থাকেনি। কখনও কোনাে জনপদের সীমা বেড়েছে, আবার কখনাে কমেছে। নিচে কয়েকটি উল্লেখযােগ্য জনপদের বর্ণনা দেওয়া হলাে :
গৌড় :
গৌড়’ নামটি সুপরিচিত হলেও প্রাচীনকালে ঠিক কোথায় গৌড় জনপদটি গড়ে উঠেছিল তা জানা যায়নি। তবে ষষ্ঠ শতকে পূর্ব বাংলার উত্তর অংশে গৌড় রাজ্য বলে একটি স্বাধীন রাজ্যের কথা জানা যায়। সপ্তম শতকে শশাঙ্ককে গৌড়রাজ বলা হতাে। এ সময় গৌড়ের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ। বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলায় ছিল এর অবস্থান। বাংলায় মুসলমানদের বিজয়ের কিছু আগে মালদহ জেলার লক্ষণাবতীকেও গৌড় বলা হতাে।
বঙ্গ :
‘বঙ্গ একটি অতি প্রাচীন জনপদ। বর্তমান বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বঙ্গ জনপদ নামে একটি অঞ্চল গড়ে উঠেছিল। অনুমান করা হয়, এখানে বঙ্গ’ বলে একটি জাতি বাস করতাে। তাই জনপদটি পরিচিত হয় ‘বঙ্গ’ নামে। প্রাচীন শিলালিপিতে বঙ্গের দুইটি অঞ্চলের নাম পাওয়া যায়—একটি বিক্রমপুর, আর অন্যটি নাব্য। বর্তমানে নাব্য বলে কোনাে জায়গার অস্তিত্ব নেই। ধারণা করা হয়, ফরিদপুর, বাখেরগঞ্জ ও পটুয়াখালীর নিচু জলাভুমি এ নাব্য অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রাচীন বঙ্গ জনপদ ছিল খুব শক্তিশালী অঞ্চল। ‘বঙ্গ থেকে বাঙালি জাতির উৎপত্তি ঘটেছিল।
পুন্ড্র :
প্রাচীন বাংলার জনপদগুলাের মধ্যে অন্যতম হলাে পুন্ড্র। বলা হয় যে, পুন্ড্র বলে একটি জাতি এ জনপদ গড়ে তুলেছিল। বর্তমান বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী ও দিনাজপুর অঞ্চল নিয়ে এ পুন্ড্র জনপদটির সৃষ্টি হয়েছিল।পুন্ড্রদের রাজ্যের রাজধানীর নাম ছিল পুণ্ড্রনগর। পরবর্তীকালে এর নাম হয় মহাস্থানগড়। মহাস্থানগড় প্রাচীন পুন্ড্র নগরীর ধ্বংসাবশেষ বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনের দিক দিয়ে পুন্ড্রই ছিল প্রাচীন বাংলার সবচেয়ে সমৃদ্ধ জনপদ। পাথরের চাকতিতে খােদাই করা লিপি এখানে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে প্রাপ্ত এটিই প্রাচীনতম শিলালিপি।
হরিকেল :
সপ্তম শতকের লেখকরা হরিকেল নামে অপর একটি জনপদের বর্ণনা করেছেন। এ জনপদের অবস্থান ছিল বাংলার পূর্ব প্রান্তে। মনে করা হয়, আধুনিক সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এই জনপদ বিস্তৃত ছিল।
সমতট :
পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় বঙ্গের প্রতিবেশী জনপদ হিসেবে সমতটের অবস্থান। কেউ কেউ মনে করেন, সমতট বর্তমান কুমিল্লার প্রাচীন নাম। গঙ্গা-ভাগীরথীর পূর্ব তীর থেকে শুরু করে মেঘনার মােহনা পর্যন্ত সমুদ্রকূলবর্তী অঞ্চলকেই সম্ভবত বলা হতাে সমতট। কুমিল্লা শহরের ১২ মাইল পশ্চিমে বড় কামতা এর রাজধানী ছিল। কুমিল্লার ময়নামতিতে কয়েকটি প্রাচীন নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া গেছে। শালবন বিহার এদের অন্যতম।
বরেন্দ্র :
বরেন্দ্রী, বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রভূমি নামে প্রাচীন বাংলায় অপর একটি জনপদের কথা জানা যায়। এটিও উত্তরবঙ্গের একটি জনপদ। অনুমান করা হয়, পুরে একটি অংশ জুড়ে বরেন্দ্রর অবস্থান ছিল। বগুড়া, দিনাজপুর ও রাজশাহী জেলার অনেক অঞ্চল এবং সম্ভবত পাবনা জেলাজুড়ে বরেন্দ্র অঞ্চল বিস্তৃত ছিল।
তাম্রলিপ্ত :
হরিকেলের দক্ষিণে অবস্থিত ছিল তাম্রলিপ্ত জনপদ। বর্তমান মেদিনীপুর জেলার তমলুকই ছিল তাম্রলিপ্তের প্রাণকেন্দ্র। সপ্তম শতক থেকে এটি দণ্ডভুক্তি নামে পরিচিত হতে থাকে।
চন্দ্রদ্বীপ :
প্রাচীন বাংলায় আরও একটি ক্ষুদ্র জনপদের নাম পাওয়া যায়। এটি হলাে চন্দ্রদ্বীপ। বর্তমান বরিশাল জেলাই ছিল চন্দ্রদ্বীপের মূল ভূখণ্ড ও প্রাণকেন্দ্র। এ প্রাচীন জনপদটি বালেশ্বর ও মেঘনার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল।
প্রাচীন বাংলার জনপদ থেকে আমরা তখনকার বাংলার ভৌগােলিক অবয়ব, সীমারেখা, রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সম্পর্কে মােটামুটি ধারণা লাভ করতে পারি। প্রাচীন বাংলায় তখন কোনাে রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না। শক্তিশালী শাসকগণ তাদের আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে একাধিক জনপদের শাসন ক্ষমতা লাভ করতেন।
অনুশীলনমূলক প্রশ্ন
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :
১. কোন জনপদ থেকে বাঙালি জাতির উৎপত্তি ঘটেছিল?
ক. বরেন্দ্র
খ. পুণ্ড
গ. বঙ্গ
ঘ. গৌড়
২. তাম্রলিপ্ত জনপদটি ছিল—
i. সমুদ্র উপকূলবর্তী খুব নিচু ও আর্দ্র
ii. স্থল বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত
iii. নৌ চলাচলের জন্য অতি উত্তম
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii
উদ্দীপকটি পড় এবং ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও :
শিলা শীতকালীন ছুটিতে মা-বাবার সাথে রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর পরিদর্শনে যায়। সেখানে গিয়ে সে প্রাচীন নিদর্শনের সাথে পরিচিতি লাভ করে। এর মধ্যে বিশেষ করে ছিল পাথরের চাকতিতে খােদাই করা লিপি। সে জানতে পারে এটি ছিল বাংলাদেশে পাওয়া প্রাচীন শিলালিপি এবং সম্রাট অশােকের সময় এ লিপি উত্তীর্ণ করা হয়েছিল।
৩. শিলার পরিচিত হওয়া নিদর্শনগুলাে প্রাচীন কোন জনপদের ইঙ্গিত বহন করে?
ক. গৌড়
খ. পুন্ড্র
গ. সমতট
ঘ. বরেন্দ্র
৪. উক্ত জনপদটি প্রাচীন বাংলার গুরুত্বপূর্ণ জনপদ, কারণ এটি –
i. সভ্যতার প্রাচীনতম নিদর্শন
ii. সমৃদ্ধ নগরী হিসেবে পরিচিত
iii. খ্যাতিপূর্ণ নৌ-বাণিজ্যিক কেন্দ্র
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i
খ. i ও ii.
গ. i ও iii
ঘ. i, ii ও iii