প্রতিষ্ঠান (Institution) : সাধারণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মানুষ সংঘ গঠন করে। এসব সংঘের মধ্যে কতকগুলাে স্থায়ী এবং কতকগুলাে অস্থায়ী। পরিবার, রাষ্ট্র, মসজিদ, মন্দির হল স্থায়ী সংঘ। স্থায়ী সংঘগুলাে তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য কতকগুলাে কর্মপদ্ধতি, বিধিবিধান, নিয়মনীতির ওপর নির্ভর করে। এসব কর্মপদ্ধতি, বিধিবিধান, নিয়মনীতি স্থায়ীরূপ। লাভ করলে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
জিসবার্ট (Gisbert) “প্রতিষ্ঠান” বলতে ব্যক্তি ও গােষ্ঠীর সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের জন্য কতগুলাে স্থায়ী ও স্বীকৃত কর্মপদ্ধতিকে বুঝিয়েছেন। ম্যাকাইভার ও পেজ-এর মতে, “প্রতিষ্ঠান হল সেই সব প্রচলিত কর্মপদ্ধতি যার মাধ্যমে গােষ্ঠীর কার্যকলাপের বৈশিষ্ট্য সূচিত হয়”। এ অর্থে বিবাহ, সম্পত্তি, ধর্মশিক্ষা ইত্যাদি হল প্রতিষ্ঠান।
বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান ও তাদের ভূমিকা
সমাজজীবনের প্রয়ােজনের দিক থেকে প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা
ক) সামাজিক প্রতিষ্ঠান :
সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পরিবার সবচেয়ে আদিম এবং গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের প্রধান কাজ হল বংশধারা অক্ষুন্ন রাখা এবং মানুষের জৈবিক প্রয়ােজন মেটানাে। শিশু লালন-পালন করা এবং বৃহত্তর জীবনের জন্য শিশুকে গড়ে তােলার দায়িত্ব পরিবারের। এছাড়া পরিবার সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রধান বাহন হিসেবে কাজ করে।
আরো পড়ুন : পরিবারের সংজ্ঞা, পরিবারের প্রকারভেদ ও পরিবারের কার্যাবলি
পরিবারের সদস্যদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার ফলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায়। সুতরাং সামাজিক সংহতি রক্ষার্থে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিবাহ আরাে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। বিবাহের মাধ্যমেই মানুষ পরিবার গঠন করে। সমাজঘীকৃত উপায়ে মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণের একমাত্র প্রতিষ্ঠান হল বিবাহ। সমাজে যদি বিবাহপ্রথা গড়ে না উঠত তবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থাকত না এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিত।
খ) শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান :
শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হল ব্যক্তির মধ্যে সুপ্ত বুদ্ধিগত ক্ষমতাগুলােকে বিকশিত করে তার ব্যক্তিত্বকে সুগঠিত করা এবং ব্যক্তিকে চরিত্রবান করে গড়ে তােলা। শিশুর সামাজিকীকরণের দায়িত্ব শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানের। স্কুল, কলেজ ইত্যাদি হল শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ।
গ) অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান :
অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষ তাদের যাবতীয় বতুগত অভাব ও চাহিদা পূরণ করে থাকে। উৎপাদন, ভােগ ও বণ্টন-ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক চাহিদা মেটায়। ব্যাংক, বীমা, ঋণদান সংস্থা ইত্যাদি হল অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ।
ঘ) ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান:
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমাজজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধর্ম হল কোনাে অতিপ্রাকৃত সত্তায় বিশ্বাস। ধর্মের অভ্যন্তরীণ দিক হল ব্যক্তির বিশ্বাস ও ধারণা এবং বাহ্যিক দিক হল কতগুলাে আচার-অনুষ্ঠান যেমন- উপাসনা করার পদ্ধতি যার মাধ্যমে ব্যক্তির ধর্মীয় মনােভাব প্রকাশ পায়। ধর্ম মানুষকে খারাপ কাজ হতে বিরত থাকতে এবং ভালাে কাজ করার জন্য প্রণােদিত করে। সামাজিক শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ঙ) আমােদ-প্রমােদ সংক্রান্ত প্রথা-প্রতিষ্ঠান :
আমােদ-প্রমােদ সংক্রান্ত প্রথা-প্রতিষ্ঠান সমাজের সদস্যদের বিভিন্নভাবে আমােদ-প্রমােদের ব্যবস্থা করে ব্যক্তির মনের চাহিদা পূরণ করে। সংগীত সংঘ, থিয়েটার, সিনেমা হল ইত্যাদি এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ।
চ) রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান :
রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, দেশে শাসনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সমাজের সর্বাঙ্গীণ নিয়ন্ত্রণ নির্ভর করে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজে দুর্নীতি, অনাচার ও সামাজিক সমস্যাবলি মােকাবেলা করা হয়। উন্নয়নমূলক কার্যাবলির মাধ্যমে জনগণের নানাবিধ সমস্যা দূর করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। রাজনৈতিক দল, পুলিশ বাহিনী, আমলাতন্ত্র হল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ।
আগের আলােচনা হতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সমাজকে সুশৃঙ্খল রাখতে তথা সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করতে সামাজিক প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সামাজিক উন্নয়নে এবং সমাজ গঠনে সামাজিক প্রথা-প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।