এই পাঠ শেষে আপনি
- অসহযােগ আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা করতে পারবেন;
- অসহযােগ আন্দোলন ও বাঙালির জাতীয় উত্থান সম্পর্কে বলতে পারবেন;
- ৭ মার্চের ভাষণের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করতে পারবেন।
অসহযােগ আন্দোল পটভূমি
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হলে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতা হারাবার ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ অধিক আসনে জয়লাভ করবে এ ধারণা কমবেশি সবাই পােষণ করেছিল কিন্তু একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জনগণের ম্যান্ডেট পাবে পশ্চিমা শাসকেরা তা ভাবতে পারে নি। তাহলে হয়তাে তারা ভিন্ন কূটকৌশলের আশ্রয় নিত।
আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালির রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব অর্জন এবং ৬-দফা ভিত্তিক সংবিধান প্রণয়নের বিষয়টি নিশ্চিত হয়, যার কোনটিই পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক আমলা শাসকগােষ্ঠীর নিকট গ্রহণযােগ্য ছিল না। ফলে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের অব্যবহিত পরে শুরু হয় নতুন প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। সামরিক-বেসামরিক আমলা শাসকগােষ্ঠীর সঙ্গে এ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে সহায়তা প্রদান করে পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিশেষত পাকিস্তান পিপলস পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টো।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেছিলেন। নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি পাকিস্তানের ‘ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু এ সবই ছিল বাইরে থেকে লােক দেখানাে। ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র চালানাে হচ্ছিল কিভাবে নির্বাচনের রায় বানচাল করা যায়। অন্যদিকে ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দলীয় নব নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের এক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
উক্ত অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সদস্যবৃন্দ ঐতিহাসিক ৬-দফা এবং ছাত্রসমাজের প্রাণের দাবি ১১-দফার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না করে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার শপথ গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান যখন পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যথার্থঅর্থে আশার সঞ্চার করছিল তখন জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানে ‘দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল’ (আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি) এ তত্ত্ব হাজির করেন। সংবিধানের প্রশ্নে দুটি দলের মধ্যে একটি সমঝােতা না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগদান না করার কথা তিনি ঘােষণা করেন।
এ ঘােষণার পেছনে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার যােগসাজসের বিষয়টি স্পষ্ট বােঝা যাচ্ছিল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার দু’দিন পূর্বে ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতকরণের খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্ধ ছাত্র-জনতা রাজপথে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বাঙালির জাতীয় উত্থানে এক নব অধ্যায় সূচিত হয়।
অসহযােগ আন্দোলন ও বাঙালির জাতীয় উত্থান
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অর্নিদিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সমগ্র পূর্ব বাংলায় হরতালের ডাক দেন। কার্যত ১ মার্চ থেকে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ২ মার্চ রাতে কাফু জারি করা হয়। ছাত্রজনতা কাফু ভঙ্গ করে। সেনাবাহিনী গুলি চালায়। আন্দোলনের প্রতিটি দিনে শতশত লােক হতাহত হয়। প্রতিবাদে প্রতিরােধে জেগে ওঠে বাংলাদেশ। উত্থান ঘটে একটি জাতির। বাঙালি জাতির চারদিকে বিদ্রোহ দেখা দেয় বিদ্রোহের শ্লোগান ছিল : ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র-জনতার সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ছাত্র সমাজের ‘স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতেহার পাঠ’, স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন’ ২৩ মার্চ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে পূর্ব বাংলার সর্বত্র পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে সারা বাংলায় সর্বাত্মক অসহযােগ পালিত হয়। পূর্ব বাংলার সকল সরকারি, বেসরকারি অফিস, সেক্রেটারিয়েট, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, হাইকোট, পুলিশ প্রশাসন, ব্যাংক-বীমা, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহন পাকিস্তানি সরকারের নির্দেশ অমান্য ও অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলে। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি প্রশাসন সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন কার্যত সরকার প্রধান। বঙ্গবন্ধুর আবাসস্থল ধানমন্ডীর ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি পরিণত হয় সকল নির্দেশের উৎসস্থান অর্থাৎ সরকার প্রধানের কার্যালয় ।
৭ মার্চের ভাষণ ও এর প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালিদের জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। এ দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) লক্ষ লক্ষ জনতার স্বতঃস্ফুর্ত সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ইতিহাস খ্যাত এ ভাষণই ৭ মার্চের ভাষণ। ২ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর আহবানে সারা পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অসহযােগ চলছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য এ ছিলাে অন্তিম মুহূর্ত। অন্যদিকে স্বাধীনতার চেতনায় প্রদীপ্ত বাঙালি জাতির জন্য এ ভাষণ ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শােষণের নাগপাশ ছিন্ন করে জাতীয় মুক্তি বা কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে চূড়ান্ত সংগ্রামের সূচনা। মাত্র ১৮ মিনিটের এক ভাষণ।
বঙ্গবন্ধু তার সংক্ষিপ্ত অথচ তেজস্বী ভাষণে পাকিস্তানের ২৪ বছরের রাজনীতি ও বাঙালিদের বঞ্চনা করার ইতিহাস ব্যাখ্যা, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে বাঙালিদের দ্বন্দ্বের স্বরূপ উপস্থাপন, অসহযােগ আন্দোলনের পটভূমি বিশ্লেষণ ও বিস্তারিত কর্মসূচি ঘােষণা, সারা বাংলায় প্রতিরােধ গড়ে তােলার নির্দেশ, প্রতিরােধ সংগ্রাম শেষাবধি মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়ার ইঙ্গিত, শত্রুর মােকাবেলায় গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন, যে কোন উস্কানির মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার পরামর্শদান ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরার পর ঘােষণা করেন:
“ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তােল। তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করতে হবে। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরাে দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ। …. এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।”
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একজন দক্ষ কৌসুলির সুনিপুন বক্তব্য উপস্থাপন। বিশেষত ভাষণের শেষ পর্যায়ে তিনি ‘স্বাধীনতার কথা এমনভাবে উচ্চারণ করেন যাতে ঘােষণার কিছু বাকিও থাকলাে না, আবার তার বিরুদ্ধে একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণার অভিযােগ উত্থাপন করাও পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর জন্য আদৌ সহজ ছিল না। মনে করা যায় বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা।
তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় সরাসরি ভাবে তা ঘােষণা না করে তিনি কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেন। বাস্তবে ২৫ মার্চ, ১৯৭১ রাতের বেলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালিদের উপর অতর্কিতে বর্বর ও রক্তক্ষয়ী আক্রমন চালয়। বঙ্গবন্ধুর ঘােষণায় শুরু হয় মুক্তি যুদ্ধ। ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বঙ্গবন্ধুর এ কৌশল বা অবস্থান বাংলাদেশ সংগ্রামের পক্ষে ইতিবাচক ফল বয়ে আনে।
সারকথা
১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার গঠনের কথা। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী তাদের কায়েমী স্বার্থে বাঙালিদের সরকার গঠনের সুযােগ দিতে কিছুতেই রাজি ছিল না। তাই নির্বাচনের ফলাফল নস্যাৎ করে নিজেদের শাসন-শােষণ অব্যাহত রাখার হীন উদ্দেশ্যে তারা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। এরই অংশ হিসেবে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘােষণা করা হয়। অপরদিকে আলাপ-আলােচনার নাম করে সময় নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জাহাজভর্তি অস্ত্র ও সৈন্য আনতে থাকে। পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে ১ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানে অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দেন। ২৫ মার্চ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে।
পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি প্রশাসন সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ে। অসহযােগ আন্দোলন চলাকালীন ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) লক্ষ জনতার উত্তাল জনসমুদ্রে ‘মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামের আহবান জানান। শক্রর বিরুদ্ধে তিনি ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তােলার নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ একটি মূল্যবান দলিল। এটি ছিল বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা। ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী সশস্ত্র আক্রমণে ঝাপিয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।