বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের কারণ, ফলাফল, বঙ্গভঙ্গ রদ ও বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিক্রিয়া

Preparation BD
By -
0

বঙ্গভঙ্গ বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দিকে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ ঘটনা হিন্দুমুসলমানদের মধ্যে তীব্র আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল। ব্রিটিশ সরকারের প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বাংলা প্রদেশকে ভাগ করে দুইটি আলাদা প্রদেশ করার প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়।

১৮৫৪ সালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, ছােট নাগপুর ও আসাম নিয়ে গঠিত হয়েছিল বাংলা প্রেসিডেন্সি। একজন গভর্নরের পক্ষে এত বড় প্রদেশ শাসন করা সত্যিই দুরূহ ব্যাপার ছিল। তাই লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর উত্তর ও পূর্ব বাংলাকে আসামের সাথে যুক্ত করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে এক নতুন প্রদেশ গঠন করেন। নতুন প্রদেশের রাজধানী হয় ঢাকা।

নতুন প্রদেশের প্রথম ছােটলাট হলেন ব্যামফিল্ড ফুলার। অপরপক্ষে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে অন্য প্রদেশ গঠিত হয়। প্রশাসনিক সুবিধা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা বঙ্গভঙ্গের মূল ও প্রাথমিক কারণ। প্রশাসনিক কারণ ছাড়া বঙ্গভঙ্গের পেছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণও বিদ্যমান ছিল।

রাজনৈতিক কারণ :

পাশ্চাত্য-শিক্ষার প্রসারের ফলে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পায় এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। এসব আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ছিল কলকাতা। ঢাকাকে রাজধানী করে সরকার এ আন্দোলনকে স্তিমিত করতে সচেষ্ট হয়।

সামাজিক কারণ :

স্যার সৈয়দ আহমদের আলীগড় আন্দোলন মুসলমানদের স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন করে তােলে। ব্রিটিশ সরকার এদের স্বার্থ রক্ষার নিমিত্তে বঙ্গভঙ্গের প্রতি সমর্থন দান করে।

অর্থনৈতিক কারণ :

প্রাদেশিক রাজধানী কলকাতাকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলাে গড়ে উঠেছিল। শিক্ষা-দীক্ষা, পূর্ববঙ্গে উৎপাদিত পাট দিয়ে পাটকলগুলাে স্থাপিত হয়েছিল কলকাতার আশেপাশে। এছাড়া শিক্ষাদীক্ষা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য সব ক্ষেত্রে বঞ্চিত ছিল পূর্ববঙ্গ। এ প্রদেশের অধিবাসীরা কলকাতার জমিদার, আমলা ও আইনজীবীদের শােষণের শিকার হয়।

এ সমস্ত কারণে লর্ড কার্জন ১৯০৩ সালে প্রদেশটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। নতুন প্রদেশ হলে দুই প্রদেশেরই শিক্ষা, যােগাযােগ এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। সে জন্য ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হয়।

ফলাফল

ঢাকা হল নতুন প্রদেশের রাজধানী এবং নতুন প্রশাসন-ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু। এখানে গড়ে উঠল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাইকোর্ট, অফিস-আদালত, প্রেস ইত্যাদি। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সাধিত হল অভূতপূর্ব উন্নতি। এ জন্যই বঙ্গভঙ্গকে পূর্ব বাংলার মুসলমান সমাজ স্বাগত জানায়। বঙ্গভঙ্গের অব্যবহিত পরেই ঢাকায় সুরম্য অট্টালিকা, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট, কার্জন হল প্রভৃতি নির্মিত হতে থাকে। নতুন উদ্দীপনায় পূর্ব বঙ্গবাসী নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে ব্রতী হয়।

বঙ্গভঙ্গ-বিরােধী আন্দোলন :

বাঙলার হিন্দু সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গকে সহজে গ্রহণ করতে পারেনি। পশ্চিম বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী বঙ্গভঙ্গের বিরােধিতা শুরু করেন। জাতীয় কংগ্রেস বঙ্গভঙ্গ রদ করতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ছিল কলকাতা। সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, অরবিন্দ ঘোষ, বিপিণ পাল প্রমুখ নেতৃবর্গ বঙ্গভঙ্গ-বিরােধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।

মুসলমানদের শােষণ করা অবসান হয়ে যাবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে ভেবে কলকাতার বণিক, ব্যবসায়ী, জমিদার, আইনজীবী সকল সম্প্রদায়ের লােক হিন্দু নেতৃবৃন্দকে এ আন্দোলনে সমর্থন দেন। ক্রমে ক্রমে এটা সম্প্রদায়িক আন্দোলনে রূপ নেয়। পূর্ববঙ্গের মুসলমানেরা নবগঠিত প্রদেশটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য নওয়াব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গভঙ্গ-বিরােধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে রূপ নেয় ও স্বদেশী আন্দোলন নামে পরিচিত হয়।

স্বদেশী আন্দোলন :

বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন প্রতিবাদের পর্যায় অতিক্রম করে বয়কট আন্দোলনে পরিণত হয়। এ আন্দোলনে সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, মতিলাল ঘোেষ, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ প্রমুখ নেতৃবর্গ অংশগ্রহণ করেন। এ আন্দোলনে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে,

  • সকল অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট পদত্যাগ করবেন,
  • স্থানীয় সরকারের সকল সদস্য পদত্যাগ করবেন এবং
  • আগামী এক বছরকাল জাতীয় শােক দিবস পালন করা হবে।

বিলেতি পণ্যসামগ্রীর বিরুদ্ধে বয়কট’ প্রস্তাব গৃহীত হয়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কটও শুরু হয়। ধােপা, নাপিত, মুচি প্রভৃতি সমাজসেবীরা ইংরেজদের কোনােরূপ সেবা প্রদান করবে না। এ আন্দোলনে ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল-

  • (ম্যাঞ্চেস্টারে প্রস্তুত সুতিব বয়কট করা এবং
  • মৃত্থায় শিল্পগুলােকে পুনরুজ্জীবিত করা।

এ আন্দোলনের ফলে বিভিন্ন স্থানে কুটিরশিল্প এবং বৃহদায়তন শিল্প গড়ে ওঠে।

সন্ত্রাসী আন্দোলন :

স্বদেশী আন্দোলনের চরমপন্থীদের প্রচেষ্টায় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন সন্ত্রাসী আন্দোলনে রূপ নেয়। এ আন্দোলনের নেতা ছিলেন পুলিন দাস ও পুতুল গাঙ্গুলী। এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল সারাদেশে অগ্নিসংযােগ, লুঠতরাজ এবং রাজনৈতিক হত্যা। গভর্নর ফুলার সাহেবকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কুমিল্লায় নবাব সলিমুল্লাহর প্রাইভেট সেক্রেটারিকে প্রহার করা হয়। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষুদিরামকে ফাঁসি দেওয়া হয়।

বঙ্গভঙ্গ রদ

অবশেষে বর্ণবাদী ও কায়েমী স্বার্থবাদী হিন্দুদের তীব্র বিরােধিতা, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে জাতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় অংশগ্রহণ, স্বদেশী আন্দোলন, উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং সন্ত্রাসবাদীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে বিশাল সাম্রাজ্যবাদী এবং শক্তিশালী ব্রিটিশরাজ হিন্দুদের কাছে নতি স্বীকার করে বঙ্গভঙ্গ রদের পরিকল্পনা রচনা করেন। বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ-এর শাসন পরিষদের অন্যতম সদস্য স্যার জন জেনকিনস নতুনভাবে বাংলাদেশ পুনর্গঠনের প্রস্তাব করেন।

নতুন পরিকল্পনা অনুসারে প্রেসিডেন্সি, বর্ধমান, ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম-এ পাঁচটি বাংলা-ভাষাভাষী বিভাগ নিয়ে বাংলা প্রদেশ গঠনের সুপারিশ করা হয়। নতুন বাংলা প্রদেশের রাজধানী হয় কলকাতা। ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর দিল্লীর দরবারে সম্রাট পঞ্চম জর্জের রাজ্য অভিষেক উপলক্ষে আয়ােজিত এক অনুষ্ঠানে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘােষণা করা হয়। এ ঘােষণার ফলে ঢাকা শহর হারায় তার রাজধানীর গৌরব। বাংলাভাষাভাষী পাঁচটি বিভাগ নিয়ে গঠিত হয় নতুন বাংলা প্রদেশ।

বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিক্রিয়া

বঙ্গভঙ্গ রদ ঘােষণায় সকল শ্রেণীর হিন্দুরা খুব উল্লসিত হন। পূর্ব বাংলার মুসলমানেরা হতাশ হয়ে পড়েন এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। পূর্ব বাংলার মুসলমানদেরকে শান্ত করার জন্য বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ আশ্বাস দেন যে, ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা রচনার জন্য একটি সংস্থা গঠন করেন। বাংলার অনেক হিন্দু এ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন, বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ দেখা দেয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Accept !