ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা লাভের পর সর্বপ্রথম যে বিদ্রোহ সংঘবদ্ধভাবে সংঘটিত হয়েছিল তা ইতিহাসে ফকিরবিদ্রোহ নামে পরিচিত। ফকিররা ১৭৬০ সাল থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ করেছিলেন। ফকিরদের সাথে সন্ন্যাসীরাও সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন এবং কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহও করেছিলেন।
ফকির-সন্ন্যাসীদের পার্থিব বা বৈষয়িক কোনাে লােভ-লালসা ছিল না। তারা আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন থাকতেন। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর ফকির-সন্ন্যাসীরা এর ব্যতিক্রম ছিলেন। তাঁরা ভ্রাম্যমাণ সংঘে বিভক্ত ছিলেন। তারা একসঙ্গে সারা বছর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াতেন। তারা বর্শা, তরবারি ও বন্দুক বহন এবং কোনাে কাজে বাধাগ্রস্ত হলে এসব অস্ত্র ব্যবহার করতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজনৈতিক অশান্ত প্রতিকূল পরিবেশে ফকির-সন্ন্যাসীরা সামরিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন।
১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে নবাব মীর কাসিম ফকির-সন্ন্যাসীদের সাহায্য কামনা করেছিলেন। তারা তাঁর পক্ষে যুদ্ধও করেন। মীর কাসিম পরাজিত হলেন, কিন্তু তাঁরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসকবর্গ ফকির-সন্ন্যাসীদের স্বাধীনভাবে চলাফেরায় বাধা প্রদান করে এবং তাদেরকে দস্যু বলে চিহ্নিত করে। এসব কারণে কোম্পানির সরকারের পতন ঘটানাের জন্য তারা এক দীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। দরিদ্র কৃষক, বেকার সৈন্যদল এদের সঙ্গে যােগদান করে।
ফকির-সন্ন্যাসীদের মূল লক্ষ্য ছিল কোম্পানির কুঠি, জমিদারদের কাছারি ও নায়েব-গােমস্তাদের বাড়ি আক্রমণ করা। এছাড়া কোম্পানির বেনিয়াদের নৌকা আক্রমণ, সৈন্যদের রসদ পরিবহন বন্ধ করা এবং যােগাযােগ বিপর্যস্ত করা ইত্যাদিও ছিল কোম্পানির বিরুদ্ধে ফকির-সন্ন্যাসীদের গৃহীত ব্যবস্থা। ফকিরসন্ন্যাসীদের নেতৃত্বে ছিলেন যথাক্রমে মজনুশাহ ও ভবানী পাঠক। মজনুশাহ ও ভবানী পাঠকের নেতৃত্বে ফকিরদের বিদ্রোহ অব্যাহত থাকে। ১৭৬৩ সালে ফকিরগণ বরিশালে ইংরেজদের ওপর হামলা করেন। একই বছর তারা ইংরেজদের ঢাকা কুঠি আক্রমণ ও লুটপাট করেন। ইংরেজগণ পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। পরে তারা শক্তি বৃদ্ধি করে। ফকিরদেরকে পরাজিত ও বিতাড়িত করে কুঠি পুনরুদ্ধার করেন।
ফকিরগণ রাজশাহীর রামপুরে ইংরেজ কুঠি আক্রমণ এবং লুট করেন, তাঁরা এর এজেন্ট বেনেটকে ধরে নিয়ে যান এবং পরে হত্যা করেন। ১৭৬৭ ও ১৭৬৯ সালে ফকিরদের সঙ্গে কোম্পানির কয়েকটি সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ইংরেজ সেনাপতি মার্টল ও লেফটেন্যান্ট কিথ এবং আরাে অনেকে নিহত হয়। এ সাফল্যে ফকির ও সন্ন্যাসীদের উৎসাহ বেড়ে যায়। মজনুশাহের নেতৃত্বে ফকিরগণ রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ, ঢাকা, বীরভূম, মালদহ, পূর্ণিয়া প্রভৃতি স্থানে ইংরেজ-বিরােধী তৎপরতা শুরু করেন। ১৭৭৬ সালে তাঁরা মহাস্থানে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন।
১৭৮০ সালে মজনুশাহ বগুড়া জেলার করাইয়ের জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর কাছে ৫০,০০০ টাকা দাবি করেন। শ্রীকৃষ্ণ ভয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে অন্যত্র চলে যান। ১৭৮১ সালে মজনুশাহ মধুপুর জঙ্গলে আধিপত্য স্থাপন করেন। ১৭৮২ সালে চরকায়থ নামক স্থানে ইংরেজ সৈন্যদের সাথে ফকিরদের এক যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ফকিরগণ পরাজিত হন। ১৭৮৩ সালে লেফটেন্যান্ট ম্যাকডােনাল্ড সৈন্যদল নিয়ে এদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন।
দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ফকিরসন্ন্যাসীগণ পরাজিত হন। ১৭৮৭ সালে ফকির মজনুশাহের মৃত্যুর পর সুযােগ্য নেতৃত্বের অভাবে ফকির-আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। এ আন্দোলনের পরবর্তী নেতাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন চেরাগ আলী শাহ, পাগল শাহ, মাদার বখস, জারি শাহ, করিম শাহ, রওশন শাহ প্রমুখ।
কিন্তু এদের মধ্যে দলীয় কোন্দল শুরু হয়। অন্তদ্বন্দ্ব, কোন্দল, সাংগঠনিক দুর্বলতা, যােগাযােগের অভাব, ধর্মীয় ভেদাভেদ ফকির-আন্দোলনের পতন ত্বরান্বিত করে। এছাড়া কোম্পানির তকালীন উন্নততর রণকৌশল এবং সেনাবাহিনী বৃদ্ধির ফলে ফকির-আন্দোলনের পতন ঘটে ফকির-সন্ন্যাসীরা দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ এবং পেশাগত স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন।