পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বেশি সুযােগ-সুবিধা ভােগ করেছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানিদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার ভােগ করতে দেওয়া হয়নি। বরং রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে পাকিস্তান সরকার প্রথম থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করেছিল।
রাজনৈতিক বৈষম্য
পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবর্গের বিরােধিতার জন্য গণতন্ত্র উত্তরণের কোনাে প্রচেষ্টা করা হয়নি। লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়া হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা সমগ্র পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ জন হওয়া সত্ত্বেও এ অঞ্চল হতে জনসংখ্যা অনুপাতে কেন্দ্রীয় আইনসভা ও শাসন-ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্বের অধিকার দেওয়া হয়নি। ১৯৪৭-৫৮ সাল পর্যন্ত ৪ জন রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে মাত্র ১ জন। ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের এবং তিনিও ছিলেন উর্দুভাষী। এ সময়ে ৭ জন প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ৩ জন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের এবং এদের মধ্যে ১ জন ছিলেন উর্দুভাষী।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। কিন্তু। নানান অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানে হক সাহেবের নেতৃত্বে গঠিত প্রাদেশিক মন্ত্রিসভাকে পদচ্যুত করে পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় শাসন চালু করা হয়। ১৯৫৬ সালে যে শাসনতন্ত্র চালু হয়েছিল তা ১৯৫৮ সালে বাতিল করে সামরিক শাসন জারি করা হয়।
১৯৬২ সালে আইয়ুব খান রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার প্রবর্তন করে সারাদেশে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালির মুক্তির সনদ ছয়-দফা দাবি উত্থাপন করেন। সর্বস্তরের জনগণ ছয়-দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে দেশকে এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়।
প্রশাসনিক বৈষম্য
পাকিস্তানের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানিদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত নগণ্য। সামরিক, বেসামরিক ও অন্যান্য চাকরিতে নিয়ােগের ব্যাপারে বৈষম্য ব্যাপক ছিল। নিচে বৈষম্যের কিছু চিত্র তুলে ধরা হল :
বিভিন্ন বিভাগ | পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান |
কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিস | ৮৪% | ১৬% |
ফরেন সার্ভিস | ৮৫% | ১৫% |
বিদেশে মিশন প্রধান (সংখ্যা) | ৬০ | ৯ |
সৈন্যবাহিনী | ৯৫% | ৫% |
প্রধান সারির সেনা অফিসার (সংখ্যা) | ১৬ জন | ১জন |
পাইলট | ৮৯% | ১১% |
আর্মডফোর্স (সংখ্যা) | ৫০,০০০ | ২০,০০০ |
পাকিস্তান এয়ার লাইন্স (সংখ্যা) | ৭০০ | ২৮০ |
পি, আই, এ পরিচালক সংখ্যা | ৯ | এক জন মাত্র |
পি, আই, এ আঞ্চলিক ম্যানেজার সংখ্যা | ৫ | কেউ ছিল না |
রেলওয়ে বাের্ড পরিচালক | ৭ | এক জন মাত্র |
উৎস : Bangladesh Documents Part 1, Ministry of External Affairs, পৃষ্ঠা – ২০ |
১৯৬৬ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রশাসন ব্যবস্থায় পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যা ছিল নিম্নরূপ :
শ্রেণী | মােট | পশ্চিম পাকিস্তানের | পূর্ব পাকিস্তানের | শতকরা হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের |
১ম শ্রেণী | ২,৮১৬ জন | ২,১০৪ জন | ৭১২ জন | ২৩% |
২য় শ্রেণী | ৫,৯৫১ জন | ৪,৭১১ জন | ১,২৪০ জন | ২৬% |
৩য় শ্রেণী | ৭০,০০০ জন | ৫০,৭০০জন | ১৯,৩০০ জন | ২৭% |
৪র্থ শ্রেণী | ২৬,০০০ জন | ১৮,০০০ জন | ৮,০০০ জন | ৩০% |
১৯৪৭-৪৮ সাল থেকে ১৯৬৮-৬৯ সাল পর্যন্ত বেসামরিক খাতে পাকিস্তানে মােট ব্যয় হয়েছিল ৭১৮ কোটি টাকা। পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়েছিল ১৮৪ কোটি টাকা মাত্র।
অর্থনৈতিক বৈষম্য
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে তুলা উৎপাদনের কোনাে চেষ্টা করা হয়নি। মুদ্রা ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ছিল। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্টেট ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকসমূহের হেড অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে থাকায় অর্থ পাচার হত অবাধ গতিতে। উদ্বৃত্ত আর্থিক সঞ্চয় পশ্চিম পাকিস্তানে জমা থাকত। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে মূলধন গড়ে উঠতে পারেনি। পাকিস্তানের ১৯৪৭-৭১ সালের আর্থিক ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে নিম্নলিখিত চিত্র দৃষ্ট হয় :
১। পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশি মুদ্রা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে।
২। পূর্ব পাকিস্তান যে পরিমাণ আয় করত, সে পরিমাণ ব্যয় করতে পারত না।
৩। পূর্ব পাকিস্তানের পাট দিয়ে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হত, তা পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হত। পাট থেকে মােট বৈদেশিক মুদ্রার তিন ভাগের দুইভাগ অর্জিত হত।
৪। মােট বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের শতকরা ১০ ভাগ থেকে ১৫ ভাগ মাত্র খরচ হত পূর্ব পাকিস্তানে।
৫। মােট রাজস্বের শতকরা ৯৪ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ হত, বিদেশি মিশনসমূহ পশ্চিম পাকিস্তানে থাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের আয় বেড়েই চলছিল।
৬। পশ্চিম পাকিস্তানে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের দ্বিগুণ।
৭। পূর্ব পাকিস্তানে যেসব কলকারখানা তৈরি হয়েছিল তাদের মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। এ খাত থেকে যে আয় হত, তাও ব্যয় হত পশ্চিম পাকিস্তানে।
সামরিক বৈষম্য
প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিনটি সদর দপ্তর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। দেশরক্ষা বাহিনীর চাকরিগুলাে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের একচেটিয়া অধিকারে। পূর্ব পাকিস্তানে কোনাে অস্ত্রাগার তৈরি হয়নি। সামরিক বাহিনীতে শেষ পর্যন্ত যেসব পূর্ব পাকিস্তানি যােগদান করেছিল, তাদের সংখ্যা শতকরা দশের বেশি হয়নি।
সাংস্কৃতিক বৈষম্য
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব বাংলার ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে ধ্বংস করতে পাকিস্তান শাসকচক্র তৎপর হয়ে ওঠে। এ সম্বন্ধে ভাষা আন্দোলনে আলােচনা হয়েছে। এছাড়া পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানকে শিক্ষা, কৃষি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে শােষণ করেছিল।