বাংলা রচনা আমার শৈশব স্মৃতি

Preparation BD
By -
0

সংকেত: ভূমিকা; শৈশব কাল; আনন্দময় স্মৃতি; কিছু বেদনাদায়ক স্মৃতি; শৈশব স্মৃতির গুরুত্ব ও প্রভাব; উপসংহার

ভূমিকা

বয়স, সময় ও পরিস্থিতি প্রভৃতির বিবেচনায় মানুষের জীবনকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে মানুষকে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। যেমন: শৈশব থেকে মানুষ কৈশরে পদার্পণ করে, এর পর যৌবন চলে আসে এবং পরিশেষে বার্ধক্যে উপনীত হয়। এসব পর্যায়ের মধ্যে শৈশবকাল সবচেয়ে আনন্দময় এবং জীবনের বাকিটা সময় জুড়ে মধুর। স্মৃতি বহন করে। শৈশবকাল অতীত হয়ে গেলে চোখের সামনে শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত নানা দিনগুলাে ভেসে ওঠে। অন্যদের মতাে শৈশবকে ঘিরে আমারও অনেক স্মৃতি রয়েছে। সেসব স্মৃতিময় দিনগুলাে মনে হলে আমি কল্পনা প্রবণ হয়ে উঠি এবং শত ব্যস্ততার ভিড়ে শৈশবের স্মৃতিগুলাে খুঁজে ফিরি।

শৈশবকাল

শৈশবের সেই সােনালি সময়গুলাে আমার জীবন থেকে বিদায় গ্রহণ করলেও শৈশবের আবেগমাখা স্মৃতিগুলাে আমার হৃদয়-মাঝারে চির অম্লান। আমার শৈশব কেটেছে গ্রামে দাদার বাড়িতে। ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর থানা, গ্রামের নাম কাকনী। গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে প্রকৃতির সাথে আমার এক নিবিড় সম্পর্ক ছিল। পাখির গান আর এক চিলতে রােদের ঝলকানীতে ভােরবেলা আমার ঘুম ভাঙতাে। আমরা একান্নবর্তী পরিবারে বাস করতাম। সঙ্গত কারণেই আমাদের বাড়িটা ছিল বিশাল। আর বাড়িটার চারপাশে ছিল সবুজের সমারােহ এবং ফুল ফলের গাছে পরিপূর্ণ।

গ্রামের বাড়িতে আমরা দাদাদাদু, চাচা-চাচী ও ফুপীসহ অন্য আত্মীয়দের সাথে থাকতাম। ছােট বেলায় আমার খেলার সাথী ছিল আমার চাচাতে ভাইবােনগুলাে। ছােট বড় মিলে আমরা মােট দশ জন ছিলাম। যখন বড় ফুপীর ছেলে মেয়েরা। আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতাে তখন আমাদের আনন্দময় দিনগুলােতে একটা নতুন মাত্রা যােগ হতাে। সব ভাইবােনদের মধ্যে আমি ছিলাম সবার চেয়ে ছােট কিন্তু সব চেয়ে আদরের।

আমি সবার সাথে মিলেমিশে থাকতাম এবং পরিবারের সকলেই আমাকে খুব ভালােবাসতাে। শিশু সুলভ কোমলতা ও পবিত্রতার কারণেই এ সময় একজন মানব শিশু বড়দের কাছ থেকে আলাদাভাবে নজর কাড়তে পারে। আমি আমার শৈশব থেকে এখন যথেষ্ট দূরে কিন্তু যখনই গ্রামে ফিরে যাই শৈশবের স্মৃতি জড়িত স্থানগুলাে আমার মনকে দোলা দিয়ে যায় এবং শৈশবের স্মৃতিগুলাে আমার চোখের সামনে স্পষ্টভাবে ভাসতে থাকে। শৈশবকাল সত্যিই খুব সুখের।

আনন্দময় স্মৃতি

আমার শৈশবকালীন অসংখ্য আনন্দময় স্মৃতির মধ্যে প্রথমে যেটা মনে আসে তা হলাে আমার পুতুল খেলা। পুতুল দিয়ে খেলতে আমি খুব ভালােবাসতাম। বাবা শহর থেকে প্রতি সপ্তাহে যখন বাড়ি ফিরতেন তখন আমার জন্য নতুন নতুন বিভিন্ন ধরণের পুতুল কিনে আনতেন। আমার পুতুলগুলাের বিয়ে দেওয়া নিয়ে সে কি মহা আয়ােজন এবং যার পর নাই চিন্তা। এসব কথা এখন যখন মনে আসে তখন নিজের অজান্তে একাই হেসে উঠি। আমরা যতগুলাে চাচাতাে ভাইবােন ছিলাম সবাই বেশির ভাগ সময় দাদুর ঘরে ঘুমাতাম বিশেষ করে ছােটরা। দাদুর ঘরে মেঝেতে ঢালাও বিছানা এবং কে কার পাশে শােবে এ নিয়ে প্রতিদিনই লড়াই চলতাে। তবে আমি দাদুর পাশে ঘুমাতেই বেশি পছন্দ করতাম।

দাদু আমাকে একটু বেশিই ভালােবাসতেন এবং তার পাশে শুয়ে থাকতে পারার সুবাদে নানা রকম রূপকথার গল্প শুনতে পারতাম। আমি খুব ডানপিটে স্বভাবের ছিলাম। কারণ প্রতিদিনই চাচাতাে ভাইবােনদের সাথে নিত্য নতুন অভিযানে বের হতাম এবং এর ফলে আমার নাগাল পাওয়া আমার মায়ের পক্ষে খুবই দুষ্কর হতাে। শান বাঁধানাে পুকুর ঘাটে মা প্রতিদিন আমাকে গােসল করিয়ে দিতেন। সুযােগ পেলেই আমার অন্যান্য ভাইবােনদের সাথে পুকরে নেমে দু-একটা ডুব দিয়ে আসতাম। ঝড়ের দিনে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে আমি খুব পছন্দ করতাম। বৃষ্টি নামলে আমাকে যে ভিজতে দিতেই হবে একথা মা খুব ভালােভাবেই জানতেন। ঝড়ের মধ্যে আম কুড়াতে পারাটাকে একটা বিশাল অর্জন মনে করতাম।

আমি যদিও একটু দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম, স্কুলে পড়াশােনার দিক দিয়ে বাবা-মাকে সন্তুষ্ট রাখতে পারতাম। স্কুলের শিক্ষকদের কাছেও আমি খুব স্নেহভাজন ছিলাম। স্কুলেও আমার অন্য একটা জগৎ তৈরি হয়েছিল। আমার অনেকগুলাে বান্ধবী ছিল। তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী ছিল ময়না। যদিও ওর সাথে এখন আমার আর কোনাে যােগাযােগ নেই। ছােটবেলায় তখনও আমার রেল গাড়িতে ভ্রমণ করা হয়নি। এটাকে একটা রহস্যময় যানবাহন মনে করতাম। আমাদের গ্রামে ধান ক্ষেতের বুক চিরে বয়ে গেছে রেলপথ। হঠাৎ ট্রেন আসার শব্দ পেলে সব খেলা ছেড়ে ছুড়ে সবাই দৌড়ে আসতাম রেলগেটে। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে নানা রকমের মানুষ দেখতাম।

হকাররা অন্যান্য জিনিসপত্র ও খাদ্যদ্রব্য নিয়ে ট্রেনের আশেপাশে ঘােরাফেরা করত। মাঝে মাঝে এদের হাতে খাবার দেখে লােভ লাগতাে। এসব কথা এখন মনে হলে মনের অজান্তেই খুব লজ্জাবােধ করি। গ্রামে যখন কোনাে মেলা হতাে তখন চাচা আমাদের সব ভাইবােনকে মেলায় নিয়ে যেতেন। মেলায় গিয়ে নাগর দোলায় উঠা আর সার্কাস দেখা ছিল আমার প্রধান কাজ। মােট কথা সবার কাছ থেকে অনেক আদর পেয়েই আমি বড় হয়েছি। শৈশবের স্মৃতিগুলাে আজ পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের স্মৃতি বহন করছে।

কিছু বেদনাদায়ক স্মৃতি

আমার শৈশবকালের শেষের দিকে, যখন আমি ভালােভাবে সব কিছু বুঝতে শিখেছি, বাবা আমাকে আর মাকে নিয়ে শহরে চলে এলেন। এতদিনের মায়া মমতা ভরা স্মৃতি বিজড়িত জায়গা আর সবাইকে ছেড়ে আসার সময় আমার বুকের ভেতরটা ভীষণভাবে আহত হয়েছিল। আমার দুই। চোখের বাঁধ ভাঙা জল আমি সবার মাঝখানে থেকেও আড়াল করতে পারিনি। ঐ দিনটির কথা মনে পড়লে এখনও আমার খুব কষ্ট লাগে। দাদুর প্রয়াণেও আমি খুব কেঁদেছিলাম। যেহেতু তার সাথে আমার খুব ভালাে সম্পর্ক ছিল এবং অল্প হলেও কিছুটা সময় আমি তার সাথে হাসি আনন্দে অতিবাহিত করতে পেরেছিলাম। আর একটি বেদনাতুর ঘটনা হচ্ছে আমার এক চাচাতাে ভাই মিরাজের আকস্মিক মৃত্যু।

আমাদের গ্রাম থেকে বড় নদী খুব কাছেই ছিল। মিরাজ বাড়ির কাউকে না জানিয়ে ওর বন্ধুদের সাথে ঐ নদীতে গােসল করতে যায়। ভালােভাবে সাঁতার না জানার কারণে মাঝ নদীতে গিয়ে ডুবে যায় মিরাজ। অবশেষে নির্মম মৃত্যু। মিরাজের সাথে ঝগড়া আর মারামারিটা একটু বেশি হলেও সে আমার নিয়মিত খেলার সাথী ছিল, মাঝে মধ্যে প্রতিযােগীতাও হতাে। আর নিজের বিষয়ে বলতে গেলে বলা যায় একদিন বৃষ্টির মধ্যে সবাই মিলে হা-ডু-ডু খেলতে খেলতে খেলাচ্ছলে পড়ে গিয়ে পা টা মচকে গেল। এ নিয়ে বাড়িসুদ্ধ সবাই ভয়ে। অস্থির। পা মচকানাের ব্যথা নিয়ে অনেক দিন ঘরে বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছে এবং বাইরে অন্যদের সাথে খেলতে যেতে পারিনি। অন্য একদিনের ঘটনা ও বেশ মনে আছে।

তখন আমি নতুন নতুন স্কুলে যেতে শুরু করেছি। একদিন একা একা স্কুল থেকে ফিরে আসতে গিয়ে ভুল পথে পাশের গ্রামে চলে এসেছিলাম। আমি তখন খুব ছােট ছিলাম বলে ভয় পেয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করেছিলাম। আমার ভাগ্য ভালাে যে ছােট মামা মাকে দেখতে সেদিন ঐ পথ দিয়ে আসছিলেন। একা দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখে মামা আমাকে। কোলে তােলে নিলেন। তার পর বাসায় ফিরে আসতে পারলাম। দুঃখ-সুখের সংমিশ্রণেই আমার শৈশব কেটেছে। আনন্দের স্মৃতিগুলাের পাশাপাশি দুঃখে স্মৃতি ও আমার হৃদয়ে এখনও অম্লান হয়ে রয়েছে।

শৈশব স্মৃতির গুরুত্ব ও প্রভাব:

শৈশবকাল যতটা আনন্দময় ততটা গুরুত্বপূর্ণও বটে। শৈশবে একটি মানব শিশুর হৃদয় থাকে কোমল ও পরিষ্কার। পরিবেশ ও পরিস্থিতি তাদেরকে বিরাটভাবে প্রভাবিত করে। এ সময় শিশুদেরকে যেমন ইচ্ছা সেভাবে গড়ে তােলা যায়। শিশু যদি তার পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে সদগুণাবলির শিক্ষা লাভ করে তাহলে পরবর্তীতে সে সঠিক পথে জীবন পরিচালনা করতে পারে।

কোনাে বিষয় সম্পর্কে শৈশবে তাকে যে ধারণা দেওয়া হয় পরবর্তীতে মনের মধ্যে সে তাই লালন করে। সুতরাং আমাদের উচিত তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা করা, নিয়মিত ধর্ম চর্চা করার শিক্ষা দেওয়া, লেখাপড়ায় । মনােযােগী করা এবং বড়দের প্রতি সদাচরণের শিক্ষা দেওয়া। শৈশবের স্মৃতি মানুষ সহজে ভুলে না। তাই শিশুরা যাতে মনে কোনাে দুঃখ-কষ্ট না পায় সে দিকে নজর রাখতে হবে। শৈশবেই তাদেরকে এমন কিছু নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে যেন ভবিষ্যতে বড় মাপের সুশিক্ষিত মানুষ হওয়ার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয় সে।

উপসংহার:

শৈশবকাল খুব সংক্ষিপ্ত হলেও এর স্মৃতিজড়িত আবেগময় সময়গুলাে বর্ণনা ক না। আমার খেলার সাথী, আমার ভাই বােনগুলােও আমার মতাে বড় হয়ে গেছে কিন্তু শৈশবের স্মৃতিজড়িত আমার সেই গ্রামের বাড়ি, শান বাঁধানাে পুকুর ঘাট, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, সেই রেল গেট ঠিক আগের মতােই আছে। এখন শহর থেকে যখন গ্রামে বেড়াতে আসি ট্রেনে করে তখন সেই ছােটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। আর রেল গেটের কাছে ছােটছােট শিশুদের মতাে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভাবি একদিন এরাও আমার মতাে বড় হবে। শৈশব থেকে দূরে চলে যাবে এবং এ সবকিছুই স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Accept !