আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য

Preparation BD
By -
0

সংকেত: ভূমিকা, ভাষার পটভূমি, বাংলাভাষা, মাতৃভাষা কী, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবনা, প্রস্তাবের অনুমােদন, বাংলাদেশের কূটনৈতিক দক্ষতা, বাংলাদেশের প্রস্তাবনা, ৭ ডিসেম্বর ও বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিকতা, জাতীয় চেতনা, একুশের পটভূমি ও প্রতিক্রিয়া, উপসংহার

ভূমিকা

বাঙালির বীর সন্তানেরা মহাকালের বুকে একটি দিনকে উজ্জ্বল করেছে নিজ মহিমায় সে একুশে ফেব্রুয়ারি। একবিংশ শতকের প্রথম পাদে দাঁড়িয়ে সে এখন ঘরকুনাে কুমারী কন্যা নয়। ভাষার অভিযাত্রায় যে নতুন। বিশ্ব পথিক। বিশ্বের ১৮৮ টি দেশে এ পথিকের প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে একুশতম দিনটিতে চালাবে সশব্দ পদচারণা। শুনাবে সে আমাদের দামাল ছেলেদের গৌরবময় ইতিকথা।

ভাষার পটভূমি

ভাষা নিয়ে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে যায় পৃথিবীর বুকে। এজন্যেই সাধারণত একটি প্রশ্ন জাগে ভাষা কী? যার অন্তর্নিহিত শক্তি এত ব্যাপক যার জন্যে নিজ প্রাণ উৎসর্গ করতে এগিয়ে আসে বরকত সালামেরা। ভাষা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা হল এমন এক প্রক্রিয়া যা জড় থেকে মানুষকে সহজভাবে আলাদা করে। জড়ের পরে রয়েছে প্রাণের স্থান প্রাণের পরে মনের। এই মনের বিকাশেই মানুষের জন্ম। চিন্তা (Thinking) সংকল্প (willing) অনুভব (feeling)-তিনটি মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। এই তিনের সাধনায় মানুষ চায় তার নিজের আবেগ অনুভূতি অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে। ভাষা তার মাধ্যম। ভাষা বিজ্ঞানী হুইটনীর মতে-‘Language is a social institution, সাটেভান্টের সতে ‘A Languageis a system of arbitrary vocal symbols by which member of a social group co-operate and interact. বৈদিক ঋষিদের মতে-ভাষাকে কেউ দেখেও দেখে না কেউ শুনেও শুনে না কিন্তু সে অন্যের জন্য নিজের দেহ প্রকাশ করে পতির জন্য সুসজ্জিতা প্রেমময়ী জায়ার মতাে।

বাংলাভাষা

সবকিছু মিলে ভাষার সংজ্ঞা হলাে-মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারণরিত ধ্বনির দ্বারা স্পন্ন এমন শব্দ সমষ্টি যা স্বতন্ত্রভাবে জনসমাজে ব্যবহৃত। এই সংজ্ঞা অনুসরণ করে বলা চলে-যে ভাষায় কথা বলি সমাজে প্রচলিত তাই বাংলা ভাষা। যে ভাষা আমরা সকলে জানি, শুনি ও বুঝি, যে ভাষায় আমরা ভাবনা চিন্তা, সুখ-দুঃখ বিনা আয়াসে, বিনা ক্লেশে বহুকাল হতে প্রকাশ করে আসছি এবং সম্ভবত আরাে বহুকাল পর্যন্ত প্রকাশ করব, সেই ভাষাই বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষার অস্তিত্ব প্রকৃতিবাদ অভিধানের ভিতরে নয় বাঙালির মুখে।

মাতৃভাষা কী

পৃথিবীর প্রত্যেক দেশ জাতি গােষ্ঠীর মাতৃভাষা থাকে। শিশু মায়ের কাছ থেকে শুনে বড় হয়, যে ভাষার মাধ্যমে চিন্তা ইচ্ছা অনুভব প্রকাশ পায়, সে ভাষাই মাতৃভাষা। শিশুর যে সমাজ থাকে সেই সমাজও একইভাবে চিন্তা করে থাকে। ভাষাবিদ ড. ডেভিড ড্যালবি আফ্রিকার নাইজেরিয়া ও ক্যামেরুনের সীমান্তে ৮৭ বছরের এক বৃদ্ধার দেখা পান, যার কথা বােঝার মতাে কোনাে লােকই আর ছিল না। যিনি নিজের সঙ্গে আপন ভাষায় বিড় বিড় করতেন। সব দেশ সব জাতির মাতৃভাষাই প্রাথমিক ভাষা হিসেবে চিহ্নিত হয়। দ্বিতীয় ভাষাকে বলা হয় বিকল্প ভাষা। সারা বিশ্বের ১০০ কোটি লােক আজ মাতৃভাষা বা দ্বিতীয় বা বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করছে।

১৯৪৩ সালে অধ্যাপক আই এ রি চার্ড তার বেসিক ইংলিশ অ্যান্ড ইটম ইউসেস প্রবন্ধে ভবিষ্যত্বাণী করেছিলেন বিশ্বের অসংখ্য যােগবিন্দুতে ইংরেজি বা একধরনের ইংরেজি হবে সর্বচেয়ে ব্যবহারযােগ্য ভাষা। দিনের ২৪ ঘণ্টার পরিক্রমার মধ্যে কোনাে ভাষায় সবচেয়ে বেশিলােক কথা বলে তা নির্ধারণ করলে দেখা যাবে সূর্য যখন পশ্চিম প্রশান্ত মহাসগরে তখন সবচেয়ে ব্যবহৃত ভাষা হচ্ছে মান্দারিন। খন আটলান্টিকের ওপর তখন সবক্ষেত্রে ব্যবহৃত ভাষা হচ্ছে। ইংরেজি।

মান্দারিন ভাষা হচ্ছে চীনা ভাষার সবচেয়ে বােধগম্য লিখিত ভাষা পু-তুং হুয়া। এই ভাষা চীনের সরকারি ভাষা এবং ১১২ কোটি ৩০ লাখ লােক তা ব্যবহার করে। যুগল ভাষা হিসেবে চিহ্নিত হিন্দি, উর্দু, স্প্যানিশ, পর্তুগীজ, মালয় ও ইন্দোনেশিয়ান ভাষা পৃথিবীর বহু লােক ব্যবহার করছে। হিন্দি ও উর্দুর শ্রোতা প্রায় ১০০ কোটি হবে। ২০ কোটির ওপর সংখ্যা হবে যারা আরবি, বাংলা ও রুশভাষা ব্যবহার করেন। মাতৃভাষা আজ বিশ্ব মহাভাষায় রূপান্তর হয়েছে ১২টি ভাষা। যেমন: ইংরেজি, মান্দারিন, আরবি, বাংলা, হিন্দি, উর্দু, রুশ, স্প্যানিশ, পর্তুগীজ, মালয়, ইন্দোনেশিয়ান, জাপানি ও জার্মান। ক্ষুদে ভাষার সংখ্যা প্রায় ৮০।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অভাবনীয় দিন। এ দিন বাঙালির অমর একুশে শহীদ দিবস, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন ইউনেস্কো ২০০০ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউনেস্কোর সদস্য ১৮৮টি রাষ্ট্র এ দিন যথাযােগ্য মর্যাদায় দিনটি পালন করবে।

আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবনা

২৬ অক্টোবর থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত প্যারিসে ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেকের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করে। শিক্ষামন্ত্রী সম্মেলনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘােষণার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি ২১ ফ্রেব্রুয়ারির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের জন্য সদস্য দেশসমূহের সমর্থন চান। বাংলাদেশের প্রস্তাবের পক্ষে পাকিস্তান সহ ২৮টি দেশ লিখিতভাবে সমর্থন জানায়। প্রস্তাব সমর্থনকারী অন্য ২৭টি দেশ হলাে-সৌদি আরব, ওমান, বেনিন, শ্রীলংকা, মিশর, রাশিয়া, বাহামা, ডােমিনিকান রিপাবলিক, বেলারুশ, ফিলিপাইন, আইভরিকোস্ট, ভারত, হুন্ডুরাস, গাম্বিয়া, মাইক্রোনেশিয়া, ভানুয়াতু, ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, কমােরস, ইরান, লিথুয়ানিয়া, ইতালি, সিরিয়া, মালয়েশিয়া, স্লোভাকিয়া এবং প্যারাগুয়ে।

প্রস্তাবের অনুমােদন

ইউনেস্কোর সর্বাধিক ক্ষমতাশালী সংস্থা কমিশন-২ এ বাংলাদেশের প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয় ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রস্তাব নং ৩০/সি/ডি আর ৩৫ উত্থাপিত হলে বিনা আপত্তিতে তা গৃহীত হয় এবং অনুমােদিত হয়। ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের মাতৃভাষার জন্য অভূতপূর্ব আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ এবং সেদিন যারা প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘােষণার প্রস্তাব করা হচ্ছে।

প্রস্তাব গৃহীত হবার পর দিবসটি পালনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বলা হয়। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে। শক্তিশালী হাতিয়ার। মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্য ও বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবে না, তা ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উন্নয়ন ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। পারস্পরিক বােঝাপড়া, সহনশীলতা ও সংলাপের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ব সংহতি আরাে জোরদার হবে। প্রস্তাবে আরাে বলা হয়-“মাতৃভাষার উন্নয়ন ও বিস্তারের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘােষণার মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলাে এবং ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে নানা কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করা।

বাংলাদেশের কূটনৈতিক দক্ষতা

ইউনেস্কোর কমিশন-২ এ বাংলাদেশের প্রস্তাবটি আলােচনা কালে কয়েকটি পশ্চিমাদেশ নতুন একটি দিবস উদ্যাপনের ক্ষেত্রে অর্থ যােগানের ব্যাপারে প্রশ্ন তােলে। তাঁদের মতে একটি দিবস উদ্যাপনের জন্য কমপক্ষে ১ লাখ মার্কিন ডলার খরচ হয়। কিন্তু বাংলাদেশের কূটনৈতিক দক্ষতা এক্ষেত্রে ছিল প্রশংসনীয়। এ ব্যাপারে ফ্রান্সে নিযুক্ত বালাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মােয়াজ্জেম হােসেনের ভূমিকা ছিল অনন্য।

ইউনেস্কোর মহাপরিচালকের বিশেষ উপদেষ্টা তােজাম্মেল হক টনির অবদানও বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। আরাে যাদের নাম এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য তাঁরা হলেন ড. সাদাত হােসেন ও সাইদুর রহমান খান। বাংলাদেশের কূটনৈতিক দৃঢ়তা ও অখণ্ডনীয় যুক্তির পর দিবসটি পালনের ব্যাপারে আর কোনাে মত বিরােধ দেখা দেয় নি। তাঁরা ইউনেস্কোর সম্মেলনে উপস্থিত দেশ সমূহের প্রতিনিধিদের বােঝাতে সক্ষম হন যে, এই প্রস্তাবটি পাস হলে ইউনেস্কোর বর্তমান বাজেটের উপর কোনাে বাড়তি চাপ পড়বে না। সদস্য রাষ্ট্রগুলাে যার যার সাধ্যমতাে দিবসটি নিজ নিজ দেশে পালন করবে।

বাংলাদেশের প্রস্তাবনা

একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘােষণার প্রস্তাব দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নিতে অনুরােধ জানিয়েছিল কানাডা প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ অব দি ওয়াল্ড’। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রদত্ত সংক্রান্ত বিষয়টি জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিলে শেখ হাসিনা তা অনুমােদন করেন। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব ইউনেস্কো সদর দপ্তরে পাঠানাে হয়। প্রস্তাবনায় বলা হয়, আমরা আশা করব ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর ছােট ছােট দেশ ও জনগােষ্ঠীর মাতৃভাষা যথাযােগ্য সম্মান ও মর্যাদা লাভ করবে।

আমাদের মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় শহীদদের আত্মত্যাগকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় অভিষিক্ত করে জাতিসংঘের এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। আমাদের চির ঋণী করেছে। এ ব্যাপারে অবশ্যই ইউনেস্কো ধন্যবাদ পেতে পারে। বিশ্বের ১৮৮ টি দেশে প্রতিবছর বাংলাদেশের শহীদ দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি কেবল ঢাকার শহীদ মিনারেই নয়, বরং পৃথিবী জুড়ে মর্যাদার সঙ্গে পালিত হবে। সে সব দেশের জনগণ নতুন করে জানতে পারবে কীভাবে সালাম, রফিক, । বরকত, জব্বার নিজেদের অমূল্য প্রাণের বিনিময়ে মাতৃভাষাকে রক্ষা করেছেন। কানাডাং বাংলার নতুন রফিক সালাম (রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম) সেদেশের ভ্যাঙ্কুবারে বসে দুনিয়ার মাতৃভাষার উন্নতিকল্পে এই সমিতিটি গঠন করেন। মূলত তাঁদের উদ্যোগেই বাংলাদেশ পেল পৃথিবীতে এমন বিরল সম্মান।

৭ ডিসেম্বর ও বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিকতা

বাঙালির রক্তস্নাত ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসের পথপরিক্রমায় মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘােষিত হওয়ায় ৭ ডিসেম্বর সারাদেশে উজ্জ্বল আনন্দ, আর আবেগঘন পরিবেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উৎসব পালন করা হয়। ভাষা উৎসব দেশবাসীকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছিল। অনেক দিন বাঙালি এমন দলমত নির্বিশেষে উৎসবের আমেজ পায় নি। সেই উৎসবমুখর বাঙালিদের দেখে কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজীর মতাে যেন সকলের বাময়তা ফুটে উঠেছে।

ফেব্রুয়ারি কোনাে মাস নয়, কোনাে দিন নয়।
কোনাে গ্রাম নয়, কোনাে পথ নয়
কোনাে ফুল নয়, কোনাে গাছ নয়
আকাশও নয় নদীও নয়
পঞ্চান্ন হাজার বর্গ মাইলে
অবিরাম কথা বলা।
জাতীয় চেতনা

একুশে ফেব্রুয়ারিতে সালাম বরকত, রফিকের বুকের রক্ত বৃথা যায় নি। ইতিহাস তার মূল্য দিয়েছে। শুধু বাংলা ভাষাকেই আমরা মাতৃভাষা হিসেবে পাই নি বরং একুশের চেতনার যে বীজ সেদিন রােপণ করা হয়েছিল তার বিশাল মহীরুহ পরবর্তীতে মহান স্বাধীনতার স্নিগ্ধ ছায়ায় বেড়ে উঠেছে। কবি শামসুর রহমানের ভাষায়

আবার ফুটেছে দ্যাখ কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে
কেবল নিবিড় হয়ে কখনও মিছিলে কখনও বা
একা হেঁটে যেতে মনে হয়, ফুল নয় ওরা
শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগল্পে ভরপুর
একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ

একুশের পটভূমি ও প্রতিক্রিয়া

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সায়ত্তশাসন তথা স্বাধীনতার প্রস্তাব নিয়ে কেবিনেট মিশন আসে ভারতে। পাকিস্তানের জন্ম, সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠালগ্নের অব্যবহিত পূর্বে বিশেষ করে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব করেন। পূর্ববঙ্গ থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ প্রস্তাবের বিরােধিতা করে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে বাংলার দাবি উত্থাপন করেন (১২ শ্রাবণ ১৩৫৪)।

এভাবেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিতপূর্বে রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে বিতর্কের ভূমিকা হয়েছিল। এ ইতিহাস এখানেই থেমে থাকে নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার (১৯৪৭) পর পূর্ববাংলা তথা সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলা হবার পরও তখন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে পাকিস্তানি শাসক চক্র দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলে। তার প্রমাণস্বরূপ তারা পাকিস্তানের ডাকটিকিটে এবং মানি অর্ডারে উর্দু এবং ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সংস্কৃত এবং ল্যাটিনের মত মৃত ভাষা সে সময় স্থান হলেও আশ্চর্যের বিষয় বাংলায় বাংলা ভাষার স্থান হয় নি। এরপর ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি করাচির গণপরিষদে সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষার পক্ষে বক্তব্য রাখলেও কোনাে ফল হয় নি। এর প্রতিক্রিয়ায় ১১ মার্চ সংগ্রাম পরিষদ ধর্মঘটের আহ্বান করে।

১৯৪৮ সালে জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় এসে রেসক্ৰোর্স ময়দানে উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে বলে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করলে প্রকাশ্যে ছাত্র ঘড় ঘড় প্রতিধ্বনি তুলে। তারপর ১৯৪৮ সালের ১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৫১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক সরকার নূরুল আমিনের কাছে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এক স্মারকলিপি পেশ করা হয়। কিন্তু ফল আসে নি তাতেও। পাকিস্তানি শাসক বর্গ বাঙালির প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে স্বীকৃতি দিয়ে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে তৎপর হয়। ১৯৫২ সনের ৩০ জানুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঢাকার এক জনসভায় জিন্নাহর মতােই ঘােষণা দেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। এই ঘােষণার প্রতিবাদে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট, ১০ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপি ধর্মঘটের আহ্বান জানানাে হয়। সারা দেশ জুড়ে তখন আন্দোলন, মিছিল আর প্রতিবাদ।

একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সন। উতলা বসন্তের প্রথম ফাগুনের এই দিনটি বাঙালির জীবনে বসন্ত বন্দনা হয়ে উঠল না হয়ে উঠল মৃত্যুর বিভীষিকার আয়ােজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ ও জনতা স্বৈরাচারী শাসক গােষ্ঠীর জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। অন্যদিকে শােষক শাসকের বরকন্দাজ সঙ্গিন হাতে রাজপথে পার্শ্ব নগ্ন থাবা বিস্তার করে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ছাত্র জনতা ১৪৪ ধারা অমান্য করার প্রয়াসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সমবেত হতে শুরু করে।

সরকারের অন্যায় অত্যাচারের দমন-পীড়নের প্রতিবাদে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রতিবাদ মিছিল বের করে। এই মিছিল। প্রতিহত করার জন্য পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে। এতে পরিস্থিতি উত্তেজনাকর হয়ে পড়ে। তখন প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন চলছিল। ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শন করার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের গেট দিয়ে বেরিয়ে পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হয়। আচমকা ঘাতকচক্রের অবিশ্রান্ত গুলি কাঁদানে গ্যাস বর্ষিত হয় মাতৃভাষাপ্রেমী ছাত্র জনতার উপর। এর ফলে বরকত রফিক জব্বারসহ অগণিত ছাত্র ও যুবকের মর্মন্তুদ মৃত্যু ঘটে। তৎকালীন সরকারের এই নারকীয় তাণ্ডবে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় বইতে থাকে। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এবং সমগ্র বাংলাদেশ প্রচণ্ডভাবে বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। আতঙ্কিত সরকার অবশ্য পরিণামে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ১৯৫৬ সালের তৈরি পাকিস্তানের সংবিধানে। কিন্তু কূটচাল তাদের বন্ধ হয় না। বাঙালিরাও সেই বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিকে অমর করে রাখে। কবি সাহিত্যিকগণ প্রতিবার সরকারের প্রতি ঘৃণার বিদ্বেষ ঢালতে থাকে।

একুশকে নিয়ে প্রথম কবিতা আমরা এখানে কাঁদতে আসিনি। লিখেছিলেন মাহবুবুল আলম চৌধুরী। তার কবিতাংশ – যে শিশু আর কোন দিন তার পিতার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযােগ পাবে না। যে গৃহবধূ আর কোন দিন তার স্বামীর প্রতীক্ষায় আঁচলে প্রদীপ ঢেকে দুয়ারে আর দাঁড়িয়ে থাকবে না, যে জননী খােকা এসেছে বলে উদ্দাম আনন্দে সন্তানকে আর জড়িয়ে ধরতে পারবে না, যে তরুণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে বার বার একটি প্রিয়তমার ছবি চোখে আনতে চেষ্টা করছিল, তাদের সবার নামে আমি শাস্তি দাবী করতে এসেছি।

উপসংহার

ব্যর্থ হয়নি কবিদের কবিতা, ছাত্রের ত্যাগ জনতার আকাঙ্ক্ষা- একুশের ধারা ক্রমে আমরা পেয়েছি ত্রিশলক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ আর দু’লক্ষ মা-বােনের সম্ভ্রম বিকিয়ে মহান স্বাধীনতা। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলা ভাষা তথা বাঙালিরা যে অর্জন পেয়েছি তা যেন আত্মকলহের নিঃসারবিড়ম্বনায় ফুড়িয়ে না যায়। চাই একতা। সুশীল সমাজের স্বপ্ন। স্বপ্ন ব্যর্থ হয় না। ভাষা আন্দোলন আমাদের শিখিয়েছে। মাতৃভাষার মান উন্নত করার সংকল্প ব্যক্ত করে আগামী দিনে এই অর্জনকে নিয়ে যেতে হবে অনেক দূরে। মায়ের কোলের মতাে নিরাপদ করতে হবে আমাদের বাংলাকে। ছড়াকারের ভাষায়

তবেই বলতে পারব
কাটালাে বুঝি আপদ এবার
শঙ্কা শত ভয়
মায়ের কোলে একুশ এলাে
বিশ্ব করে জয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Accept !