নববর্ষ আর পহেলা বৈশাখ এক সুরে বাঁধা। সব ধর্মের, সব শ্রেণির মানুষের প্রাণের উচ্ছাস বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করেই প্রস্ফুটিত হচ্ছে। এ কারণেই বাঙালির সর্বজনীন ও সবচেয়ে বড় উৎসব বাংলা নববর্ষ।
বঙ্গাব্দের ইতিকথা
বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষের একটি ঐতিহ্যবাহী সৌর পঞ্জিকাভিত্তিক বর্ষপঞ্জি। কখন, কোথায় কীভাবে এর বিস্তার তা নিয়ে রয়েছে মতভেদ। অনেকেই মনে করেন, সম্রাট আকবরের আমলেই বাংলা সনের উৎপত্তি। আবার কেউ কেউ বলেন, স্বাধীন বাংলার সুলতানরা এর সূচনা ঘটান। আবার কারাে মতে, শশাঙ্ক বা আরও পুরােনাে কোনাে রাজার কীর্তি এ বাংলা সন।
উৎপত্তি
বাংলা সনের প্রবর্তন করেন মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মােহাম্মদ আকবর। তিনি খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য তার সভার জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীর সহযােগিতায় ১৫৮৪। সালে ‘তারিখ-এ-এলাহি’ নামে নতুন একটি বছর গণনা পদ্ধতি চালু করেন। এটি কৃষকদের কাছে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত হয়, যা পরে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ’ নামে প্রচলিত হয়ে ওঠে। ঐ সময়ে প্রচলিত রাজকীয় সন ছিল ‘হিজরি সন’, যা চন্দ্রসন হওয়ায় প্রতি বছর একই মাসে খাজনা আদায় সম্ভব হতাে না। বাংলা সন শূন্য থেকে শুরু হয়নি, যে বছর বাংলা সন প্রবর্তন করা হয়, সে বছর হিজরি সন ছিল ৯২৩। সে অনুযায়ী, সম্রাটের নির্দেশে প্রবর্তনের বছরই ৯২৩ বছরে যাত্রা শুরু হয় বাংলা সনের। এ ব্যাপারে ১০ মার্চ মতান্তরে ১১ মার্চ ১৫৮৪ সম্রাটের নির্দেশনামা জারি হয়। তবে এর। কার্যকারিতা দেখানাে হয় ১৫৫৬ সাল থেকে। কারণ ঐ সালটি ছিল সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরােহণের বছর।
বাংলা সনের মাস
শক রাজবংশকে স্মরণীয় করে রাখতেই ৭৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রবর্তিত শকাব্দ (শক বর্ষপঞ্জির) থেকে বাংলা সনের নামগুলাে এসেছে। বিভিন্ন তারকারাজির নামে বাংলা মাসগুলাের নামকরণ করা হয়। সেগুলাে বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রাইহনী থেকে অগ্রহায়ণ, পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফল্গুনি থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র।
১৭ অক্টোবর ২০১৯ নতুন করে কার্যকর করা বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে
- ৩১ দিন
- বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন,
- ৩০ দিন
- কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, চৈত্র
- ২৯ দিন
- ফালুন (গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জিতে Leap Year হলে ৩০)
নববর্ষ উদ্যাপন
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ও তার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষের ছুটি ঘােষণা করেন। ৭ অক্টোবর ১৯৫৮ আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি হওয়ায় তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ১৯৬৪ সালে বাঙালি জাতীয় চেতনার তীব্র চাপে প্রাদেশিক সরকার বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘােষণা করে। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এ বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।
মঙ্গল শােভাযাত্রা
বাংলাদেশের জনগণের লােকজ ঐতিহ্যের প্রতীক মঙ্গল শােভাযাত্রা। দেশের লােকজ সংস্কৃতি উপস্থাপনের মাধ্যমে সব শ্রেণির মানুষকে একত্র করার লক্ষ্যে ১৯৮৫ সালে যশােরে ‘চারুপীঠ’ নামের একটি সংগঠন প্রথমবারের মতাে। বর্ষবরণ করতে আনন্দ শােভাযাত্রার আয়ােজন করে। নান্দনিক সে শােভাযাত্রা দেশব্যাপী আলােড়ন তৈরি করে। যশােরের সে শােভাযাত্রার পর ১৯৮৯ সালে ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে আয়ােজন করা। না হয় প্রথম আনন্দ শােভাযাত্রার। ১৯৯৫ সালের পর থেকে। এ আনন্দ শােভাযাত্রাই মঙ্গল শােভাযাত্রা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। শিল্পী ইমদাদ হােসেন মঙ্গল শােভাযাত্রার নামকরণ করেন। ৩০ নভেম্বর ২০১৬ জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (UNESCO)-এর নির্বম্ভক বা অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায় বাংলা নববর্ষ বরণের বর্ণিল উৎসব মঙ্গল শােভাযাত্রা’।
১৪ এপ্রিল
বাংলা একাডেমির উদ্যোগে বিশিষ্ট ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ১৯৬৩ সালে বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার। কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে এ কমিটি ‘শহীদুল্লাহ কমিটি’ নামে আখ্যায়িত হয়। এ কমিটি ১৪ এপ্রিলকে পহেলা বৈশাখ নির্ধারণের সুপারিশ করে। পরবর্তীতে বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কার কমিটি’ নামে আরেকটি কমিটির সুপারিশের আলােকে বাংলা একাডেমিতে ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪ (বাংলা ২৮ ভাদ্র ১৪০১) অনুষ্ঠিত সভায় ১৪ এপ্রিলকে পহেলা বৈশাখ হিসেবে ধার্য করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর ১৩ আগস্ট ১৯৯৫ (২৯ শাবণ ১৪০২) এ দু’সভার মাধ্যমে গঠিত টাস্কফোর্স ১ বৈশাখ ১৪০২ থেকে, অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল ১৯৯৫ থেকে এটি কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবেই পহেলা বৈশাখরূপে (শুভ। নববর্ষ) প্রতিবছরই পালন করা হয় ১৪ এপ্রিল।