কেন্দ্রীয় শহিদমিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও জাতীয় সংসদ ভবন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলাের প্রধানতম । ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে জাতীয় চেতনার আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর বুক চিরে বাংলাদেশ নামক একটি দেশের জন্ম দিয়েছিল। ১৯৪৭ সালে নতুন স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীন পাকিস্তানের পথচলা শুরু হলেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিকসহ সার্বিক বিবেচনায় পাকিস্তানের দুই অংশের বিভাজন ছিল স্পষ্ট ।
২৩ বছরের শাসনে পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকেরা হাজারাে রকম বৈষম্যের শিকার হয়েছিল । ফলশ্রুতিতে এ দেশের জনগণ পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে দুর্বার গণআন্দোলন করে ১৯৭১ সালে মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। এর পূর্বে ১৯৫২ সালে এ দেশের ছাত্র-জনতা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে নিজেদের জীবনকে যে উৎসর্গ করেছিল, তাদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে প্রতিষ্ঠা করা হয় কেন্দ্রীয় শহিদমিনার ।
১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত স্বাধিকার আন্দোলনের যে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব রয়েছে তার স্বাক্ষ্য বহন করছে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। স্বাধীনতার পরে জাতীয় সংসদ ভবন হয়ে ওঠে দেশ পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু। নিচের আলােচনায় এসব স্থাপনার গুরুত্ব তুলে ধরা হলাে :
কেন্দ্রীয় শহিদমিনার :
ভাষাশহিদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে নিহত শহিদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার উদ্দেশ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে এই স্তম্ভ নির্মিত হয়, যা বর্তমানে ‘ কেন্দ্রীয় শহিদমিনার’ নামে পরিচিত। শহিদমিনারটি প্রথম নির্মিত হয় ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি । এর পরিকল্পনা, স্থান নির্বাচন ও নির্মাণকাজ সবই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে সম্পন্ন হয়।
আরো পড়ুন : বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতিতে বরেন্দ্র অঞ্চল এবং বরেন্দ্র জাদুঘরের গুরুত্ব
বর্তমান শহিদমিনারের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে শহিদদের রক্তভেজা স্থানে সাড়ে ১০ ফুট উঁচু এবং ৬ ফুট চওড়া ভিত্তির ওপর ছােট স্থাপত্যটির নির্মাণকাজ শেষ হলে এর গায়ে শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ’ লেখা একটি ফলক লাগিয়ে দেওয়া হয়। নির্মাণের পরপরই এটি শহরবাসীর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে; প্রতিবাদী আন্দোলনের প্রতীকী মর্যাদা লাভ করে। এখানে দলে দলে মানুষ এসে ভিড় জমায়। ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন আনুষ্ঠানিকভাবে শহিদমিনার উদ্বোধন করেন।
কেন্দ্রীয় শহিদমিনারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
১. স্বাধীনতার প্রথম আন্দোলনের সাক্ষী : পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর শােষণের কবল থেকে মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এ আন্দোলন বাঙালি জাতির মাঝে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করে। সমগ্র জাতিকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে শেখায়। এ আন্দোলনের শিক্ষা পরবর্তীতে বাঙালি জাতিকে ১৯৭১ সালে মুক্তির সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে সাহায্যে করে।
২. ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক : ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা মেডিক্যালের সামনে থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল বের করে। মিছিল সামান্য অগ্রসর হতেই পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। নিহত হয় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বরসহ আরাে নাম না জানা অনেকে। প্রতি বছর সমগ্র জাতি ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদমিনারে খালি পায়ে ভাষাশহিদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। তাই এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ :
১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা শহর থেকে ২৫ কিলােমিটার দূরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে নবীনগরে এই স্মৃতিসৌধের শিলান্যাস করেন। পরবর্তী ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্মৃতিসৌধটি নির্মাণের উদ্যাগ গ্রহণ করেন এবং নকশা আহ্বান করেন। ১৯৭৮-এর জুন মাসে প্রাপ্ত ৫৭টি নকশার মধ্যে সৈয়দ মাইনুল হােসেন প্রণীত নকশাটি গৃহীত হয়। ১৯৭৯ সালে মূল স্মৃতিসৌধের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৯৮২ সালে বিজয় দিবসের অল্প পূর্বে সমাপ্ত হয়।
জাতীয় স্মৃতিসৌধের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি পর্যায় নির্দেশক : ঢাকার অদূরে সাভারের নবীনগরে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাতটি ধারাবাহিক পর্যায়কে নির্দেশ করে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ- এই সাতটি ঘটনাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিক্রমা হিসেবে বিবেচনা করে নির্মিত হয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ।
আরো পড়ুন : বাংলাদেশের নিষ্ক্রিয় ব-দ্বীপসমূহ বলতে কী বোঝেন?
২. মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি হয়। জাতীয় স্মৃতিসৌধ বাংলাদেশের জনসাধারণের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের স্মরণে নিবেদিত এবং মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের প্রতি জাতির শ্রদ্ধার উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর সমগ্র বাংলাদেশী মুক্তিযুদ্ধের সকল শহিদের প্রতি জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
জাতীয় সংসদ :
জাতীয় সংসদ ভবন রাজধানী ঢাকার শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত। এ অসাধারণ। স্থাপত্যের জন্য জাতি গর্বিত। পিরামিডের সময় থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ব্যাপ্ত স্থাপত্যসমূহের যদি একটি বাছাই তালিকা করা হয় তবে এর মাঝেও বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন উপরের সারিতেই স্থান পাবে। বলা যায়, এটি আধুনিক যুগের স্থপত্যরীতির সর্বোকৃষ্ট নিদর্শন এবং এর মাধ্যমে সূচিত হয় আধুনিকোত্তর যুগের স্থাপত্যরীতির। এ অসাধারণ ভবনটি আমেরিকার স্থপতি লুই আই কান-এর সৃষ্টিশীল ও কাব্যিক প্রকাশের নিদর্শন।
১৯৫৯ সালে প্রথম ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেক্সটির পরিকল্পনা গৃহীত হয়। তকালীন সামরিক সরকার পাকিস্তানের প্রস্তাবিত দ্বিতীয় রাজধানী শেরে বাংলা নগরে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংসদ ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে বর্তমান সংসদ ভবনটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তখনকার খ্যাতনামা স্থাপতি লুই কানকে ভবন কমপ্লেক্সটির নকশা প্রদানের জন্য বলা হয় এবং ১৯৬২ সালের মার্চ মাসে তিনি আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পান।
আরো পড়ুন : বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতিতে প্রবাল দ্বীপের গুরুত্ব কী?
১৯৬১ সালে বর্তমান মানিক মিয়া এভিনিউ-এর উত্তর পার্শ্বে ২০৮ একর জমি দ্বিতীয় রাজধানী প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয় এবং ১৯৬২ সালে মূল নকশা প্রস্তুত হয়। ১৯৬৪ সালে ১৫ মিলিয়ন ডলারের অনুমিত ব্যয় ধরে কমপ্লেক্সটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সমস্ত সুবিধাদিসহ ৩২ মিলিয়ন ডলারের পরিবর্তিত ব্যয়ে কমপ্লেক্সটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৮২ সালে । কমপ্লেক্সটির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে মূল সংসদ ভবন, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও সচিবদের হােস্টেল, অতিথি ভবন ও কমিউনিটি বিল্ডিং রাস্তা, হাটার পথ, বাগান ও লেক দ্বারা এ সব কিছুই আকর্ষণীয় কর তােলা হয়েছে।
জাতীয় সংসদ ভবনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
১. আইন প্রণয়ন স্থল : জাতীয় সংসদ ভবনে সংসদ সদস্যগণ দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন করেন। বাংলাদেশের আইনসভা জাতীয় সংসদের সকল কার্যকলাপ পরিচালিত হয় এ ভবনকে কেন্দ্র করে । তাই জাতীয় সংসদ ভবনের গুরুত্ব অপরিসীম।
২. শপথ গ্রহণ স্থল : বাংলাদেশের জনগণের ভােটে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ জাতীয় সংসদ ভবনে শপথ গ্রহণ করেন । দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, স্পিকারসহ মন্ত্রিপরিষদের সকল সদস্য এ পবিত্র ভবনে রাষ্ট্র সঠিকভাবে পরিচালনা এবং স্বীয় দাযিত্ব যথার্থভাবে পালনের শপথ গ্রহণ করেন। তাই বাংলাদেশের ইতিহাসের এ ভবনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য ।
শেষ কথায় বলতে পারি, ভাষা আন্দোলনের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিদর্শন, স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রতীক এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের সকল গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়নস্থল হিসেবে যথাক্রমে জাতীয় শহিদমিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং জাতীয় সংসদ ভবনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।