বাংলাদেশের ভৌগােলিক নির্দেশক (GI) পণ্য এখন ১০টি

Preparation BD
By -
0

কোনাে একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়া ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা এবং সেখানকার জনগােষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনাে একটি পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে সেই দেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ববিষয়ক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রােপার্টি অর্গানাইজেশন। সংশ্লিষ্ট দেশের আবেদন, অন্যান্য দেশের অনাপত্তি এবং সংস্থাটির সার্বিক যাচাইবাছাইয়ের ভিত্তিতে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ১০টি পণ্য এই স্বীকৃতি পেয়েছে। সর্বশেষ গত ১৮ মে ২০২২ শিল্প মন্ত্রণালয় বাগদা চিংড়ির জিআই সনদ (ভৌগােলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি) পাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘােষণা দিয়েছে।

জামদানি

বাংলাদেশের প্রথম ভৌগােলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় জামদানি শাড়ি। ২০১৬ সালের ১৭নভেম্বর আসে এই স্বীকৃতি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপােরেশন (বিসিক) পায় জামদানির জিআই স্বত্ব। বাংলাদেশই যে জামদানির জিআই স্বত্ব পাওয়ার একমাত্র যােগ্য দাবিদার, এর পক্ষে জোরালাে যুক্তিপ্রমাণসহ নিবন্ধ প্রকাশ করে বাংলাদেশ। প্রাচীন ভারতীয় অর্থশাস্ত্রবিদ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, ১৪ শতকের মুসলিম পরিব্রাজক ইবনে বতুতার লেখা কিংবা অন্যান্য গবেষণাপত্রে জামদানির আদি উৎস হিসেবে ঢাকাকেই উল্লেখ করা হয়েছে।

ইলিশ মাছ

বাংলাদেশের দ্বিতীয় নিজস্ব পণ্য হিসেবে ভৌগােলিক নির্দেশক বা জিআই স্বীকৃতি পায় ইলিশ। ২০১৭ সালের ৬ আগস্ট WIPO জাতীয় মাছ ইলিশকে বাংলাদেশি পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের কথা ঘােষণা করে। ওয়ার্ল্ড ফিশের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের মােট ইলিশের ৮৬ শতাংশই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। বিগত কয়েক বছরে অন্যান্য দেশে ইলিশের উৎপাদন কমে গেলেও বাংলাদেশে তা উল্লেখযােগ্য হারে বেড়েছে। পাশাপাশি ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের তৈরি মডেলগুলাে অন্যান্য দেশও অনুসরণ করছে। মূলত মা ও জাটকা ইলিশ ধরা বন্ধ করার মাধ্যমেই ইলিশ উৎপাদনে এ সফলতা পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মিয়ানমার, আটলান্টিক ও ভূমধ্যসাগরীয় কিছু অঞ্চলে অল্প পরিমাণে ইলিশ পাওয়া গেলেও স্বাদে ও পুষ্টিতে বাংলাদেশের ইলিশই সেরা।

ক্ষীরশাপাতি আম

২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে জিআই বা ভৌগােলিক নির্দেশক তালিকাভুক্ত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আম। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ অঞ্চলে ক্ষীরশাপাতি নাম হলেও যশাের, খুলনা, সাতক্ষীরা অঞ্চলে এটি ‘হিমসাগর’ নামেই অধিক পরিচিত। ১৯৫৫ সালের প্রাচীন লােকগীতি ‘আলকাপ’ গানে ২০০ জাতের আমের নামের মধ্যে ক্ষীরশাপাতি একটি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে ২৬ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে ২৫০-এর বেশি জাতের আমের চাষ করা হলেও এর মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশই হচ্ছে ক্ষীরশাপাতি। শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলেই নয়, বরং আঁশবিহীন আমটি এর অনন্য স্বাদ ও গন্ধের কারণে সারা দেশেই জনপ্রিয়। কয়েক বছর ধরে দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরােপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে ক্ষীরশাপাতি আম।

মসলিন কাপড়

কেবল ভূভারত নয়, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যসহ দুনিয়াজুড়ে একসময় বিপুল সমাদর ছিল মসলিন মিহি কাপড়ের। অত্যন্ত হালকা, সূক্ষ্ম ও পরিধেয় হিসেবে খুব আরামদায়ক হওয়ায় অভিজাত নারীদের কাছে। এর চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু কালের বিবর্তনে ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী পণ্য। বর্তমান সরকার বিলুপ্ত এই মসলিনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ‘বাংলাদেশের সােনালি ঐতিহ্য মসলিন সুতা ও কাপড়ের প্রযুক্তি পুনরুদ্ধার’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেয়। ছয় বছরের বিরামহীন চেষ্টায় ১৭০ বছর পর সফলভাবে মসলিন বুনতে সক্ষম হন গবেষকেরা। ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশের মসলিন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ তাঁত বাের্ডকে (বাৰ্তবাে) দেওয়া হয় এই জিআই স্বত্ব।

রাজশাহী সিল্ক

২৬ এপ্রিল বিশ্ব মেধাস্বত্ব দিবস। ২০২১ সালের এই দিবসে ভৌগােলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী সিল্ক। বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বাের্ডের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে WIPO এই স্বীকৃতির ঘােষণা দেয়। রেশম বা সিল্কের জন্মভূমি চীন হলেও ষােড়শসপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে প্রচুর সিল্কের উৎপাদন হতে থাকে। একসময় রাজশাহী জেলা হয়ে ওঠে রেশম চাষের প্রধানতম ক্ষেত্র। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুজন কর্মকর্তার পাঠানাে দুটি প্রতিবেদন রাজশাহী সিল্কের অনন্য প্রামাণিক দলিল। যার প্রথমটি হলাে ওয়েল কর্তৃক ১৭৫৯ সালে লেখা এবং অন্যটি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান সেরেস্তাদার জেমস গ্রান্ট কর্তৃক ১৭৮৮ সালে সদর দপ্তর ফোর্ট উইলিয়াম কলকাতায়। প্রেরণ করা হয়।

রংপুরের শতরঞ্জি

জিআই স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য নিবন্ধনের আবেদন থেকে বাদ পড়েনি রংপুরের শতরঞ্জিও। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপােরেশন (বিসিক) ২০১৯ সালে ডিটিডিটির কাছে এই আবেদন করেছিল, যা ২০২১ সালে এসে স্বীকৃতি পায়। বিসিক কর্তৃপক্ষের হাতে স্বীকৃতির সনদ তুলে দেওয়া হয় ২০২১ সালের ১৭ জুন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ত্রয়ােদশ শতাব্দীতেও রংপুর এলাকায় শতরঞ্জির প্রচলন ছিল। বাংলাদেশে রপ্তানি বাণিজ্যে হস্তশিল্পের ৬০ শতাংশই রপ্তানি হয়ে থাকে রংপুরের শতরঞ্জি। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৪০ লাখ ডলার দেশে আনা সম্ভব হয়েছে রংপুরে উৎপাদিত শতরঞ্জির। মাধ্যমে।

বাংলাদেশি কালিজিরা ধান

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট এই পণ্যকে জিআই হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন জানিয়েছিল, যা স্বীকৃতি পেয়েছে ২০২১ সালে। সাধারণত কালিজিরা ধানের খােসা কালাে হয়ে থাকে। তবে খােসা ছাড়ালে সাদা রঙের চাল বেরিয়ে আসে। দানার আকৃতি ছােট আর খােসা কালাে হওয়ার কারণে এটাকে কালিজিরা মসলার মতাে মনে হয়। তাই এমন নামকরণ করা হয়েছে। সাধারণত শ্রাবণ থেকে ভাদ্র মাস, অর্থাৎ আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে কালিজিরার চারা রােপণ করতে হয়। অগ্রহায়ণের শেষের দিকে, অর্থাৎ ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ফসল কাটা হয়।

দিনাজপুর কাটারিভােগ

এই পণ্যকেও জিআই হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন জানিয়েছিল বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। এই ধানের বৈশিষ্ট্য হলাে এ থেকে উৎপাদিত চাল সরু ও সুগন্ধি। কাটারিভােগ ধানটির মূল উৎপত্তিস্থল। দিনাজপুর। দিনাজপুর ছাড়া অন্য এলাকায় চাষ হলে এর সুগন্ধি কমে যায়। সারা বাংলাদেশে উৎপাদিত হলেও ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, মাগুরা ও সিলেট জেলায়। ধানটির উৎপাদন বেশি। শ্রাবণ থেকে ভাদ্র মাস, অর্থাৎ আগষ্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে কাটারিভােগ চারা রােপণ করতে হয়। অগ্রহায়ণের শেষের দিকে, অর্থাৎ ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ফসল কাটা হয়।।

বিজয়পুরের সাদা

মাটি নেত্রকোনার এই প্রাকৃতিক সম্পদকে জিআই স্বীকৃতি দিতে নিবন্ধনের আবেদন করেছিল নেত্রকোনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, যা ২০২১ সালে এসে স্বীকৃতি পায়। ওই বছরের ১৭ জুন নেত্রকোনা জেলা প্রশাসকের হাতে স্বীকৃতির সনদ প্রদান করা হয়। সিরামিকের বাসনকোসন, টাইলস, গ্লাসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে এই উৎকৃষ্ট মানের সাদা মাটি। নেত্রকোনা জেলার বিজয়পুরে সাদা মাটির বিপুল মজুত আছে। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর ১৯৫৭ সালে তল্কালীন ময়মনসিংহ জেলার দুর্গাপুর থানায় ভেদিকুরা এলাকায় প্রথম সাদা মাটির সন্ধান পায়।

বাগদা চিংড়ি

বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি জিআই সনদ (ভৌগােলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১৯ সালের মে মাসে বাগদা চিংড়ির জিআই সনদ পেতে আবেদন করেছিল বাংলাদেশ। গত ১৮ মে ২০২২ শিল্প মন্ত্রণালয় জিআই সনদ পাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘােষণা দেয়। বাগদা চিংড়ি জিআই সনদ পাওয়ায় দুটি ক্ষেত্রে সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। এক, বিশ্ববাজারে নিজস্ব পণ্য হিসেবে বাগদা চিংড়ি বেশি মূল্য পাবে। দুই, এ খাতে বিদেশি বিনিয়ােগ বাড়বে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Accept !