ইউক্রেনে সামরিক হামলার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি দেশ রাশিয়ার ওপর নানা রকম আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরােপ করেছে। কিন্তু এই বিশ্বায়িত অর্থব্যবস্থায় রাশিয়া বিচ্ছিন্ন অঞ্চল নয়—জ্বালানি ও পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে তারা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সরবরাহকারী। তাই রাশিয়ার বাণিজ্য অংশীদারদের গায়েও এর আঁচ লাগছে, যদিও সেই দেশগুলাে ক্ষতির মাত্রা বিচার করে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করছে।
বিশ্বব্যাপী এই সংকট Central Bank Digital Currency (CBDC) নিয়ে নতুন আলােচনার জন্ম দিয়েছে। নিদ্ধোজ্ঞার কারণে ব্যাহত হওয়া বাণিজ্যিক লেনদেনের বিকল্প ব্যবস্থা সিবিডিসি হয়ে উঠতে পারে কি না, বিতর্কটা মূলত তা নিয়েই। সমস্যা ও তার সম্ভাব্য সমাধানের প্রকৃত রূপ কী, তা বােঝার জন্য প্রথমে বর্তমান লেনদেনের ব্যবস্থা কী, তার প্রকৃতি বুঝতে হবে। সেই ব্যবস্থায় আর্থিক নিষেধাজ্ঞা কীভাবে কাজ করে, তা দেখতে হবে।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের বাজার মূলত ডলারনির্ভর। অধিকাংশ দেশে ডলার হলাে রিজার্ভ কারেন্সি, অর্থাৎ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেদের সঞ্চয়ের ভান্ডার ডলারে সংরক্ষণ করে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, লেনদেন ও বিনিয়ােগও হয় ডলারের মাধ্যমেই। ডলারের মাধ্যমে হওয়া আর্থিক লেনদেন করতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থব্যবস্থার মধ্যস্থতায়।
ফলে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের ব্যবস্থার কেন্দ্র হলাে যুক্তরাষ্ট্র। সেই লেনদেন যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুসারেই চলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নিউইয়র্কে অবস্থিত The Clearing House Interba nk Payments System-এর (CHIPS) মাধ্যমে প্রতিদিন অন্তর্দেশীয় ও আন্তর্জাতিক লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ১ দশমিক ৮ লাখ কোটি ডলার।
চিপসের সদস্যসংখ্যা মাত্র ৪৩। কোনাে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এই ব্যবস্থার সদস্য হতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে আসা আবশ্যক। চিপসের সদস্য নয়, এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে লেনদেন করতে হলে এই সদস্য-ব্যাংক বা সংস্থাগুলাের মাধ্যমে করতে হয়। চিপসের সংশ্লিষ্ট অংশগ্রহণকারী সংস্থা বা সংস্থাগুলাে তখন কাজ করে ওই প্রক্রিয়ার প্রতিনিধি বা এজেন্ট হিসেবে। এই কার্যক্রমকে বলা হয় ‘করেসপনডেন্ট ব্যাংকিং সিস্টেম।
আন্তর্জাতিক লেনদেন প্রক্রিয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলাে The Society for Worldwide Interbank Financial Telecommunication (SWIFT)। এটি একধরনের নিরাপদ বার্তা প্রেরণ পরিষেবা, যার সঙ্গে যুক্ত ২০০টি দেশের ১১ হাজারের বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থার সদর দপ্তর বেলজিয়ামে।
গত বছর দৈনিক গড়ে ৪ কোটি ২০ লাখ বার্তা আদান-প্রদান হয়েছে সুইফটের মাধ্যমে। সরাসরি যুদ্ধ ঘােষণা না করেও আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরােপের মাধ্যমে কোনাে বেয়াড়া দেশকে শায়েস্তা করা বা তার অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ বন্ধ করতে চাপ দেওয়ার পদ্ধতি বহু পুরােনাে।
উত্তর কোরিয়া বা ইরানের ওপর যেমন অনেক আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরােপিত হয়েছে, তেমনই ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ায় সামরিক হামলা করার জন্য রাশিয়ার ওপরও আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে পােখরান পারমাণবিক বােমা বিস্ফোরণের পর ভারতের ওপরও নিগ্ধোজ্ঞা আরােপ করা হয়।
আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনে ডলারের প্রবল আধিপত্যের কারণে এ ধরনের আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা বিপুল। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলাে করেসপনডেন্ট ব্যাংকিং সিস্টেম।
বর্তমানে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলােকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রাশিয়ার নিষিদ্ধ ব্যাংকগুলাের করেসপনডেন্ট অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে, তাদের লেনদেন স্থগিত রাখতে। ফলে সংশ্লিষ্ট রুশ ব্যাংকগুলাের কোটি কোটি ডলারের লেনদেন আটকে গেছে। সুইফট ব্যবহারেও রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় নিষিদ্ধ রুশ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলাে বিশ্বের অন্যান্য আর্থিক সংস্থার সঙ্গে লেনদেন করতে পারছে না। এতে যেমন রপ্তানি বাবদ টাকা পাওয়ার পথ বন্ধ হয়েছে, তেমনি সাধারণ মানুষের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সুইফট ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের অধীন না হলেও যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানটির অবস্থানকে প্রভাবিত করতে পারে ব্যাপকভাবে এমনকি ইউরােপীয় ইউনিয়নের অমতেও—কারণ, সুইফটের গভর্নিং বডিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব আছে। আবার সুইফটের একটি সার্ভারও যুক্তরাষ্ট্রে, যা তাকে আরও ক্ষমতা দিয়েছে।
এই নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছে অনেক দেশ—ডলারে লেনদেন হবে , এমন চুক্তির বদৌলতে। তার মধ্যে আছে ২০১২ সালে ভারতের চালু করা ‘রুপি-রিয়াল’ প্রক্রিয়া; রাশিয়া-চীনের ২০১৪ সালের কারেন্সি সােয়াপ চুক্তি; ক্রেডিট কার্ডে অন্তর্দেশীয় লেনদেনের জন্য ‘ন্যাশনাল পেমেন্ট কার্ড সিষ্টেম’; সুইফটের বিকল্প হিসেবে তৈরি করা রাশিয়ার মেসেজিং ব্যবস্থা System for Transfer of Financial Messages (STFM) কিংবা চীনের Cross- Border Interbank Payment System (CIPS)।
কিন্তু এসব ব্যবস্থা সবই হয় সাময়িক, নয়তাে সীমিত ক্ষমতার। রুবল ও ইউয়ানেকিছু বাণিজ্য হলেও এখনাে তারা ডলারের ধারকাছে নেই। এই বাস্তবতায় ডলার, যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক পরিকাঠামাে ও সুইফট—কোনাে দেশের ওপর এই তিন শক্তির নিষেধাজ্ঞা জারি হলে তার কার্যকারিতা অনেক বেশি। এ ধরনের নিদ্ধোজ্ঞা, যেগুলাে সংশ্লিষ্ট দেশের আর্থিক অবকাঠামােকে পঙ্গু করে দেয়, তাকে বলে প্রাইমারি স্যাংশন বা মুখ্য নিৰ্ধোজ্ঞা।
নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়া দেশের সঙ্গে কোনাে দেশ যদি আর্থিক সম্পর্ক বজায় রাখে, তাহলে সেই দেশগুলাের ওপরও এক গােষ্ঠীর নিষেধাজ্ঞা জারি করার সম্ভাবনা থাকে। একে সেকেন্ডারি স্যাংশন বা গৌণ নিষেধাজ্ঞা বলে। বর্তমান আন্তর্জাতিক লেনদেন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সিবিডিসি প্রক্রিয়ার মৌলিক পার্থক্য হলাে, দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী কোনাে প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা থাকে না—বিশেষত করেসপনডেন্ট ব্যাংকের।
যখন একাধিক দেশ পরস্পরের মধ্যে সিবিডিসি প্রক্রিয়ায় লেনদেন করে, তখন এই ভূমিকা নেয় সেসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৈশ্বিক সিবিডিসির ক্ষেত্রে যে বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান অভিন্ন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তৈরি করবে, মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করবে সেই মুদ্রাই। সিবিডিসি-নির্ভর আন্তর্জাতিক লেনদেন চালু হলে সুইফটের মতাে ব্যবস্থার গুরুত্বও হ্রাস পাবে।