একসময় পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন রাশি সূক্ষ্মভাবে মাপা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। আধুনিক ইলেকট্রনিকস নির্ভর যন্ত্রপাতির কারণে এখন কাজটি খুব সােজা হয়ে গেছে। আমরা এই বইয়ে যে পরিমাণ পদার্থবিজ্ঞান শেখার চেষ্টা করব তার জন্য দূরত্ব, ভর, সময়, তাপমাত্রা, বিদ্যুৎ প্রবাহ এবং ভােল্টেজ মাপলেই মােটামুটি কাজ চালিয়ে নিতে পারব। এগুলাে মাপার জন্য আমরা কোন ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করি সেগুলাে সংক্ষেপে আলােচনা করা যাক।
স্কেল
ছােটখাটো দৈর্ঘ্য মাপার জন্য মিটার স্কেল ব্যবহার করা হয় এবং তােমরা সবাই নিশ্চয়ই মিটার স্কেল দেখেছ। 100 cm (সেন্টিমিটার) বা 1 m লম্বা বলে এটাকে মিটার স্কেল বলে। যেহেতু এখনাে অনেক জায়গায় ইঞ্চি-ফুট প্রচলিত আছে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি উদাহরণ দেশ!) তাই মিটার স্কেলের অন্যপাশে প্রায় সব সময় ইঞ্চি দাগ কাটা থাকে। এক ইঞ্চি সমান 2.54 cml একটা স্কেলে সবচেয়ে যে সূক্ষ্ম দাগ থাকে আমরা সে পর্যন্ত মাপতে পারি।
মিটার স্কেল সাধারণত মিলিমিটার পর্যন্ত ভাগ করা থাকে, তাই মিটার স্কেল ব্যবহার করে আমরা কোনাে কিছুর দৈর্ঘ্য মিলিমিটার পর্যন্ত মাপতে পারি। অর্থাৎ আমরা যদি বলি কোনাে কিছুর দৈর্ঘ্য 0.364 m তার অর্থ দৈর্ঘ্যটি হচ্ছে 36 সেন্টিমিটার এবং 4 মিলিমিটার। একটা মিটার স্কেল ব্যবহার করে এর চেয়ে সূক্ষ্মভাবে দৈর্ঘ্য মাপা সম্ভব নয়—অর্থাৎ সাধারণ কেলে আমরা কখনােই বলতে পারব না একটা বস্তুর দৈর্ঘ্য 0.3643 m কিন্তু মাঝে মাঝেই কোনাে একটা অত্যন্ত সূক্ষ্ম কাজে আমাদের এ রকম সূক্ষ্মভাবে মাপা প্রয়ােজন হয়, তখন ভার্নিয়ার (Vernier) স্কেল নামে একটা মজার স্কেল ব্যবহার করে সেটা করা যায়।
ভার্নিয়ার স্কেল
ধরা যাক কোনাে বস্তুর দৈর্ঘ্য মিলিমিটারের 4 এবং 5 দুটি দাগের মাঝামাঝি কোথাও এসেছে অর্থাৎ বস্তুটির দৈর্ঘ্য 4 মিলিমিটার থেকে বেশি কিন্তু 5 মিলিমিটার থেকে কম। 4 মিলিমিটার থেকে কত ভগ্নাংশ বেশি সেটা বের করতে হলে ভার্নিয়ার স্কেল ব্যবহার করা যায়, এই কেলটা মূল স্কেলের পাশে লাগানাে থাকে এবং সামনে-পেছনে সরানাে যায় (চিত্র 1.05)। ছবির উদাহরণে দেখানাে হয়েছে মূল স্কেলের 9 মিলিমিটার দৈর্ঘ্যকে ভার্নিয়ার স্কেলে দশ ভাগ করা হয়েছে।
অর্থাৎ ভার্নিয়ার স্কেলের প্রত্যেকটা ভাগ হচ্ছে 9/10 mm আসল মিলিমিটার থেকে 1/10 মিলিমিটার কম। যদি ভার্নিয়ার স্কেলের শুরুটা কোনাে একটা মিলিমিটার দাগের সাথে মিলিয়ে রাখা হয় তাহলে তার পরের দাগটি সত্যিকার মিলিমিটার থেকে 1/10 মিলিমিটার সরে থাকবে, এর পরেরটি 2/10 মিলিমিটার সরে থাকবে 3/10 পরেরটি মিলিমিটার সরে থাকবে অর্থাৎ কোনােটাই মূল স্কেলের মিলিমিটার দাগের সাথে মিলবে না, একেবারে দশ নম্বর দাগটি আবার মূল স্কেলের নয় নম্বর মিলিমিটার দাগের সাথে মিলবে।
বুঝতেই পারছ ভার্নিয়ার স্কেলটা যদি আমরা এমনভাবে রাখি যে শুরুটা একটা মিলিমিটার দাগ থেকে শুরু না হয়ে একটু সরে (যেমন 3/10 mm) শুরু হয়েছে তাহলে ঠিক যত সংখ্যক 1/10 mm সরে শুরু হয়েছে ভার্নিয়ার স্কেলের তত নম্বর দাগটি মূল স্কেলের মিলিমিটার দাগের সাথে মিলে যাবে! কাজেই ভার্নিয়ার স্কেল ব্যবহার করে দৈর্ঘ্য মাপা খুব সহজ। প্রথমে জেনে নিতে হয় ভার্নিয়ার স্কেলের একটি ভাগ এবং মূল স্কেলের একটি ভাগের মাঝে পার্থক্য কতটুকু—এটাকে বলে ভার্নিয়ার ধ্রুবক (Vernier Constant সংক্ষেপে VC)। মূল স্কেলের সবচেয়ে ছােট ভাগের (1 mm) দূরত্বকে ভার্নিয়ার কেলের ভাগের সংখ্যা দিয়ে ভাগ দিলেই এটা বের হয়ে যাবে। আমরা যে উদাহরণ নিয়েছি সেখানে এটার মান:
VC=1mm/10=0.1mm=0.0001m
কোনাে দৈর্ঘ্য মাপার সময় মিলিমিটারের সর্বশেষ দাগ পর্যন্ত মেপে ভার্নিয়ার কেলের দিকে তাকাতে হয়। ভার্নিয়ার স্কেলের কোন দাগটি মূল স্কেলের মিলিমিটার দাগের সাথে হুবহু মিলে গেছে বা সমপাতন। হয়েছে সেটি বের করে দাগ সংখ্যাকে ভার্নিয়ার ধ্রুবক দিয়ে গুণ দিতে হয়। মূল স্কেলে মাপা দৈর্ঘ্যের সাথে সেটি যােগ দিলেই আমরা প্রকৃত দৈর্ঘ্য পেয়ে যাব। চিত্র 1.06 এর শেষ স্কেলে যে দৈর্ঘ্য দেখানাে হয়েছে আমাদের এই নিয়মে সেটি হবে 1.03 cm বা 0.013 m।
ভার্নিয়ার স্কেলের পরিবর্তে একটা স্কুকে ঘুরিয়ে (চিত্র 1.07) স্কেলকে সামনে-পেছনে নিয়েও গজ (Screw Gauge) নামে বিশেষ এক ধরনের স্কেলে দৈর্ঘ্য মাপা হয়। এখানে ক্ষুয়ের ঘাট (thread) অত্যন্ত সূক্ষ্ম রাখা হয় এবং পুরাে একবার ঘােরানাের পর কেল লাগানাে ত্রুটি হয়তাে 1 mm অগ্রসর হয়। ক্রুয়ের এই সরণকে ক্রুয়ের পিচ (pitch) বলে। যে বৃত্তাকার অংশটি ঘুরিয়ে ফেলটিকে সামনেপেছনে নেওয়া হয় সেটিকে সমান 100 ভাগে ভাগ করা হলে প্রতি এক ঘর ঘূর্ণনের জন্য স্কেলটি পিচের ভাগের এক ভাগ অগ্রসর হয়। অর্থাৎ এই স্কেলে , mm = 0.01 mm পর্যন্ত মাপা সম্ভব হতে পারে। এটাকে কু গজের নূনাঙ্ক বলে।
আজকাল ভার্নিয়ার স্কেলের পরিবর্তে ডায়াল লাগানাে কিংবা ডিজিটাল সাইড ক্যালিপার্স বের হয়েছে, যেটা দিয়ে সরাসরি নিখুঁতভাবে দৈর্ঘ্য মাপা যায়!
ব্যালান্স (ভর মাপার যন্ত্র)
ভর সরাসরি মাপা যায় না তাই সাধারণত ওজন মেপে সেখান থেকে ভরটি বের করা হয়। আমরা যখন বলি কোনাে একটা বস্তুর ওজন 1 gm বা 1 kg তখন আসলে বােঝাই বস্তুটির ভর 1 gm কিংবা 1 kg. এক সময় বস্তুর ভর মাপার জন্য নিক্তি ব্যবহার করা হতাে, যেখানে বাটখারার নির্দিষ্ট ভরের সাথে বস্তুর ভরকে তুলনা করা হতাে। আজকাল ইলেকট্রনিক ব্যালেন্সের ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। ব্যালেন্সের ওপর নির্দিষ্ট বস্তু রাখা হলেই ব্যালেন্সের সেন্সর সেখান থেকে নিখুঁতভাবে ওজনটি বের করে দিতে পারে।
থামা ঘড়ি (Stop Watch)
সময় মাপার জন্য স্টপ ওয়াচ ব্যবহার করা হয়। একসময় নিখুঁত স্টপ ওয়াচ অনেক মূল্যবান সামগ্রী হলেও, ইলেকট্রনিকসের অগ্রগতির কারণে খুব অল্প দামের মােবাইল টেলিফোনেও আজকাল অনেক সূক্ষ্ম স্টপ ওয়াচ পাওয়া যায়। স্টপ ওয়াচে যেকোনাে একটি মুহূর্ত থেকে সময় মাপা শুরু করা হয় এবং নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর সময় মাপা বন্ধ করে কতখানি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে সেটি বের করে ফেলা ফলে যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্টপ ওয়াচ যত নিখুঁতভাবে সময় মাপতে পারে আমরা হাত দিয়ে কখনােই তত নিখুঁতভাবে এটা শুরু করতে বা থামাতে পারি না।