সুন্দরবন বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় একক ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। ১৪ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন দিবস উপলক্ষে এ বনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে আমাদের আয়োজন।
ইতিহাস
সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ অংশে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম জোয়ারধৌত গরান বনভূমি (Mangrove Forest)। ‘সুন্দরবন’ নামটি সম্ভবত সুন্দরী বৃক্ষের আধিক্যের কারণে (সুন্দরী-বন) অথবা সাগরের বন (সমুদ্র-বন) কিংবা এ বনভূমির আদিবাসী চন্দ্র বেদে থেকে উদ্ভূত।
সাধারণভাবে গৃহীত ব্যাখ্যাটি হলো এখানকার প্রধান উদ্ভিদ সুন্দরী. বৃক্ষের (Heritiera fomes) নাম অনুসারেই এ বনভূমির নামকরণ। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের আগে গঙ্গার মূল প্রবাহ থেকে ভৈরব ও পদ্মা নদী প্রবাহিত হওয়ার পর সুন্দরবন অঞ্চলে ব-দ্বীপের সৃষ্টি হয়। মুঘল আমলে (১২০৩- ১৫৩৮) স্থানীয় এক রাজা পুরো সুন্দরবনের ইজারা নেন।
আরো পড়ুন
- ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২
- বাংলাদেশের সরকার প্রশাসন সম্পর্কে সাম্প্রতিক সাধারণ জ্ঞান
- বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পর্কে সাম্প্রতিক সাধারণ জ্ঞান
- ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান
- চেতনাদীপ্ত ফেব্রুয়ারি : ভাষা আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
- বাংলায় নবাবী আমল সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
- মহান বিজয় দিবস সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
- মেট্রোরেল সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান
- জাতীয় পুরস্কার সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর
- ঢাকা জেলার নামকরণ, ইতিহাস, দর্শনীয় স্থান, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি
১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর এর কাছ থেকে পাওয়ার পরপরই স্বত্বাধিকার সুন্দরবনের মানচিত্র তৈরি করা হয়। ১৮২৮ সালে ব্রিটিশ সরকার সুন্দরবনের স্বত্বাধিকার অর্জন করে। এল. টি হর্জে ১৮২৯ সালে সুন্দরবনের প্রথম জরিপকার্য পরিচালনা করেন। ১৮৭৮ সালে সমগ্র সুন্দরবন এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে পড়ে।
বিশ্ব ঐতিহ্য
৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭ ইউনেস্কো সুন্দরবনের ১,৩৯, ৭০০ হেক্টর বা ১,৩৯৫ বর্গ কিলোমিটারকে প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ঘোষণা করে। এটি ইউনেস্কো ঘোষিত ৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য। এর পূর্বে ২১ মে ১৯৯২ সুন্দরবনকে রামসার কনভেনশনের আওতায় ৫৬০তম রামসার সাইট ঘোষণা করা হয়।
অবস্থান ও আয়তন
বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্তৃত। ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের প্রায় ৬,০১,৭০০ হেক্টর বা ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার (৬২%) রয়েছে বাংলাদেশে যা দেশের আয়তনের ৪.১৩% এবং বাকি অংশ (৩৮%) রয়েছে ভারতের মধ্যে।
অর্থনীতিতে অবদান
কাঠ, জ্বালানি ও মন্ডের মতো বনজ সম্পদের পাশাপাশি এ বন থেকে ব্যাপকভাবে আহরণ করা হয় ঘর ছাওয়ার পাতা, মধু, মৌচাকের মোম, মাছ, কাঁকড়া এবং শামুক- ঝিনুক। বৃক্ষপূর্ণ সুন্দরবনের এ ভূমি একই সাথে প্রয়োজনীয় আবাসস্থল, পুষ্টি উৎপাদক, পানি বিশুদ্ধকারক, পলি সঞ্চয়কারী, ঝড় প্রতিরোধক, উপকূল স্থিতিকারী, শাক্ত সম্পদের আধার এবং পর্যটন কেন্দ্র । জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির প্রায় ২৫% অবদান সুন্দরবনের ।
সুন্দরবন দিবস
প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন দিবস পালিত হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০০১ পরিবেশ আন্দোলনের আওতায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রূপান্তর ও পরশের উদ্যোগে এবং দেশের আরও ৭০টি পরিবেশবাদী সংগঠনের অংশগ্রহণে প্রথম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সুন্দরবন দিবস’ ঘোষণা করা হয়।
প্রাণী ও বনজ সম্পদ
- উদ্ভিদ প্রজাতি : সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুর, কেওড়া, গর্জন, খলসী, হিজল ইত্যাদি।
- বন্যপ্রাণী : রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, বানর, কুমির, ডলফিন, হরিয়াল, বালিহাঁস, গাংচিল, বক, মদনটাক, মরালিহাঁস, চখা, ঈগল, চিল, মাছরাঙা ইত্যাদি।
- নদী-খাল : পশুর, শিবসা, বলেশ্বর, রায়মঙ্গল ইত্যাদি।
- মৎস্য সম্পদ : ইলিশ, লইট্টা, ছুরি, পোয়া, রূপচাঁদা, ভেটকি, পারসে, গলদা, বাগদা, চিতরা ইত্যাদি।
- আকর্ষণীয় স্থান : কটকা; হিরণ পয়েন্ট; দুবলার চর, পুটনী দ্বীপ; নীলকম ও কারমজল, সুন্দরবন
সাহিত্যে সুন্দরবন
উপন্যাস | রচয়িতা |
দ্য হাঙ্গরি টাইড | অমিতাভ ঘোষ |
মিডনাইট’স চিলড্রেন | সালমান রুশদি |
সুন্দরবনে সাত বৎসর | বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় |
রাতুলের রাত রাতুলের দিন | মুহম্মদ জাফর ইকবাল |
এছাড়াও ‘অপারেশন সুন্দরবন’ এবং শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘অ্যাডভেঞ্চার- অব সুন্দরবন’ নির্মিত হয়েছে।
বাঘ শুমারি
১৯৭৫ সালে সুন্দরবনে প্রথমবারের মতো বাঘ শুমারি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০০৪ সালে UNDP’র সহায়তায় বন বিভাগ পাগমার্ক (পায়ের ছাপ) পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত জরিপে ৪৪০টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার গণনা করে। ২০০৬ সালে অধ্যাপক ও বাঘ গবেষক ড. মনিরুল এইচ খান ক্যামেরা ট্র্যাপিং ও আপেক্ষিক সংখ্যা পদ্ধতি অনুসরণ করে জানান, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ২০০টি।
২০১৫ সাল থেকে বন বিভাগ বাঘ গণনার ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতির ব্যবহার শুরু করে। সে জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। এরপর ২০১৮ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতির মাধ্যমে আরেকটি বাঘ শুমারি করে বন বিভাগ জানায়, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১১৪টি।