‘একাত্তরের দিনগুলি’ কথাসাহিত্যিক জাহানারা ইমামের এক অনবদ্য সৃষ্টি। এটি ব্যক্তিগত দিনলিপি আকারে লেখা, যার শুরু ১৯৭১ সালের ১ মার্চ এবং সমাপ্তি সেই বছরের ১৭ ডিসেম্বর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অবরুদ্ধ ঢাকা শহরের অবস্থা ও গেরিলা তৎপরতার বাস্তব চিত্র এতে উঠে এসেছে ।
সেই সাথে ফুটে উঠেছে বাঙালির ক্ষোভ, আন্দোলন ও সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক মানুষের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন, হানাদার বাহিনীর অমানবিক নির্যাতন ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক সাহায্যের চিত্র। ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে জাহানারা ইমাম একজন মা হিসেবে তার আদরের সবটুকু পেলব মিশিয়ে অক্ষরের জালে বুনেছেন এক নকশী কাঁথা।
যার ফোঁড়ে ফোঁড়ে রয়েছে সুচ-ফোটা যন্ত্রণা, রয়েছে মশালের জৌলুশ, বারুদের গন্ধ, মুহুর্মুহু গুলির ঝংকার। আরও রয়েছে বিশ্বাসঘাতকদের প্রবঞ্চনার দগদগে ঘা, উদ্বিগ্ন মায়ের বিনিদ্র রাত্রিযাপনের রুদ্ধশ্বাস বয়ান। ‘একাত্তরের দিনগুলি’ শেষপর্যন্ত মা-সন্তানের স্মৃতিকথা ছাপিয়ে মুক্তিযুদ্ধের এক পূর্ণাঙ্গ দলিল হয়ে উঠেছে।
গ্ৰন্থ সংক্ষেপ
“একাত্তরের দিনগুলি’তে দেখা যায়, ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দিলে পুরো ঢাকা শহরে হৈচৈ পড়ে যায়। মিছিল, মিটিং আর স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে ঢাকা । সরকার শহরজুড়ে কারফিউ জারি করে এবং কারফিউ ভঙ্গকারীদের ওপর গুলিবর্ষণে অনেক মানুষের মৃত্যু হয় । ৩ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন । শাসকগোষ্ঠী ক্রমেই ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে থাকে।
২৫ মার্চ রাতে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী । সে রাতে অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তি শহীদ হন । এপ্রিলের ১, ৩, ১৩, ১৮, ২২ তারিখে লক্ষ করা যায় হানাদার বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতনের দৃশ্য। দেশের এসকল পরিস্থিতি দেখে জাহানারা ইমামের জ্যেষ্ঠ পুত্র রুমী যুদ্ধে যেতে চায়। অনেক যুক্তিতর্কের পর লেখিকা শেষ পর্যন্ত ছেলেকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেন । রুমী গেরিলা বাহিনীতে অংশগ্রহণ করে ।
জুলাই মাসে গেরিলাদের প্ল্যান ও অভিযানের কথা বলা হয়েছে । যেমন— ধানমন্ডির ১৫ নম্বর রোডে গেরিলাদের আক্রমণ, মোটরগাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া, উলান, গুলবাগে পাওয়ার স্টেশনের ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দিয়ে ঠিকমতো পালিয়ে যাওয়া ইত্যাদি গেরিলা অভিযানের কথা পাওয়া যায়। তাছাড়া আগস্ট মাসের ২৫ তারিখ রুমী, কাজী, স্বপন, বদি, সেলিম, আলমরা ধানমন্ডির ১৮ নম্বর ও ৫ নম্বর রোডে যথাক্রমে এম.পি ও এক ট্রাক হানাদার বাহিনীকে খতম করে।
২৯ আগস্ট রাত বারোটায় রুমী ধরা পড়ে, সেই সাথে রুমীর অনেক সহযোদ্ধাও ধরা পড়ে। এভাবে বেশ কয়েকজন গেরিলাদের ধরার পর তাদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালানো হয়। লেখিকা রুমীর জন্য বিচলিত হয়ে পড়েন । জাহানারা ইমাম এবং তার স্বামী শরীফ সিদ্ধান্ত নেন আর যাই হোক রুমীকে মুক্ত করতে তারা মার্সি পিটিশন করবেন না।
১৩ ডিসেম্বর শরীফের হার্ট অ্যাটাক হয়, কিন্তু যুদ্ধের সময় প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে তিনি মারা যান । ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৭ ডিসেম্বর জাহানারা ইমামের বাড়িতে আসে রুমীর সহযোদ্ধারা; শাহাদাত, আলম, আনু, জিয়া, ফতে, চুল্লু এবং ক্যাপ্টেন হায়দার । আসে না কেবল রুমী ।
সাহিত্যিক পরিচিতি
- জন্ম > ৩ মে ১৯২৯; পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে
- শিশু সাহিত্য > গজকচ্ছপ (১৯৬৭), সাতটি তারার ঝিকিমিকি (১৯৭৩), বিদায় দে মা ঘুরে আসি (১৯৮৯)
- অনুবাদ গ্রন্থ > জাগ্রত ধরিত্রী (১৯৬৮), তেপান্তরের ছোট্ট শহর (১৯৭১), নদীর তীরে ফুলের মেলা (১৯৬৬)
- মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক > বীরশ্রেষ্ঠ (১৯৮৫), একাত্তরের দিনগুলি (১৯৮৬)
- অন্যান্য > অন্য জীবন (১৯৮৫), জীবন মৃত্যু (১৯৮৮), শেক্সপীয়রের ট্রাজেডি (১৯৮৯), নিঃসঙ্গ পাইন (১৯৯০), বুকের ভিতরে আগুন (১৯৯০), দুই মেরু (১৯৯০), নয় এ মধুর খেলা (১৯৯০), ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস (১৯৯১), প্রবাসের দিনলিপি (১৯৯২) ইত্যাদি
- পুরস্কার > বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯০), স্বাধীনতা পদক (১৯৯৭), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৮)
- সম্পাদিত পত্রিকা > খাওয়াতীন (মাসিক)
- মৃত্যু > ২৬ জুন ১৯৯৪ ।
বিভিন্ন পরীক্ষায় আসা প্রশ্নাবলি
- মুক্তিযুদ্ধনির্ভর রচনা কোনটি?— একাত্তরের দিনগুলি । [৩২তম বিসিএস]
- ‘একাত্তরের দিনগুলি’ নামের বইয়ের লেখক— জাহানারা ইমাম। [ICT অধিদপ্তরের সহকারী প্রোগ্রামার ২০২০]
- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের রচনা কোনটি?— একাত্তরের দিনগুলি। [BTV’র সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) ২০১৭]