মানুষ সর্বদা শান্তি পিয়াসী । কিন্তু বর্তমান বিশ্বে কোথাও শান্তি নেই । শান্তিময় জীবনযাপনের জন্য মানুষের মাঝে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য এবং মানবিকতা প্রয়োজন। তাহলে সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে । কিন্তু যুদ্ধ মানুষের সহজাত শান্তি প্রত্যাশাকে নস্যাৎ করে কলঙ্কিত করেছে ইতিহাসের অনেক অধ্যায় । যুদ্ধের ভয়াবহতা আজ বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে । বিধ্বংসী যুদ্ধের ভয়াবহ রূপের সাক্ষী হয়ে আজ পৃথিবীর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মধ্যে আওয়াজ উঠেছে ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই” ।
পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধ
যুদ্ধের ইতিহাস অতি প্রাচীন। আদিম যুগে মানুষ খাবার নিয়ে লড়াই করেছে । শিকারের ভাগ একান্ত নিজের করে নিতে বাহুবলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। টিকে থাকার জন্য আদিকাল থেকেই মানুষকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। ধীরে ধীরে যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন হয়েছে।
একসময় দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত রূপ হিসেবে পরিণতি পায় বিধ্বংসী যুদ্ধ । পৃথিবী এমন অসংখ্য যুদ্ধের সাক্ষী। বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রমাণ, প্রাচীন সাহিত্য ইত্যাদি থেকে বহু যুদ্ধের কথা জানা যায় । প্রতিটি যুদ্ধই শেষ হয়েছে ভয়ংকর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। তবে ইতিহাসে এমন অনেক যুদ্ধ এসেছে, যেগুলোকে বলা হয় স্বাধিকার অর্জনের যুদ্ধ। যেমন— বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।
আধুনিক যুদ্ধের রূপ
পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলে অতীতেও যুদ্ধ চলেছে এবং বর্তমানেও যুদ্ধ চলছে। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে যুদ্ধের রূপ। অতীতকালে যুদ্ধ হতো মুখোমুখি, তখন যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো তরবারি, বর্শা, তীর, ধনুক ইত্যাদি। এরপর কালের আবর্তনে যুদ্ধে এসব অস্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে ।
তার স্থান দখল করে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র । এ আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর তালিকায় প্রথম সংযোজন তোপ বা কামান। তারপর সময়ের সাথে সাথে আগ্নেয়াস্ত্রগুলোতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। যুদ্ধের ময়দানে আবির্ভাব ঘটে বন্দুক, গুলি ও বোমা ইত্যাদির ।
অবশেষে পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিকতম যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে আবিষ্কৃত হয় পরমাণু বোমা যা যুদ্ধের ময়দান তো বটেই পৃথিবীর সার্বিক সামাজিক চরিত্রকেও আমূল পরিবর্তন করে। বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রে শব্দের চেয়ে দ্রুতগামী ক্ষেপণাস্ত্র, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত সামরিক যান, মনুষ্যবিহীন যুদ্ধবিমান ও ড্রোন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে যা পূর্বের তুলনায় যুদ্ধকে অনেক বেশি ভয়ানক করেছে।
বর্তমান বিশ্বে চলমান যুদ্ধ
একসময় মানুষ যুদ্ধ করত নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য; হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের হাত থেকে বাঁচতে। আর এখন মানুষ যুদ্ধ করে ক্ষমতা প্রকাশ ও নিজের স্বার্থরক্ষার জন্য। পাশাপাশি অন্যকে ধ্বংস করার জন্য, অন্যের সম্পদ দখল করার জন্য এবং অন্যের ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য ।
তাছাড়া সম্প্রসারণশীলতার জন্য ভয়ানক যুদ্ধের উদাহরণ বিশ শতকের ২টি বিশ্বযুদ্ধ। মানুষ হিংসা-দ্বেষ, লোভ-লালসার বশবর্তী হয়েও এখন যুদ্ধ করছে। বর্তমানে পৃথিবীতে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করে। এরপর থেকে দুই পক্ষের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে নিভে যাচ্ছে সহস্র প্রাণ । সিরিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে লিপ্ত দুই পক্ষ। এছাড়া এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ চলছে।
ভয়াবহতা
যুদ্ধের পরিণতি সব সময়ই ভয়ংকর। যুদ্ধ মানেই দুঃখ, কষ্ট আর ধ্বংস । ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভয়াবহ যুদ্ধের ফলে একের পর এক নগরী নিশ্চিহ্ন হয়েছে। আধুনিককালেও যুদ্ধের ভয়াবহতা কিছুমাত্র কমেনি। যুদ্ধের ভয়াবহতার নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা যায় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বিশ্বজুড়ে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ২টি বিশ্বযুদ্ধের কথা ।
এই ২টি বিশ্বযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন হারায়, শত শত শহর জনশূন্য হয়ে যায়, লক্ষ লক্ষ মানুষের অঙ্গহানি ঘটে; আর সর্বোপরি মানুষের আবিষ্কৃত আধুনিকতম যুদ্ধাস্ত্র পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের ফলে বিশ্ব থেকে দুইটি শহর একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
এই ২টি বিশ্বযুদ্ধের এমন ভয়াবহতা সত্ত্বেও মানুষ যুদ্ধের পথ থেকে সরে আসেনি। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো নিজেদের লালসা এবং হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে চলমান যুদ্ধের ফলে মারা যায় অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ এবং এখনো প্রতিদিন মারা যাচ্ছে হাজারো আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। এই যুদ্ধ মানবতার জন্য কখনো কোনো ধরনের কল্যাণ বয়ে আনেনি এবং ভবিষ্যতেও আনবে না ।
ফলাফল
যুদ্ধের ফলাফল সুদূরপ্রসারী। সংঘর্ষ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও বহুকাল ধরে যুদ্ধ চলে । বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি যুদ্ধ একটি দেশকে ১০০ বছরেরও বেশি সময় পিছিয়ে দেয়। একটি যুদ্ধে বহু পরিমাণ অর্থ এবং লোকবল ক্ষয় হয় । যুদ্ধ শুধু বিবদমান দেশগুলোকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না । বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও এর মন্দ প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে । যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উচ্চগতিতে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম, লাগামহীনভাবে বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম, বেড়েছে গমসহ নানা ভোগ্যপণ্য এবং সেবার দাম। এমন পরিস্থিতিতে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ । আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় দেখা দিয়েছে বৈশ্বিক মন্দা। বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি ।
যুদ্ধ ও শান্তি
শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনে যুদ্ধ কখনোই কারো কাম্য হতে পারে না। তবুও বিভিন্ন কারণেই ঘটে যুদ্ধ। কখনো তা দেশের অভ্যন্তরে কখনো বা এক দেশের সাথে আরেক দেশের । শান্তি মানুষের একমাত্র আরাধ্য; শান্তিই শুভ ও মঙ্গলজনক । শান্তি হলো বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বিষয়। একসময় মনে করা হতো শান্তি স্থাপনের জন্য বোধহয় যুদ্ধ করা হয় ।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সমাজতত্ত্ববিদরা ধারণার অসারতা বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেন। তারা দেখিয়েছেন পৃথিবীতে যুদ্ধের মাধ্যমে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় । প্রকারান্তরে যুদ্ধ শান্তি তো আনেই না, বরং দীর্ঘকালীন একটি অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করে। একটি যুদ্ধই পরবর্তী অপর একটি যুদ্ধের পথ প্রশস্ত করে ৷ তাই শান্তির উপায় হতে পারে পারস্পরিক আলোচনা, সমঝোতা এবং কূটনীতি ।
বিশ্ব শান্তির গুরুত্ব
বর্তমান সমস্যাসংকুল পৃথিবীতে বিশ্ব শান্তির গুরুত্ব অপরিসীম । কারণ শান্তি না থাকলে কোনো কিছুই সুষ্ঠু, সুন্দররূপে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। জাতীয় নিরাপত্তা হতে শুরু করে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসন এবং বৈশ্বিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় শান্তি স্থাপনের কোনো বিকল্প নেই ।
সকল জাতি-ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে শান্তি ও ভ্রাতৃত্ববোধ স্থাপনের মাধ্যমে বিশ্বকে একটি সুন্দর এবং বাসযোগ্য স্থানে পরিণত করাই বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহানুভূতির মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী শান্তির আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে হবে ।
বিশ্ব শান্তি স্থাপনের উদ্যোগ
১৯১৪-১৯১৮ সাল পর্যন্ত চলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কেড়ে নেয় প্রায় ২ কোটি মানুষের প্রাণ । পৃথিবীকে যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষার জন্য ১৯২০ সালে গঠিত হয় জাতিপুঞ্জ বা লিগ অব নেশনস । একসময় সংগঠনটির রাজনৈতিক গুরুত্ব ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যায় ।
১৯৩৯ সালে শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বন্ধে বিশ্ববাসী একটি সুসংগঠিত ও শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সাম্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২৪ অক্টোবর ১৯৪৫ জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে বিবাদ নিষ্পত্তি করে এবং বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণের মাধ্যমে জাতিসংঘ বিশ্বে শান্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে।
যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান
শান্তিকামী মানুষ আজ যুদ্ধের বিরুদ্ধে একই পতাকাতলে সমবেত হয়েছে। তাদের সাথে যোগ দিয়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বিশ্বখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, বিজ্ঞানী ও দার্শনিক। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতি বছর বিশেষ ব্যক্তিকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, রোমারোলা, আঁরি বারবুস, ম্যাক্সিম গোর্কী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ সোচ্চার হন প্রাণঘাতী যুদ্ধের বিরুদ্ধে । শিল্পীর তুলিতে, কবির কবিতায়, গানের সুরে, জীবনের উদ্দামতায় আজ সর্বত্র ধ্বনিত হচ্ছে শান্তির বীজমন্ত্র ।
বিশ্ব শান্তি দিবস
১৯৮১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে একটি যুদ্ধবিহীন বিশ্ব প্রতিষ্ঠার যুক্তরাজ্য ও কোস্টারিকার একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। গৃহীত প্রস্তাব অনুসারে প্রতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয় । ৭ সেপ্টেম্বর ২০০১ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের গৃহীত প্রস্তাব অনুসারে ২০০২ সাল থেকে প্রতিবছর ২১ সেপ্টেম্বর ‘আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস’ হিসেবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ।
বিশ্ব শান্তি ও বাংলাদেশ
বাংলাদেশ সবসময়ই মধ্যপন্থি একটি শান্তিকামী দেশ । জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ সবসময় ঐক্য ও শান্তি, বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিবদমান বিশ্বে শান্তি স্থাপনে ছিলেন উৎসাহী।
তাই বিশ্বের যেকোনো স্থানে যুদ্ধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সর্বদা প্রতিবাদমুখর মানুষের শান্তির আকাঙ্ক্ষা চিরন্তন। পৃথিবীর মানুষ আজ শান্তি চায়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতা সত্ত্বেও বিশ্ব থেকে যুদ্ধ নির্মূল হয়নি । বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে, চাই-বৃহৎ শক্তিবর্গের শুভ বুদ্ধি, আর এ শুভ বুদ্ধিই সকলের একমাত্র প্রত্যাশা। যুদ্ধ নামক এ ধ্বংসযজ্ঞ পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য দূর হয়ে যাক ।