১৯৯৪ সাল থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস। দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হলো, ওজোন স্তরের ক্ষয়রোধ ও এর বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা তৈরি । ১৯৮৭ সালের এই দিনেই ঐতিহাসিক ‘মন্ট্রিল প্রটোকল’ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওজোন স্তর ক্ষয়ের জন্য দায়ী এমন বস্তুসমূহের ব্যবহার সীমিত করার জন্য ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় প্রটোকলটি তৈরি করা হয়। এ বছর ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবসের প্রতিপাদ্য হলো— Montreal Protocol: fixing the ozone layer and reducing climate change.
O3 এর সাধারণ বৈশিষ্ট্য
ওজোন গ্যাস আমাদের বায়ুমণ্ডলে প্রাকৃতিকভাবে বিদ্যমান। এর সংকেত O3। একটি ওজোন অণুতে তিনটি অক্সিজেন পরমাণু থাকে। গ্রিক শব্দ ‘Ozein’ থেকে ‘Ozone’ শব্দটি নেওয়া। যার অর্থ ‘গন্ধ পাওয়া’। ওজোনের তীক্ষ্ণ গন্ধ রয়েছে। ফলে খুব কম পরিমাণে উপস্থিতিতেও এটি শনাক্ত করা যায়। এর রঙ গাঢ় নীল ।
ওজোন স্তর
বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে ১৫-৩৫ কিলোমিটারের মধ্যে বেশিরভাগ পরিমাণ ওজোন (৯০ শতাংশ) বিদ্যমান। তাই এই স্তর ‘ওজোন স্তর’ হিসেবে পরিচিত। বাকি ১০ শতাংশ ওজোন থাকে ট্রপোস্ফিয়ারে। ওজোন স্তরের পুরুত্ব অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ ও ঋতুভেদে পরিবর্তিত হয়। সাধারণত বিষুব রেখায় ওজোনের পরিমাণ সবচেয়ে কম। আর মেরু অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি।
স্ট্যাটোস্ফিয়ারের ‘ভালো’ ওজোন
স্ট্যাটোস্ফেরিক ওজোন সূর্য থেকে নিঃসৃত অতি বেগুনি রশ্মি শোষণের গুরুদায়িত্ব পালন করে। এই রশ্মির তিনটি ধরন রয়েছে : UV-C, UV-B এবং UV- A। যার মধ্যে UV-C জীবজগতের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। সৌভাগ্যক্রমে ওজোনের এ স্তর UV-C বিকিরণের পুরোটাই এবং UV-B এর বেশিরভাগ অংশ শোষণ করে।
ট্রপোস্ফিয়ারের ‘মন্দ’ ওজোন
বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে নিচের স্তর ট্রপোস্ফিয়ারের অবস্থান ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে। জীবকূলের বসবাস এই স্তরেই। মানবসৃষ্ট দুষিত পদার্থ, যেমন নাইট্রোজেন অক্সাইড (NOx), কার্বন মনোক্সাইড (CO) ও হাইড্রোকার্বন নিজেদের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ওজোন তৈরি করে। এই ওজোন জীবকোষ গঠনে যেসব অণু কাজ করে সেগুলোর সঙ্গে দ্রুত বিক্রিয়া করে সেগুলোকে ভেঙে দেয় ।
ওজোন স্তর ক্ষয়ের ধাপ
- নিঃসরণ— মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক নানা কারণে হ্যালোজেন সোর্স গ্যাসের (ODSs – Ozone Depleting Substances) নিঃসরণ হয়।
- একীভূত— এসব গ্যাস (ODSs) একত্রিত হয় বায়ুমণ্ডলের নিচের স্তরে।
- পরিবহন— গ্যাসগুলো বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে ট্রপোস্ফিয়ার থেকে স্ট্যাটোস্ফিয়ারে পরিবাহিত হয় ।
- পরিবর্তন— সূর্যের UV বিকিরণের সংস্পর্শে গ্যাসগুলো অধিক বিক্রিয়াপ্রবণ হ্যালোজেনে রূপান্তরিত হয়।
- বিক্রিয়া- হ্যালোজেন স্ট্যাটোস্ফিয়ারের ওজোনকে ভেঙে অক্সিজেনে পরিণত করে।
- অপসারণ— মেঘ ও বৃষ্টির মাধ্যমে গ্যাসগুলো স্ট্যাটোস্ফিয়ার থেকে ট্রপোস্ফিয়ারে নেমে আসে।
ওজোন হোল
বরফাচ্ছাদিত অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের স্ট্যাটোস্ফিয়ারে Polar Stratospheric Clouds তৈরির ফলে গর্ত দেখা যায়। এগুলোকে বলে ‘ওজোন হোল’। এ ধরনের ক্ষয় বেশি হয় শীতের শেষে ও বসন্তের শুরুতে।
ভিয়েনা কনভেনশন
‘ভিয়েনা কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব ওজোন লেয়ার’ হলো একটি বহুমুখী পরিবেশগত চুক্তি। এটি ১৯৮৫ সালে গৃহীত এবং ১৯৮৮ সালে কার্যকর হয়। এটি ওজোন স্তর রক্ষায় একটি কাঠামো হিসেবে কাজ করে। ওজন স্তরের সুরক্ষা ও সিএফসি গ্যাস উদগিরণের মানদণ্ড নির্ধারণই এর উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ এই কনভেনশনে অনুসমর্থন করে ১৯৯০ সালে।
মন্ট্রিল প্রটোকল
ওজোন স্তর রক্ষা বিষয়ক এই আন্তর্জাতিক চুক্তির পূর্ণ নাম ‘Montreal Protocol on Substances that Deplete the Ozone Layer’। এটির সাধারণ তথ্য—
- গৃহীত— ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭, কানাডার মন্ট্রিলে ।
- কার্যকর— ১ জানুয়ারি ১৯৮৯।
- লক্ষ্য— স্ট্যাটোস্ফিয়ারে অবস্থিত ওজোন স্তর ক্ষয়কারী রাসায়নিক পদার্থের উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ।
- চুক্তিবদ্ধ দেশ— ১৯৭টি।
- ২০১৬ সালের সম্পাদিত হয় ‘কিগালি সংশোধন’ । এর উদ্দেশ্য ছিল হাইড্রোফ্লুরো কার্বনের (HFCs) ব্যবহার পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা।
- বাংলাদেশ মন্ট্রিল প্রটোকলে অনুস্বাক্ষর করে— ২ আগস্ট ১৯৯০।
গত তিন দশকের আন্তর্জাতিক নানা উদ্যোগের ফলে অ্যান্টার্কটিকার ওজোন হোল ধীরে ধীরে সেরে উঠছে। আগামী ২০৫০-২০৭০ সালের মধ্যে ওজোন স্তর ১৯৮০ সালের পর্যায়ে ফিরে যাবে বলে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী।