বিশ্ব সভ্যতার নতুন অভিশাপ মানব পাচার। মাদক কারবার ও অস্ত্র পাচারের পর মানব পাচার হলো বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অপরাধমূলক কার্যক্রম ।
মানব পাচার কী
২০১২ সালের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন অনুযায়ী, মানব পাচার (Human Trafficking) বলতে কোনো ব্যক্তিকে ভয়ভীতি প্রদর্শন বা আর্থসামাজিক বা পরিবেশগত বা অন্য কোনো অসহায়ত্ব কাজে লাগিয়ে বা অর্থ বা অন্য কোনো সুবিধা লেনদেন করে ঐ ব্যক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এমন ব্যক্তির সম্মতি গ্রহণ করে, দেশের বাইরে বা অভ্যন্তরে যৌনশোষণ বা নিপীড়ন বা অন্য কোনো শোষণ বা নিপীড়নের উদ্দেশ্যে নির্বাসন বা স্থানান্তর, চালান বা আটক করা বা লুকিয়ে রাখা বা আশ্রয় দেওয়াকে বোঝানো হয় ।
যারা পাচারের শিকার হয়
পাচারের শিকার ব্যক্তিদের অনেকেই ভালো চাকরি বা বিয়ের মিথ্যা প্রলোভন বা প্রবঞ্চনায় পড়ে, কাউকে অপহরণ, বলপ্রয়োগ করে অথবা ভীতি প্রদর্শন করে পাচার বা কেনাবেচা করা হয় । এছাড়া বিভিন্ন কারণে মানুষ পাচার হয় যেমন— দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, সচেতনতার অভাব, বেকারত্ব, বৈষম্য, পারিবারিক নির্যাতন, পাচারবিরোধী উপযুক্ত ফৌজদারি বিচার কার্যকরের অভাব এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি ।
কোন কাজে ব্যবহৃত হয়
মানব পাচার করে সাধারণত পতিতাবৃত্তি, যৌন শোষণ বা নিপীড়ন, গৃহস্থালি কিংবা অন্য দাসত্বমূলক কাজে ব্যবহার, প্রতারণার মাধ্যমে বিবাহ, জোরপূর্বক বিনোদন বা ব্যবসায় ব্যবহার, ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করা, ব্যবসার উদ্দেশ্যে অন্যত্র বিক্রয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় ।
বিপজ্জনক যত রুট
- ভূমধ্যসাগরের মধ্যাঞ্চল : ভূমধ্যসাগরের মধ্যাঞ্চল বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক পাচার রুট হিসেবে পরিচিত। এ রুট দিয়ে ইউরোপে ঢুকতে সমুদ্রযাত্রার মূল পয়েন্ট হলো লিবিয়া ও তিউনিসিয়া।
- সাহারার বালিয়াড়ি : উত্তর আফ্রিকায় যেতে চাওয়া অভিবাসীদের জন্য বড় ধরনের বিপজ্জনক রুট হলো সাহারা মরুভূমি।
- যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত : আমেরিকার মধ্য দিয়ে অভিবাসীদের যাওয়ার যে রুটগুলো রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম সীমান্ত যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো।
- বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর : মানব পাচারকারীরা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে মানুষকে পাচার করতে সমুদ্রপথে বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান সাগর রুট ব্যবহার করে।
কীভাবে বুঝবেন
অনেকে পাচার হওয়ার পর বুঝতে পারেন যে, তিনি পাচার হয়েছেন, যেমন—
- আপনাকে যে কাজের কথা বলে বিদেশে পাঠিয়েছে সে কাজে নিয়োগ না দিয়ে জোরপূর্বক অন্য কাজ করালে বিশেষ করে যৌনকর্ম অথবা ঝুঁকিপূর্ণ কর্মে নিযুক্ত করতে চাইলে।
- জোর করে গৃহবন্দি করে রেখে শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতন করলে।
মানব পাচার বিরোধী প্রটোকল
জাতিসংঘে মানব পাচাররোধে যে প্রটোকল রয়েছে তার নাম Protocol to Prevent, Suppress and Punish Trafficking in Persons, Especially Women and Children। ১৫ নভেম্বর ২০০০ প্রটোকলটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দ্বারা গৃহীত হয়। ১২ ডিসেম্বর ২০০০ স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ২৫ ডিসেম্বর ২০০৩ জাতিসংঘ বহুজাতীয় সংঘবদ্ধ অপরাধগুলোর বিরুদ্ধে গঠন করা এ কনভেনশন কার্যকর করে। ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ বাংলাদেশ প্রটোকলটি অনুসমর্থন করে।
বিশ্ব মানবপাচার বিরোধী দিবস
৩০ জুলাই বিশ্ব মানবপাচার বিরোধী দিবস। মানব পাচারের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে ও তাদের অধিকারগুলোর প্রচার ও সুরক্ষার লক্ষ্যে ১৮ ডিসেম্বর ২০১৩ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এক প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রতি বছর ৩০ জুলাই দিনটিকে বিশ্ব মানবপাচার বিরোধী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২ জাতীয় সংসদে মানব পাচারের অপরাধে দোষী ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রেখে ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন বিল, ২০১২’ পাস হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ রাষ্ট্রপতি বিলটিতে স্বাক্ষর করলে এটি আইনে পরিণত হয়। আইনে মানব পাচারের অপরাধে দোষী ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়। ৬ জুলাই ২০১১ বিলটি মন্ত্রিসভার নীতিগত অনুমোদন পায় ।