১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে ধানমন্ডির বাড়িতে বিপথগামী সেনা সদস্যদের হাতে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। সদ্যস্বাধীন দেশে মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ পরিচালনার সুযোগ পেলেও স্বল্প সময়ে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিকল্পিত, দীর্ঘমেয়াদী ও দূরদর্শী নানা পদক্ষেপ নেন তিনি। দেশের প্রশাসনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে জাতির জনকের অবদান স্মরণ করে আমাদের এবারের আয়োজন।
দীর্ঘ পথযাত্রা, আনুষ্ঠানিকতা, জনসভা আর উচ্ছ্বাস- আবেগ-কান্নার সমুদ্র পেরিয়ে ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে একদিনও বিশ্রাম নেননি বঙ্গবন্ধু। ১১ জানুয়ারিতেই দেশ পরিচালনা শুরু করেন। সেদিন মন্ত্রিসভার সঙ্গে দুদফা বৈঠকে সংবিধান প্রণয়নসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন । ১২ জানুয়ারি অস্থায়ী সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন তিনি । এই ফাঁকেই গুছিয়ে নেন প্রশাসনিক দিকগুলো । বঙ্গবন্ধুর গৃহীত দূরদর্শী সিদ্ধান্তগুলোর সারসংক্ষেপ করা যাক ।
কৃষি ও সবুজ বিপ্লব
কৃষিতে বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী উদ্যোগগুলো ছিল : ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ; পাঁচ হাজার টাকার বেশি কৃষিঋণ মওকুফ; জমির মালিকানার সিলিং পুনর্নির্ধারণ; সব সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার। প্রচুর কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলেন তিনি। যেমন : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (জুট স্টাডি সেন্টারকে উন্নত করে), তুলা উন্নয়ন বোর্ড, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আণবিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন, বিএডিসি ও বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট পুনর্গঠন, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ রুরাল ডেভেলপমেন্ট বোর্ড।
সরকার গঠনের পরপরই বঙ্গবন্ধু কৃষি উপকরণ, কৃষি গবেষণা, নতুন জাত উদ্ভাবন ও কৃষি খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে গুরুত্ব দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২- ৭৩ অর্থবছরে বাজেটের ৬০ ভাগ পল্লি উন্নয়নের জন্য ব্যয়ের ঘোষণা দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু মিল্ক ভিটা প্রতিষ্ঠা করে ডেইরি সেক্টরকে এগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় ভালো ব্রিড আমদানি করে এসব অঞ্চলকে দুগ্ধ অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে চালু করেন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, কুমিল্লা । দারিদ্র্যপীড়িত উত্তরাঞ্চলে প্রশিক্ষণ ও গবেষণা পরিচালনার জন্য ২.২ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলেন বগুড়া পল্লি উন্নয়ন একাডেমি ।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি
শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগগুলো ছিল : বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক (১২০ দশমিক ৫ হাজার ডলার ব্যয়) সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রদান, যুদ্ধকালীন বকেয়া ফি মওকুফ, দুই শিফটে শিক্ষা কার্যক্রম চালু; বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন (১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২); প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ (১ নভেম্বর ১৯৭২); কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন ও শিক্ষানীতি প্রণয়ন ।
পরিবহন, যোগাযোগ ও টেলিযোগাযোগ
এ খাতের উদ্যোগের মধ্যে ছিল : ৩০ মাইল রেললাইন স্থাপন; রেল ও সড়কপথের উন্নয়নে প্রচুর ইঞ্জিন, বগি ও বাস-ট্রাক আমদানি; চট্টগ্রাম ও লালমনিরহাটের রেল ওয়ার্কশপ পুনঃসংস্কার; বিমান সংস্থার জন্য ৬টি এফ-২৭ বিমান সংগ্রহ; একটি বোয়িং ৭০৭ বিমান সংগ্রহ করার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর; সিলেটে জেট অবতরণ উপযোগী বিমান বন্দর এবং সৈয়দপুর ও বরিশালে দুটি বিমান বন্দর নির্মাণ সম্পন্ন করার জন্য অর্থ বরাদ্দ।
ঢাকা-লন্ডন ফ্লাইট চালু হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ১৮ জুন। বিধ্বস্ত ও নিমজ্জিত নৌযানগুলো অপসারণ ও মাইনমুক্ত করে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরকে পূর্ণভাবে চালু করা হয়। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের জন্য ৭টি সমুদ্রগামী জাহাজ সংগ্রহ করা হয়।
১৯৭৩ সালে দেশে ২৩০টি পাকা ব্রিজ নির্মাণ ও পুননির্মাণ হয়। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরেই ভৈরব ব্রিজ নির্মিত হয় । ১৯৭২-৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু তদানীন্তন জাপান সরকারের কাছে যমুনা সেতু নির্মাণের গুরুত্ব তুলে ধরেন। জাপানি বিশেষজ্ঞ দল তখন সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করেন।
১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূকেন্দ্ৰ উদ্বোধন করেন।
শিল্প ও অর্থনীতি
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে ‘শিল্প ও বাণিজ্য’ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭২ সালে আদমজী পাটকলসহ অন্যান্য অবাঙালি মালিকানাধীন শিল্পকারখানাকে জাতীয়করণ করা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ৮২টি পাটকল নিয়ে ১৯৭২ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন । তাছাড়া গৃহীত হয় প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। লক্ষ্যগুলো ছিল— ক. দারিদ্র্য দূরীকরণ; খ. প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন বৃদ্ধি; গ. কৃষির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ; ঘ. খাদ্যশস্যের উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন।
স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান গবেষণা
সরকার প্রাথমিকভাবে ৫০০ ডাক্তারকে গ্রামে নিয়োগ করেন । থানা স্বাস্থ্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু একটি ‘ছায়া ঔষধনীতি’ প্রণয়ন করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড রিসার্চ (বিসিএসআইআর) গঠিত হয়। রাষ্ট্রপতির আদেশ (১৫) -এর মাধ্যমে ১৯৭৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন গঠিত হয় ।
পর্যটন
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধু কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ঝাউবন স্থাপনের গোড়াপত্তন করেন। সমুদ্রের অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ১৯৭৪ সালে প্রণীত হয় সমুদ্রসীমা আইন
পুনর্বাসন ও সমাজ গঠন
যুদ্ধোত্তর দেশে পুনর্বাসন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য সব পর্যায়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি গঠন করা হয়। উদার ও অসাম্প্রদায়িক সংবিধান প্রণয়নের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংখ্যালঘু সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, ১৯৭২ প্রণয়ন করা হয়। নারীর জন্য জাতীয় সংসদে ১৫টি আসন সংরক্ষিত রাখার বিধান করেন বঙ্গবন্ধু । ১৯৭২ সালেই সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে নারীদের জন্য ১০ ভাগ কোটা সংরক্ষণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা নির্যাতিত হয়েছেন তাঁদের বঙ্গবন্ধু ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত করেন। নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করে বীরাঙ্গনাদের পারিবারিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হয় ।
বিভিন্ন বাহিনীর আধুনিকায়ন
বঙ্গবন্ধু স্বল্পতম সময়ে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর জন্য সদর দপ্তর তৈরি করেন। বাহিনীসমূহের আধুনিকায়নের জন্য ট্যাঙ্কসহ সমরাস্ত্র সংগ্রহ করা হয়। বিমানবাহিনীর জন্য আনা হয় বারোটি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান, রাডার, এএন-২৪ ও ২৬ বিমান, এম আই-৮ হেলিকপ্টার। তিনটি নৌঘাঁটি স্থাপনের পাশাপাশি অনেকগুলো যুদ্ধজাহাজ যুক্ত করা হয় নৌবহরে।
বেসামরিক প্রশাসনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা
বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বিদ্যমান প্রাদেশিক প্রশাসনকে কেন্দ্রীয় সরকারে রূপান্তর সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেটি মোকাবিলায় প্রাদেশিক সচিবালয়কে জাতীয় সচিবালয়ে রূপান্তর করা হয়। এতে ২০টি মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর/বিভাগ ও স্বশাসিত সংস্থা রাখা হয় ।
সরকার ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশবলে বেশকিছু স্বশাসিত সংস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য : বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ জলযান করপোরেশন, বাংলাদেশ পাট রপ্তানি সংস্থা, বাংলাদেশ পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ বিমান সংস্থা, বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা এবং বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক।
প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস ও বিকেন্দ্রীকরণ
১৯৭২ সালের মার্চে ‘প্রশাসনিক ও চাকরি পুনর্গঠন কমিটি’ গঠন করা হয়। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের পরিকল্পনাও ছিল বঙ্গবন্ধুর। এই পরিকল্পনায় বর্তমান জেলা ভেঙে মহকুমাগুলোকে জেলায় পরিণত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর গ্রাম সরকারের পরিকল্পনায় ছিল জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে গ্রাম সরকার গঠন এবং এই সরকারের হাতে গ্রামের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ভার প্রদান ।
কমিশন গঠন
পরিকল্পনা কমিশন গঠন স্বাধীনতার পরপরই ৩১ জানুয়ারি সর্বপ্রথম এই কমিশন গঠন করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল— অর্থনীতির দ্রুত পুনরুদ্ধার, সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা, পুনর্বাসন দ্রুততর করা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ। বেতন কমিশন গঠন : ১৯৭২ সালের ২১ জুলাই এক রেজুলেশনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সরকার প্রথম জাতীয় বেতন কমিশন গঠন করেন।
উপসংহার
এক কথায়, বঙ্গবন্ধু তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে যেসব প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেগুলো দেশের প্রশাসন ব্যবস্থার ভিত রচনা করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত উন্নয়ন নীতি-কৌশলের কারণে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৭ শতাংশে পৌঁছেছিল এই ধারা অব্যাহত থাকলে উন্নয়ন-দৌড়ে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে আজকের মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডের সমকক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে অনেক আগেই একটি মধ্যম মানের উন্নত দেশে পরিণত হতো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা না হলে আমরা যা অনুমান করি তার চেয়েও অনেক সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হতো।