আধুনিক যুগের সিল্ক রোড BRI

Preparation BD
By -
0

প্রাচীনকালে পশ্চিম চীন থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যায় একটি ঐতিহাসিক পথ । কালের আবর্তে এ বাণিজ্যপথে বহু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ায় ধীরে ধীরে পথটি বন্ধ হয়ে যায় । একবিংশ শতাব্দীতে এসে চীন পুনরায় সেই বাণিজ্য পথটি প্রতিষ্ঠা করার প্রকল্প হাতে নেয় । ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ BRI ধারণার এক দশকপূর্তি উপলক্ষে আমাদের এ বিশেষ আয়োজন—

সিল্ক রোডের পটভূমি

প্রাচীনকালে সভ্যতা বিস্তারের গুরুত্বপূর্ণ পথ এবং পাশ্চাত্য ও চীনের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের সেতু ছিল রেশম পথ বা সিল্ক রোড ।

চীনের হান রাজবংশ পশ্চিমে যে পথটি ব্যবহার করত, তা ‘সিল্ক রোড’ নামে পরিচিত। একসময় এটি ব্যবসা- বাণিজ্যের মূলপথে পরিণত হয়; যা পূর্ব-পশ্চিম-দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ ইউরোপ, পূর্ব আফ্রিকার বিপুল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত । ‘সিল্ক রুট” টার্মটি ঐতিহাসিকদের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও সাধারণ মানুষের মাঝে জনপ্রিয়তা অর্জন করে ‘সিল্ক রোড’ নামটি।

‘সিল্ক’ শব্দটি এসেছে আকর্ষণীয় অর্থোপার্জনের অন্যতম প্রধান পণ্য সিল্ক বা রেশম থেকে। এ রেশম পথের পূর্বপ্রান্ত চীনের ছাং আন শহর এবং পশ্চিম প্রান্ত ইতালির রোম । স্থলভাগে রেশম পথের দুটো শাখা রয়েছে।

দক্ষিণ শাখা পথ তুনহুয়াং থেকে শুরু করে ইয়াংকুয়ান পার হয়ে কুনলুন পর্বত অতিক্রম করে জিনজিয়াং, উত্তরপূর্ব আফগানিস্তান, ইরান ও আরব উপদ্বীপ হয়ে রোম সাম্রাজ্যে পৌঁছায়। আর উত্তরশাখা পথ তুনহুয়াং ছেড়ে ইয়ুমেন পার হয়ে পশ্চিম দিকে এগিয়ে গিয়ে তিয়ানসান পর্বত ডিঙ্গিয়ে মধ্য এশিয়া পার হওয়ার পর দক্ষিণ পশ্চিম দিকে মোড় নিয়ে দক্ষিণ শাখা পথের সঙ্গে মিলিত হয়। এছাড়া আরও দুটো অবিদিত রেশম পথ ছিল ।

একটি হলো দক্ষিণ পশ্চিম রেশম পথ। এ রেশম পথ চীনের সিচুয়ান প্রদেশ থেকে শুরু করে ইউনান প্রদেশ ও ইলোয়াদি নদী পার হয়ে উত্তর মিয়ানমারের মোগাং (Mogaung), উত্তর-পূর্ব ভারতের মোপার আর গঙ্গা নদীর অববাহিকার মধ্য দিয়ে উত্তর পশ্চিম ভারতে পৌঁছে ইরান ‘মালভূমিতে সমাপ্ত হয়।

অন্য রেশম পথকে সামুদ্রিক রেশম পথ বলা হয় । চীনের কুয়াং চৌ শহর থেকে নৌকায় চড়ে এ সামুদ্রিক পথ বেয়ে মালাক্কা প্রণালির মধ্য দিয়ে ভারত আর পূর্ব আফ্রিকায় যাওয়া যেত । ইতিহাস গ্রন্থে উল্লিখিত, মার্কো পোলো সামুদ্রিক রেশম পথ বেয়ে চীনে আসেন এবং চীনের ফুজিয়ান প্রদেশের ছুয়ানচৌ শহরে নৌকায় চড়ে সামুদ্রিক রেশম পথে তার জন্মস্থান ভেনিসে ফিরে যান ।

একুশ শতকের সিল্ক রোড BRI

চীনের বিখ্যাত সম্রাট হান উ ডি বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য প্রসারে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকাকে যুক্ত করতে এমন এক ‘রুট’ ব্যবহার করেন যার মাধ্যমে বাণিজ্যিক যোগাযোগের বৈপ্লবিক সূচনা হয়। প্রায় ২০০০ বছর পর চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং সেই ধারণাকে বিশ্বের সামনে নিয়ে আসেন। ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তিনি মধ্য এশিয়া সফরের সময় কাজাখস্তানের নজরবায়েভ বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া এক ভাষণে Silk Road Economic Belt -এর ধারণা দেন।

এরপর ২ অক্টোবর ২০১৩ প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ইন্দোনেশীয় পার্লামেন্টে এক বক্তব্যে বলেন, পুরোনো সমুদ্র নেটওয়ার্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে । যেটার নামকরণ তিনি করেন একুশ শতকের ‘সমুদ্র সিল্ক রোড’ । প্ৰথমে BRI-কে ডাকা হয় নয়া রেশমপথ (New Silk Road ) নামে। পরে এটিকে করা হয় One Belt One Road (OBOR)। কিন্তু One বা ‘একক’ কথাটার মধ্যে একাধিপত্যের লক্ষণ থাকায় পরে তা বৃহৎ অর্থে বুঝাতে Belt and Road Initiative (BRI) নামকরণ করা হয় । এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার ।

উদ্দেশ্য

BRI’র মূল কি-ওয়ার্ড হলো কানেক্টিভিটি। এর উদ্দেশ্য এশিয়াকে বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্রীয় ইঞ্জিন করে তোলা । এ পরিকল্পনায় থাকছে সমুদ্রপথে একগুচ্ছ আন্তর্জাতিক বন্দর, ভূমিতে আন্তসীমান্ত সড়ক, উচ্চগতির রেলপথ, বিমানবন্দর এবং ডিজিটাল যুক্ততার অবকাঠামো নির্মাণ ।

এর সমান্তরালে থাকবে বিদ্যুতের গ্রিড, গ্যাসের পাইপলাইন এবং বাণিজ্য-সহায়ক আর্থিক কার্যক্রম। এ বাণিজ্যপথ এশিয়ার বিস্তৃত এলাকায় জালের মতো ছড়িয়ে থাকবে, এশিয়াকে ভূমি-সমুদ্র-আকাশ ও ডিজিটাল মাধ্যমে ইউরোপ ও আফ্রিকার সঙ্গে যুক্ত করবে।

চীনা রাষ্ট্রের সব স্তর, সব প্রাদেশিক সরকার এবং গণমাধ্যম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মহলকে এ মহাপরিকল্পনা তৈরি এবং তার বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত করা হয়েছে । প্রধান প্রধান রাষ্ট্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংক নিচ্ছে এর অর্থায়নের মূল দায়িত্ব ।

বিশ্বায়ন ২.০

বিংশ শতক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের, একবিংশ শতক হবে কোন দেশের? একুশ শতাব্দী চীনা শতাব্দী হবে কি না, তা নির্ভর করছে এই বৈশ্বিক বাণিজ্য অবকাঠামো নির্মাণে সফলতার ওপর। BRI প্রকল্পে ৩টি বৃহৎ বিষয় এক হয়েছে— সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্র, সবচেয়ে বড় অর্থায়ন এবং সবচেয়ে বেশি জনসমষ্টি। এটিই হবে আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রকল্প প্রায় ৭০টি দেশ, ৬০% বিশ্ব জনসংখ্যা এবং ৪০% জিডিপি নিয়ে এ নয়া রেশমপথ রচনা করছে এশীয় আদলের নতুন বিশ্বায়ন ।

পুরো বাস্তবায়িত হওয়া শুরু হলে BRI হয়ে উঠবে বিশ্বায়ন ২.০। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ৯০ দশকের গোড়ার বিশ্বায়নকে বলা হয় বিশ্বায়ন ১.০ । আর এটা ঘটছে এমন সময়ে, যখন পশ্চিমা বিশ্ব নিজের ভেতর থেকেই বাধার মুখে পড়েছে। চীনের নেতৃত্ব কতটা উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছে, এ কূটনৈতিক ও ‘অর্থনৈতিক প্রকল্প তার প্রধান উদাহরণ ।

বেল্ট রোডে বাংলাদেশ

২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং- এর ঢাকা সফরের সময় BRI উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ যোগ দেয় । এ পরিকল্পনা অনুযায়ী চীন ২টি ‘ইকোনমিক করিডর’ তৈরি করছে। একটি কুনমিং থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথ । আর দ্বিতীয়টি- চীনের জিনজিয়াং থেকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের সমুদ্রবন্দর গাওদার পর্যন্ত রেল ও সড়কপথ।

দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ তৈরিতে বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর বা বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর নিয়েও কাজ করছে দেশটি। এই উদ্যোগের পাশাপাশি শিল্পায়নের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, বিনিয়োগ, সমুদ্র খাতে সহযোগিতা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা এবং সংস্কৃতি ও দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি নিয়ে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে। এছাড়া এ উদ্যোগের আওতায় চীন-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ অচিরেই শুরু করবে উভয়পক্ষ ।

বেল্ট অ্যান্ড রোড ফোরাম

BRI’র আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফোরাম Belt Iand Road Forum for International Cooperation (BRFIC) যা Belt and Road Forum নামেও পরিচিত। ১৪-১৫ মে ২০১৭ চীনের বেইজিংয়ের গ্রেট হলে BRFIC’র প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৩০টি দেশের প্রতিনিধি সেখানে অংশগ্রহণ করে।

সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বিশ্বজুড়ে যোগাযোগব্যবস্থা পুনর্গঠন প্রকল্পে ১২,৪০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেন। একই সাথে ঘোষণা করেন এ মেগা প্রকল্পে যে কেউ চাইলে অংশ নিতে পারবে। এরপর ২৫-২৭ এপ্রিল ২০১৯ বেইজিংয়ে BRFIC’র দ্বিতীয় সম্মেলন হয় এবং সম্মেলনে ১২৯টি দেশ যোগদান করে ।

BRI মোকাবিলায় PGII

২৬-২৮ জুন ২০২২ জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলের বাভারিয়ান আল্পসে ৪৮তম জি-৭ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে বৈশ্বিক অবকাঠামো ও বিনিয়োগ অংশীদারত্ব (Partnership for Global Infrastructure and Investment-PGII) নামে প্রকল্পটি তোলা হয় । এর আগে ১১-১৩ জুন ২০২১ যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলনে প্রথমবার অবকাঠামো পরিকল্পনাটি তোলা হয় । তখন এর নাম ছিল Build Back Better World (B3W)।

পরবর্তীতে PGII নাম দিয়ে ৪৮তম সম্মেলনে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। প্রকল্পের আওতায় ২০২৭ সালের মধ্যে ৬০,০০০ কোটি ডলারের তহবিল গড়বে জি-৭ । তহবিলে ২০,০০০ কোটি ডলার দেবে যুক্তরাষ্ট্র। বাকি ৪০,০০০ কোটি ডলার দেবে জোটের অন্য সদস্যরা। এ উদ্যোগ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মান বাড়ানো, লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং ডিজিটাল অবকাঠামো তৈরি ত্বরান্বিত করবে।

উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে— অ্যাঙ্গোলায় সৌর বিদ্যুৎচালিত প্রকল্প গ্রহণ, সেনেগালে টিকা উৎপাদন কারখানা নির্মাণ, সিঙ্গাপুর থেকে মিসর এবং হর্ন অব আফ্রিকা হয়ে ফ্রান্স পর্যন্ত ১,৬০৯ কিমি সাবমেরিন টেলিযোগাযোগ ক্যাবল স্থাপন । কার্যত চীনের আলোচিত BRI প্রকল্পের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে এ তহবিল গঠন করা হয় ।

যে পথে যুক্ত হবে

এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকাকে ৫টি ভিন্ন পথে এবং ৬টি ইকোনমিক করিডোরে সংযুক্ত করাই BRI’র উদ্দেশ্য।

৫টি পথ৬টি ইকোনমিক করিডোর
মধ্য এশিয়া ও রাশিয়ার মাঝ দিয়ে ইউরোপের সঙ্গে চীনকে সংযুক্ত করানব্য ইউরেশীয় বৃহত্তর সেতু
মধ্য এশিয়ার মাঝ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চীনকে সংযুক্ত করাচীন-মঙ্গোলিয়া-রাশিয়া
চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরকে নিরবচ্ছিন্নতার মাঝে নিয়ে আসাচীন-মধ্য এশিয়া-পশ্চিম এশিয়া
চীন-ইন্দোচীন উপদ্বীপ
দক্ষিণ চীন সাগর ও ভারত মহাসাগরের মাঝ দিয়ে চীন ও ইউরোপকে সংযুক্ত করা চীন-পাকিস্তান
দক্ষিণ চীন সাগরের মাঝ দিয়ে চীনকে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করাবাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)

#buttons=(Accept !) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Accept !