দেশবিভাগের পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠিত হলে শুরু থেকেই বাঙালিরা নিপীড়ন ও বঞ্চনার শিকার হন । আর এই সময় জাতির কাণ্ডারি হিসেবে আবির্ভূত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে দেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু। ফিরেই যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশকে গড়ে তুলতে বিরামহীন কাজ শুরু করেন। দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি সূচনা করে গেছেন অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের।
স্বদেশে ফেরা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী পরিচালনা করে মানবেতিহাসের ঘৃণ্য ও নৃশংসতম অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা ঘোষণা করেন ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা’। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানে । অন্তরীণ করে রাখা হয় বিভিন্ন কারাগারে।
অবশেষে মুজিবনগর সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালির জীবনে আসে মহা মাহেন্দ্রক্ষণ-১৬ ডিসেম্বর। দেশ হয় হানাদারমুক্ত। অন্য দিকে তখনও বঙ্গবন্ধু বন্দি পাকিস্তানের কারাগারে । বৈশ্বিক রাজনৈতিক চাপে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিলে তিনি প্রথমে পাকিস্তান সরকারের চার্টার করা পিআইএ-এর বিশেষ বিমানে লন্ডন পৌঁছান এবং বৈঠক করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ভারত হয়ে ফিরে আসেন প্রিয় স্বদেশের মাটিতে।
জাতি গঠনে বঙ্গবন্ধু
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে স্বাধীনতা পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে তিনি বাংলাদেশকে শক্ত ভিত্তির ওপর স্থাপন করেন ।
বঙ্গবন্ধুর শপথ গ্রহণ
১১ জানুয়ারি তাজউদ্দীন আহমদের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংসদীয় ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত হয়। একই দিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু সাময়িক Provisional Constitution of Bangladesh Order, ১৯৭২ জারি করেন। সে অনুযায়ী দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে পরদিন, ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দেন।
[penci_related_posts dis_pview=”no” dis_pdate=”no” title=”এই বিভাগ থেকে আরো পড়ুন” background=”” border=”” thumbright=”no” number=”4″ style=”list” align=”none” withids=”” displayby=”cat” orderby=”rand”]নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবু সাঈদ চৌধুরীকে শপথ করান প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। এরপর রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে ও তাঁর মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান । এর আগে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নতুন রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন ।
সংবিধান প্রণয়ন
রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ২৩ মার্চ Constituent Assembly of Bangladesh Order, ১৯৭২ জারি করেন। উক্ত আদেশের অধীন গণপরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদকে সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ১০ এপ্রিল মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের সভাপতিত্বে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট ‘খসড়া সংবিধান প্রণয়ন’ কমিটি গঠন করা হয়।
১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘খসড়া সংবিধান’ বিল আকারে গণপরিষদে উত্থাপন করা হয়। উত্থাপিত বিলের ওপর আলোচনার পর ৪ নভেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত হয়। সংবিধান কার্যকর হয় ১৬ ডিসেম্বর ।
বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা
১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন করা হয় । এই তালিকাটি নিস্বরূপ—
মন্ত্রী | দপ্তর |
শেখ মুজিবুর রহমান | প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, তথ্য ও বেতার, মন্ত্রিপরিষদ ও সংস্থাপন । |
সৈয়দ নজরুল ইসলাম | শিল্প ও বাণিজ্য |
তাজউদ্দীন আহমদ | অর্থ, পরিকল্পনা ও রাজস্ব |
এম মনসুর আলী | যোগাযোগ |
এ এইচ এম কামারুজ্জামান | ত্রাণ ও পুনর্বাসন |
খন্দকার মোশতাক আহমদ | বিদ্যুৎ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ |
আবদুস সামাদ আজাদ | পররাষ্ট্র |
শেখ আবদুল আজিজ | স্থানীয় প্রশাসন ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় |
অধ্যাপক ইউসুফ আলী | শিক্ষা ও সংস্কৃতি |
জহুর আহমদ চৌধুরী | শ্রম, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা |
কামাল হোসেন | আইন ও সংসদ, সংবিধান প্ৰণয়ন |
ফণীভূষণ মজুমদার | খাদ্য ও সরবরাহ |
১৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের প্রথম ১০ পঙক্তি জাতীয় সংগীত হিসেবে এবং কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ জাতীয় সমর সংগীত হিসেবে অনুমোদিত হয় ।
ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার
১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর ছিল ভারতের কলকাতায়। সেখানে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের তারিখ ১৭ মার্চ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ ভারতীয় সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করে নেন। ১৭ মার্চ স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম (৫৩তম) জন্মদিনে ঢাকা সফর করেন ইন্দিরা ।
মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমৰ্পণ
মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে থাকা অস্ত্র সরকারের কাছে সমর্পণের জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করে দেন। সে অনুযায়ী ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অস্ত্র সমর্পণ করে কাদেরিয়া বাহিনী ।
জাতীয়করণ কর্মসূচি
২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গবন্ধু Bangladesh Act 1972-এর আওতায় Nationalization জাতীয়করণ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। বিদেশি ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি ছাড়া তৎকালীন স্বাধীন বাংলাদেশে যত ব্যাংক, বীমা কোম্পানি এবং শিল্পকারখানা ছিল, সেগুলো জাতীয়করণ করা হয় ।
পরিকল্পনা কমিশন গঠন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র দেড় মাসের মধ্যে তথা ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন’ গঠন করেন। ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম ৪টি পরিসংখ্যান সংস্থাকে একীভূত করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৭৫ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরোকে প্রশাসনিক সহযোগিতা ও দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতায় পরিসংখ্যান বিভাগ সৃষ্টি করেন ।
প্রথম সাধারণ নির্বাচন
সংবিধান অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ ১৫টি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে দেশে সর্বপ্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৩ আসনে জয়লাভ করে। সংরক্ষিত নারী আসন ছিল ১৫টি। সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হয়। সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল।
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি ১৯৭৩-৭৮ সাল পর্যন্ত প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার সময় নির্ধারণ করেন ।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ কোলাবরেটরস স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল অর্ডার’ জারি করে। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে বিরুদ্ধাচরণকারী ও হানাদার বাহিনীর সাহায্যকারী রাজাকারদের বিচারের আওতায় আনা হয় ৷
বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি
১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় স্বাক্ষরিত হয় ‘The Indo-Bangla Treaty of Friendship, Cooperation and Peace‘ । বাংলাদেশের পক্ষে বঙ্গবন্ধু ও ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তির মেয়াদ ছিল ২৫ বছর।
শিক্ষাক্ষেত্রে পদক্ষেপ
১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই বঙ্গবন্ধু ড. মুহাম্মদ কুদরত- এ-খুদাকে সভাপতি করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এটি কুদরত-এ-খুদা কমিশন নামে পরিচিত । এতে শিক্ষা ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। ফলে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন লাভ করে।
বঙ্গবন্ধু ৩৬,১৬৫টি প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ১,৫৭,৭৪২ জন শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করেন। এ সময় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ মিলিয়ে ১ হাজার ৩০০ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে ৯০০ কলেজ ভবন ও ৪০০ হাই স্কুল পুনর্নির্মাণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু সরকার জাতিসংঘের সহায়তায় ৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করে।
নারী পুনর্বাসন বোর্ড
মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের সম্মানের সঙ্গে পুনর্বাসনের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭২ সালের ১৫ জুলাই বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন বোর্ড (Bangladesh Women’s Rehabilitation Board) গঠন করা হয়। টিসিবি গঠন
বঙ্গবন্ধু সরকার আমদানি- রফতানি বিষয়ক কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ১২ জুন ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ আইন ১৯৭২ জারি করেন।
বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি
বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে মোট ১২৭টি দেশের স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ। ভুটান ও ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর।
জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে পদক্ষেপ
তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, উত্তোলন ও ব্যবহারের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘বাংলাদেশ মিনারেল, এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড গ্যাস কর্পোরেশন’ (BMEDC) এবং খনিজ তেল ও গ্যাস খাতকে নিয়ে ‘বাংলাদেশ ওয়েল অ্যান্ড গ্যাস কর্পোরেশন’ (BOGC) গঠন করেন।
গ্যাস অনুসন্ধানে ১৯৭৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত ২৫টি কূপ খনন করা হয়। এর ফলে আটটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট দেশের জ্বালানি খাতে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন বঙ্গবন্ধু। ব্রিটিশ কোম্পানি শেল অয়েলের কাছ থেকে তিতাস, হবিগঞ্জ, কৈলাশটিলা, বাখরাবাদ ও রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্র কিনে সেগুলোতে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন।
জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে এত ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন যে তা সীমাবদ্ধ শব্দের লেখায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবু একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর সহস্র সফলতার মধ্য থেকে কয়েকটি এখানে উল্লেখিত হলো ।