![বিসিএস প্রস্তুতি সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী](https://preparation.com.bd/wp-content/uploads/2024/06/04-780x470.jpg)
মুসলিম হিসেবে মানুষের মৌলিক অধিকারের ধারণা আমাদের কাছে নতুন নয়। অন্য লােকদের দৃষ্টিতে মৌলিক মানবাধিকারের ইতিহাস জাতিসংঘ সনদ থেকে শুরু হয়েছে, কিংবা ইংল্যান্ডের ম্যাগনাকার্টা (Magna Carta) থেকে সূচিত হয়েছে। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে এ ধারণার সূচনা হয়েছে অনেক আগে। পাশ্চাত্য জগতে দু-তিন শতাব্দী। আগেও মানবাধিকার ধারণার কোনাে ইতিহাস নেই। অপরদিকে ইসলাম কুরআন মজীদে মানবাধিকারের যে ঘােষণাপত্র দিয়েছে এবং বিদায় হজ্জের ভাষণে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার যে সার সংক্ষেপ পেশ করেছেন সেগুলাে তাদের চেয়ে প্রাচীন। নিম্নে ইসলাম প্রদত্ত মানবাধিকারগুলাের কয়েকটি সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলাে।
জীবনের মর্যাদা বা বেঁচে থাকার অধিকার
কুরআন মজীদে পৃথিবীর প্রথম হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ করা হয়েছে। সেটি ছিলাে মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম দুঃখজনক ঘটনা। সেখানে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে হত্যা করেছিল। প্রথম বারের মতাে তখনই প্রয়ােজন দেখা দেয় মানুষকে মানুষের প্রাণের মর্যাদা শেখানাের এবং একথা বলে দেয়ার যে, প্রত্যেক মানুষেরই বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এ ঘটনার উল্লেখ করার পর কুরআন বলছে- “কোনাে ব্যক্তি যদি এমন কোনাে লােককে হত্যা করে, যে লােক কাউকেও হত্যার অপরাধে অপরাধী নয়, কিংবা পৃথিবীতে বিপর্যয়ও সৃষ্টি করেনি; সে (হত্যাকারী) যেনাে গােটা মানব জাতিকেই হত্যা করলাে। আর যে তাকে বাঁচিয়ে রাখে সে যেনাে গােটা। মানব জাতিকে বাঁচালাে।” (আল-মায়েদা : আয়াত-৩২) কেবল দুটি অবস্থায় এ নীতির ব্যতিক্রম করা যাবে
- কোনাে ব্যক্তি হত্যার অপরাধে অপরাধী হলে কিসাস নেয়ার জন্য (বিচারের মাধ্যমে) তাকে হত্যা করা যাবে।
- কোনাে ব্যক্তি পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করলে তাকেও (হত্যা করা যাবে (বিচারের মাধ্যমে) ।
এ দুটি ব্যতিক্রমী অবস্থা ছাড়া আর কোনাে অবস্থায়ই মানুষ হত্যা করা যাবে না।
ন্যায় আচরণ লাভের অধিকার
কুরআন মজীদ একটি অলংঘণীয় নীতি প্রদান করেছে যে, মানুষের প্রতি ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : “কোনাে সম্প্রদায়, গােষ্ঠী বা দলের প্রতি শত্রুতা তােমাদেরকে যেনাে তাদের প্রতি বে-ইনসাফি করতে উৎসাহিত না করে। ইনসাফ করাে এটি তাকওয়ার সর্বাধিক নিকটবর্তী।” (আলমায়েদা : আয়াত ৮)
অক্ষম ও দুর্বলদের নিরাপত্তা লাভের অধিকার
কুরআন এবং রসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী থেকে স্পষ্ট জানা যায় : নারী, শিশু, বৃদ্ধ, পঙ্গু ও অসুস্থ মানুষ নিজ জাতির লােক হােক কিংবা শক্র কওমের লােক, কোনাে অবস্থায়ই তাদের ওপর আঘাত করা বৈধ নয়। তবে তারা যুদ্ধরত থাকলে ভিন্ন কথা। তা না হলে অন্য যে কোনাে অবস্থায়ই তাদেরকে আঘাত করা নিষিদ্ধ। এ নীতি শুধু নিজ জাতির জন্য নয়। বরং গােটা মানবতার জন্যেই এ নীতি প্রযােজ্য। মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে অত্যন্ত স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। খােলাফায়ে রাশেদীন শত্রুর বিরুদ্ধে কোনাে সেনাবাহিনী পাঠানাের সময় গােটা সেনাদলকে সম্বােধন করে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিতেন : ‘শক্রর ওপর আক্রমণের সময় কোনাে নারী, শিশু, বৃদ্ধ, আহত, পঙ্গু ও রুগ্ন ব্যক্তিকে আঘাত করবে না।’
ভালাে কাজে সহযােগিতা এবং মন্দ কাজে অসহযােগিতা
কুরআন আরাে একটি মূলনীতি দিয়েছে। তা হলাে, ভালাে ও ন্যায়ের কাজে সবার সাথে সহযােগিতা করা এবং অন্যায় ও জুলুমের কাজে কারাে সাথে সহযােগিতা। না করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন : “কল্যাণমূলক কাজে। সবার সাথে সহযােগিতা করাে এবং পাপ কাজে কারাে সাথে সহযােগিতা করােনা” (আল-মায়েদা : আয়াত ২)।
মহিলাদের মান-সম্ভ্রমের নিরাপত্তা লাভের অধিকার
কুরআন মজীদ থেকে আরাে একটি মৌলিক অধিকারের কথা জানা যায়। এটি সম্পর্কে হাদিসেও বিস্তারিতভাবে উল্লেখিত হয়েছে। সেটি হলাে, নারীদের মান-সম্ভমের প্রতি সর্বাবস্থায় অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে। অর্থাৎ যুদ্ধ ক্ষেত্রেও যদি শুক্র কওমের নারীরা মুসলমান। সৈনিকদের হস্তগত হয় তাহলে তাদের ওপর হস্তক্ষেপ করা কোনাে মুসলমান সৈনিকের জন্যে বৈধ নয়। কুরআনের নির্দেশ অনুসারে যে কোনাে নারীর সাথে ব্যভিচার হারাম। সে নারী মুসলিম হােক বা অমুসলিম স্বজাতির হােক বা বিজাতির। বন্ধু দেশের হােক বা শত্রু দেশের-তাতে কিছু আসে যায় না।
অন্ন, বস্ত্র ও চিকিত্সা পাবার অধিকার
ক্ষুধার্তকে সর্বাবস্থায় খাবার দিতে হবে-এটি একটি মৌলিক নীতি। বস্ত্রহীনকে সর্বাবস্থায় বস্ত্র দিতে হবে। আহত এবং রুগ্ন ব্যক্তি সর্বাবস্থায় চিকিৎসার সুযােগ সুবিধা লাভের আধিকারী। ভুখা-নাঙ্গা, আহত এবং রুগ্ন ব্যক্তি শত্রু হােক বা বন্ধু হােক তাতে কিছু যায় আসে না, তাকে তার অধিকার প্রদান করতে হবে। কারণ এটি একটি সার্বজনীন (Universal) অধিকার। শক্রর সাথেও আমরা এ একই আচরণ করবাে। শত্ৰু কওমের কোনাে ব্যক্তি আমাদের হস্তগত হলে আমাদের অবশ্য কর্তব্য হবে তাকে ভুখা-নাঙ্গা না রাখা। আর আহত বা অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। (আয-যারিয়াত : আয়াত ১৯ এবং সূরা আল ইনসান : আয়াত ৮)
সমতার অধিকার
আরেকটি নীতি কুরআন মজীদ অত্যন্ত জোরালােভাবে বলে দিয়েছে। নীতিটি হলাে, সকল মানুষ সমান। কেউ মর্যাদা লাভ করলে তা করবে উত্তম নৈতিক চরিত্রের কারণে। এ ব্যাপারে কুরআন ঘােষণা করেছে- “হে মানবজাতি, আমি তােমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং ভিন্ন ভিন্ন গােষ্ঠী ও গােত্রে বিভক্ত করেছি – যাতে করে তােমরা পরস্পরকে চিনতে পারাে। তবে তােমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বেশি আল্লাহভীরু সে-ই সর্বাপেক্ষা মর্যাদাবান।” (সূরা- হুজুরাত : আয়াত ১৩)
ব্যক্তি স্বাধীনতা
ইসলামের আর একটি মৌলনীতি হলাে, অন্যায়ভাবে কোনাে ব্যক্তির স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করা যাবে না। কোনাে ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ করার জন্য তার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযােগ আনা, প্রকাশ্য আদালতে তার বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করা এবং তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের পুরােপুরি সুযােগ দেয়া ছাড়া কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণকে ন্যায়ানুগ ব্যবস্থা বলা যাবে না। সাধারণ বিবেক-বুদ্ধিরও দাবি হলাে, অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ দেয়া ছাড়া ইনসাফ হতে পারে না। ন্যায়ের দাবি পূরণ করা ইসলামী সরকার ও বিচার বিভাগের জন্য কুরআন আবশ্যিক করে দিয়েছে। (‘তােমরা যখন বিচার করবে ন্যায় বিচার করবে। – নিসা : আয়াত ৫৮)।
ব্যক্তি মালিকানার নিরাপত্তা
আর একটি মৌলিক অধিকার হলাে মানুষের ব্যক্তি মালিকানার অধিকার। এ ব্যাপারে কুরআন মজীদ সুস্পষ্ট ধারণা পেশ করেছে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন- “তােমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের অর্থ-সম্পদ ভােগ দখল করাে। না।” (আল বাকারা : আয়াত ১৮৮)। কুরআন, হাদিস ও ফিকহ অধ্যয়ন করলে অপরের অর্থ সম্পদ ভােগের * অন্যায় পন্থা কি কি তা জানা যায়। এসব অবৈধ পন্থা ইসলাম অস্পষ্ট রেখে দেয়নি। এ নীতি অনুসারে কোনাে ব্যক্তির সম্পদ অবৈধভাবে হস্তগত করা যায় না।
মান-সম্মানের নিরাপত্তার অধিকার
মান-সম্ভ্রমের নিরাপত্তা লাভ করাও মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। এ অধিকার সম্পর্কে কুরআনে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলছেন- “তােমাদের মধ্যকার একদল যেন আরেক দলকে নিয়ে হাসি-তামাশা বিদ্রুপ না করে।” (সূরাহুজুরাত : আয়াত-১১) তােমরা একজন অন্যজনকে মন্দ উপাধি দিয়ে ডেকো না।’ (সূরা হুজুরাত : আয়াত১১)। “তােমরা একে অপরের নিন্দা (অসাক্ষাতে) করাে।” (সূরা- হুজরাত : আয়াত-১২)। অর্থাৎ মানুষের সম্মান ও সম্ভ্রমের ওপর আক্রমণ করার। যতাে উপায় ও পন্থা হতে পারে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার
মানুষের আরাে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হলাে, স্বাধীন মতামত প্রকাশ করার (Freedom of expressian) অধিকার। কুরআন এটাকে বলেছে, “আমর বিল মারুফ ও না আনিল মুনকার” । এটা মানুষের শুধু অধিকারই নয় বরং এটা তার জন্য কুরআন ও হাদিস উভয়ের নির্দেশ অনুসারেই ফরয। (কুরআন বলে- “তােমরা শ্রেষ্ঠ উম্মাহ। মানবতার কল্যাণের জন্যে তােমাদের উত্থান ঘটানাে হয়েছে। তােমরা মারূফ (ভালাে) কাজের আদেশ করবে এবং মুনকার (মন্দ কাজ করতে নিষেধ করবে।”) মানুষের জন্য ফরয (কর্তব্য) হলাে সে অন্য মানুষকে ভালাে বা কল্যাণের কাজের জন্য আহবান জানাবে এবং মন্দ বা অকল্যাণের কাজ থেকে বিরত থাকতে বলবে।
স্বাধীন বিবেক ও বিশ্বাসের অধিকার
ইসলাম মানবতাকে দিয়েছে- “দীনের ক্ষেত্রে কোনাে জবরদস্তির অবকাশ নেই” -এর নীতি। এ নীতি অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তি কুফরি বা ঈমান এ দুটি পথের যে কোনােটি গ্রহণ করার স্বাধীনতা রাখে। বিবেক ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়ােগের সুযােগ ইসলামে নেই।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত থেকে বাঁচার অধিকার
বিভিন্ন ধর্মীয় গােষ্ঠী পরস্পরের বিরুদ্ধে অশােভন মন্তব্য করুক এবং একে অপরের ধর্মীয় নেতাদের প্রতি কাদা। ছােড়াছুড়ি করুক ইসলাম তার পক্ষপাতী নয়। কুরআন প্রত্যেক ব্যক্তির ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস এবং তার ধর্মীয় নেতাদের মর্যাদা দিতে শিখিয়েছে। কুরআন বলে- “তারা আল্লাহ ছাড়া আর যেসব বস্তুকে উপাস্য বানিয়ে ডাকে তােমরা তাদের (সেসব উপাস্যকে) গালমন্দ করাে না।” (আল কুরআন, সূরা আল-আন’আম । আয়াত : ১০৮) অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্ম ও আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে কথা বলা এবং তার যুক্তিসংগত সমালােচনা করা অথবা মতানৈক্য প্রকাশ করা স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করার জন্য। কটুক্তি বা গাল-মন্দ করা অন্যায়।
অপরের কর্মকাণ্ডের দায়দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির অধিকার
ইসলাম বলে, মানুষ শুধু নিজের কাজকর্ম এবং নিজের কৃত অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য। অন্য। কারাে অপরাধ বা কৃতকর্মের জন্য তাকে পাকড়াও করা যাবেনা। কুরআন প্রদত্ত মৌলনীতি হলাে : “কোনাে বােঝা বহনকারী অন্য কারাে বােঝা বহন করবে না” (সুরাআল আন’আম : আয়াত ১৬৪)। ইসলামী আইনে। উদোর পিণ্ডি বুধাের ঘাড়ে চাপানাের কোনাে সুযােগ নেই।
উপসংহার
মােটামুটি এগুলােই হচ্ছে ইসলাম প্রদত্ত মৌলিক মানবাধিকার। ইসলাম মানুষকে এসব অধিকার প্রদান করেছে। ইসলামে মৌলিক মানবাধিকারের ধারণা অত্যন্ত স্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ । মুসলমানদেরকে যেমন এসব অধিকার দিতে হবে তেমনি অন্যান্য ধর্মের ও জাতির লােকদেরও দিতে হবে। এ জন্য এমন কোনাে চুক্তির প্রয়ােজন হবে না যে অমুক জাতি আমাদেরকে এ অধিকার দিলে আমরাও তাদেরকে তা দেবাে। বরং মুসলমানরা সর্বাবস্থায় বন্ধু ও শত্রু সবাইকে এ সব অধিকার দিতে বাধ্য থাকবে।