শিক্ষা

সৈয়দ আহমদ খান ও আলীগড় আন্দোলন এবং আন্দোলনের আদর্শ ও উদ্দেশ্য

স্যার সৈয়দ আহমদ ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য-শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান বিস্তারে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসমপন্ন এক ব্যক্তিত্ব। তিনি চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, ধার্মিক, | দেশপ্রেমিক এবং জনদরদী ছিলেন। তিনিও বাংলার নওয়াব আবদুল লতিফের ন্যায় মুসলিম নবজাগরণের অগ্রদূত ছিলেন। তিনি ছিলেন আলীগড় আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা।

সৈয়দ আহমদ খান ১৮১৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইংরেজ সরকারের অধীনে বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৮৫৭ সালের সংগ্রামের সময় তিনি সরকারের প্রতি অনুগত ছিলেন। তাঁর আনুগত্যের জন্য সরকার তাকে পুরস্কৃত করেন। উনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজের দমন ও নির্যাতনে মুসলমান জাতি যখন চরমভাবে নিষ্পেষিত ও নিপীড়িত তখন তিনি জাতির ত্রাণকর্তারূপে আবির্ভূত হন।

মুসলমান সমাজের দুঃখ, দুর্দশা ও দুর্গতি তাঁকে চরমভাবে ব্যথিত করে। তিনি উপলব্ধি করেন, মুসলমানদের পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি ঘৃণা ও উদাসীনতা তাদের দুঃখ-দৈন্যের কারণ। তিনি বুঝতে পারেন, ইংরেজদের সঙ্গে সহযােগিতা ব্যতীত মুসলমানদের উন্নতির কোনাে বিকল্প পথ নেই। পাশ্চাত্য-শিক্ষা ব্যতীত রাজনৈতিক অধিকার লাভ করাও তাদের জন্য সম্ভব নয়। তাই তিনি মুসলমান সমাজে জ্ঞান-বিজ্ঞান বিস্তারে ব্রতী হন এবং বাস্তবমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেন।

আলীগড় আন্দোলন

শিক্ষাক্ষেত্রে সৈয়দ আহমদের প্রচেষ্টা ছিল মুসলমান সমাজকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং ধর্মীয় গোঁড়ামী দূর করে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। মুসলমান সমাজের মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই প্রগতিমূলক ভাবধারা গড়ে তােলার জন্য সৈয়দ আহমদ যে আন্দোলনের সূত্রপাত করেন, তা আলীগড় আন্দোলন নামে সুপরিচিত।

তিনি মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য-শিক্ষা ও পাশ্চাত্য-ভাবধারা প্রসারের উদ্দেশ্যে ১৮৫৭ সালে আলীগড়ে প্রথমে মােহামেডান এ্যাংলাে ওরিয়েন্টাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এ স্কুলের পাঠ্যক্রম কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ড কলেজের অনুকরণে প্রণীত হয়েছিল। এ কুল ধীরে ধীরে কলেজ এবং কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। তিনি “মােহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স’ নামে একটি সংস্থা স্থাপন করেন। এ সংস্থার কাজ ছিল আলীগড় আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য প্রচার করা। এভাবে তিনি আলীগড় আন্দোলনের সূত্রপাত করেন।

আদর্শ ও উদ্দেশ্য :

আলীগড় আন্দোলনের আদর্শ ও উদ্দেশ্য ছিল নিম্নরূপ :

  • মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটানাে।
  • ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনুগত হওয়া এবং সরকারের কর্মকাণ্ডে সহযােগিতা করা।
  • মুসলমানদের জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা।
  • তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করা।
  • বিশ্বসভ্যতায় মুসলমানদেরকে তাদের অবদান সম্পর্কে সচেতন করে তােলা।

সৈয়দ আহমদ খান মুসলমানদেরকে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে উপদেশ দিতেন। সে জন্য ভারতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর কংগ্রেসে যােগ দিতে তাদের নিষেধ করেন। আলীগড় আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটায়। এ আন্দোলনের ফলে ইংরেজদের সাথে মুসলমানদের সহযােগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। ইংরেজি ও পাশ্চাত্য-শিক্ষা গ্রহণ করে সরকারি চাকরির সুযােগ পায় ।

আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় পাশ্চাত্য-শিক্ষা ও ব্রিটিশ সহযােগিতার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এ আন্দোলন মুসলমান সমাজের মধ্যে ইংরেজ-শাসনের প্রতি আনুগত্য সৃষ্টি করে এবং কংগ্রেসের প্রভাব থেকে মুসলমানদেরকে দূরে সরিয়ে রাখে। এ আন্দোলনের ফলেই মুসলিম লীগ জন্মলাভ করে। এ আন্দোলনই পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতার পটভূমি তৈরি করে। আলীগড় আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ অবদান মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়বােধের বিকাশ ঘটানাে।

এই বিভাগ থেকে আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button