লুইস হেনরি মর্গান: সমাজবিজ্ঞানের পথিকৃৎ

লুইস হেনরি মর্গান (1818-1881) ছিলেন একজন প্রভাবশালী মার্কিন নৃতত্ত্ববিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও আইনবিদ। তাকে আধুনিক নৃতত্ত্বের জনক বলা হয়। তিনি মূলত সমাজের বিবর্তনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, আত্মীয়তার কাঠামো এবং আদিম সমাজব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করেছেন।
জীবনী
বিষয় | বিবরণ |
---|---|
জন্ম | ২১ নভেম্বর, ১৮১৮ |
জন্মস্থান | অরোরা, নিউ ইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র |
শিক্ষা | ইউনিয়ন কলেজ |
মৃত্যু | ১৭ ডিসেম্বর, ১৮৮১ |
প্রধান কাজ | “Ancient Society”, “Systems of Consanguinity and Affinity of the Human Family” |
লুইস হেনরি মর্গান নিউ ইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন এবং আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি নৃতত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং স্থানীয় আদিবাসী সমাজগুলোর জীবনধারা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি ইরোকোইস জাতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিলেন এবং তাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কাঠামো নিয়ে কাজ করেছেন। তার গবেষণার মাধ্যমে সমাজের বিবর্তন নিয়ে নতুন ধারণা উঠে আসে।
গবেষণা ও তত্ত্ব
১. সমাজের বিবর্তনবাদী ধারণা
লুইস হেনরি মর্গান সমাজের বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করেন এবং তিনটি ধাপে মানব সমাজের অগ্রগতি ব্যাখ্যা করেন:
স্তর | বৈশিষ্ট্য |
---|---|
বর্বরতা (Savagery) | খাদ্য সংগ্রহ ও শিকার, আগুনের ব্যবহার, মৌলিক অস্ত্র তৈরি |
বর্বরতা (Barbarism) | কৃষি ও পশুপালন, স্থায়ী বসতি স্থাপন, মৃৎশিল্প ও ধাতুর ব্যবহার |
সভ্যতা (Civilization) | লিখিত ভাষার প্রচলন, নগরায়ন, সংগঠিত সরকার ও শিল্পবিপ্লব |
এই তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে সমাজ ধাপে ধাপে উন্নত হয়েছে এবং কিভাবে প্রতিটি ধাপ মানবজীবনের বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করেছে।
২. আত্মীয়তা ও সামাজিক সংগঠন
তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল আত্মীয়তার কাঠামো নিয়ে গবেষণা। তিনি আত্মীয়তার পারিবারিক সম্পর্ক ও সামাজিক সংগঠনের ওপর ব্যাপক গবেষণা করেন এবং দেখান কিভাবে আত্মীয়তার নীতিমালা সমাজকে পরিচালিত করে। তিনি আত্মীয়তার দুটি প্রধান ধরন ব্যাখ্যা করেন:
- বংশগত আত্মীয়তা (Descent-based Kinship): যেখানে পারিবারিক উত্তরাধিকার পিতৃ বা মাতৃগণের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।
- সম্পর্কগত আত্মীয়তা (Affinal Kinship): বিবাহের মাধ্যমে গঠিত আত্মীয়তার সম্পর্ক।
তার এই গবেষণাগুলো সমাজতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণার ভিত্তি তৈরি করে।
প্রধান গ্রন্থ ও অবদান
মর্গানের উল্লেখযোগ্য দুটি গ্রন্থ হলো:
- “Ancient Society” (1877) – এই গ্রন্থে তিনি সমাজের বিবর্তন নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন এবং দেখান কিভাবে মানব সভ্যতা বিভিন্ন ধাপে উন্নতি লাভ করেছে।
- “Systems of Consanguinity and Affinity of the Human Family” (1871) – এই গ্রন্থে তিনি আত্মীয়তার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন। এখানে তিনি প্রমাণ করেন কিভাবে আত্মীয়তার কাঠামো সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তিনি মার্ক্স ও এঙ্গেলসের সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাধারার ওপর প্রভাব ফেলেছিলেন। তার সমাজের বিবর্তন তত্ত্বের ভিত্তিতে কার্ল মার্ক্স তার ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism) তত্ত্বকে আরও বিকশিত করেছিলেন।
মর্গানের উত্তরাধিকার
লুইস হেনরি মর্গানের কাজ আজও সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব এবং ঐতিহাসিক গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তার গবেষণা বিশেষত আত্মীয়তা ও সামাজিক সংগঠনের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
তার গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করে আধুনিক নৃতত্ত্ববিদরা সমাজের বিভিন্ন কাঠামো বিশ্লেষণ করেন। ইরোকোইসদের জীবনধারা নিয়ে তার গবেষণা উত্তর আমেরিকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের সম্পর্কে আধুনিক গবেষণার ভিত্তি স্থাপন করেছে।
উপসংহার
লুইস হেনরি মর্গান ছিলেন সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান পথিকৃৎ। তার গবেষণা সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশ বুঝতে অমূল্য অবদান রেখেছে। তার গবেষণার ফলে আধুনিক নৃতত্ত্ব ও সমাজবিজ্ঞানে আত্মীয়তার কাঠামো, সামাজিক সংগঠন এবং সমাজের বিবর্তন নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করা সম্ভব হয়েছে। তার তত্ত্ব ও গবেষণা আজও একাডেমিক জগতে আলোচিত হয় এবং নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।