যেসব তথ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিক সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব, তাকেই ইতিহাসের উপাদান বলা হয় । ইতিহাসের উপাদানকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায় । যথা : লিখিত উপাদান ও অলিখিত উপাদান ।
১. লিখিত উপাদান
ইতিহাস রচনার লিখিত উপাদানের মধ্যে রয়েছে সাহিত্য, বৈদেশিক বিবরণ, দলিলপত্র ইত্যাদি। বিভিন্ন দেশি- বিদেশি সাহিত্যকর্মেও তৎকালীন সময়ের কিছু তথ্য পাওয়া যায়। যেমন: বেদ, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’, কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’, মিনহাজ-উস-সিরাজের তবকাত-ই-নাসিরী’, আবুল ফজল-এর ‘আইন-ই-আকবরী’ ইত্যাদি ।
বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ সব সময়ই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে বিবেচিত হয়েছে। যেমন- পঞ্চম থেকে সপ্তম শতকে বাংলায় আগত চৈনিক পরিব্রাজক যথাক্রমে ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাং ও ইৎসিং-এর বর্ণনা । পরবর্তী সময়ে আফ্রিকান পরিব্রাজক ইবনে বতুতাসহ অন্যদের লেখাতেও এ অঞ্চল সম্পর্কে বিবরণ পাওয়া গিয়েছে। এসব বর্ণনা থেকে তৎকালীন সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায় ।
সাহিত্য উপাদান
- জীবনী গ্রন্থ : সন্ধ্যাকর নন্দীর- ‘রামচরিত’, বানভট্টের ‘হর্ষ চরিত চর্যাপদ, মঙ্গল কাব্য ইত্যাদি
- দেশীয় সাহিত্য : কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’, কালিদাসের ‘মেঘদূত’ ইত্যাদি।
- বিদেশি পর্যটকদের বিবরণী : মেগাস্থিনিসের ‘ইণ্ডিকা’, ফা-হিয়েনের ‘ফো-কুয়ো-কি’; হিউয়েন সাং-এর ‘সি-ইউ-কি’ ইবনে বতুতার ‘রিহালা’ ইত্যাদি।
- প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত, জাতক, পুরাণ ইত্যাদি।
- অন্যান্য : প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, সন্ধি-চুক্তি, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, ফেরদৌসীর শাহনামা ইত্যাদি।
২. অলিখিত উপাদান: প্রত্নতাত্ত্বিক
যেসব বস্তু বা উপাদান থেকে আমরা বিশেষ সময়, স্থান বা ব্যক্তি সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক তথ্য পাই, সেই বস্তু বা উপাদানই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এই নিদর্শনসমূহ মূলত অলিখিত উপাদান ।
(ক) লিপিমালা : সরকারি লিপি: যুদ্ধবিগ্রহ, ভূমিদান, রাজার আদেশ, রাজার নাম, রাজ্য জয়, রাজত্বকাল, ধর্মবিশ্বাস প্রভৃতি সম্পর্কে জানা যায়। বেসরকারি লিপি : এগুলো সাধারণত পাথরে মন্দিরের গায়ে লেখা হতো।
(খ) মুদ্রা : মুদ্রায় রাজার নাম, সন-তারিখ, রাজার মূর্তি, নানা দেব-দেবীর মূর্তি খোদাই করা থাকত। যা থেকে রাজার সময়কাল, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সমাজব্যবস্থা ও ধর্মবিশ্বাস প্রভৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
(গ) স্থাপত্য-ভাস্কর্য ও স্মৃতিসৌধ : প্রত্নকেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত প্রাচীন সমাধি, স্তম্ভ, স্মৃতি, প্রাচীন শিল্পকীর্তি, দেব-দেবীর মূর্তি, মৃৎশিল্প, মৃৎপাত্র ও তৈজসপত্রাদি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত। যেগুলো থেকে সভ্যতার উৎকর্ষ যেমন বোঝা যায়, তেমনি এতে নাগরিক জ্ঞানের সৌন্দর্যভাব ও সাংস্কৃতিক মনোভাবও ফুটে ওঠে।
(ঘ) প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন : বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, কুমিল্লার ময়নামতি, নরসিংদীর ‘উয়ারী-বটেশ্বর’ ও বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ ইত্যাদি।
(ঙ) প্রচলিত বিশ্বাস বা প্রথা : কিংবদন্তী, রূপকথা, গান, কাহিনিমালা, বেদ ইত্যাদি। বেদ প্রথম দিকে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। এজন্য একে ‘শ্রুতি’ বলা হতো। পরবর্তীকালে একাধিক রচয়িতা যেমন: ঋষি বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, ভরদ্বাজ, রামদেব, ভৃগু প্রমুখ দীর্ঘদিন ধরে বেদ রচনা করেন।
(চ) পুঁথি : একসময় পুঁথিও মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল।
এ সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বিশ্লেষণের ফলে সে সময়ের অধিবাসীদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ধারণা করা সম্ভব প্রাচীন অধিবাসীদের সভ্যতা, ধর্ম, জীবনযাত্রা, নগরায়ণ, নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র, ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা, কৃষি উপকরণ ইত্যাদি সম্পর্কে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় সিন্ধু সভ্যতা, বাংলাদেশের মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, ময়নামতি ইত্যাদি স্থানের প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনের কথা।
নতুন নতুন প্রত্নতত্ত্ব আবিষ্কার বদলে দিতে পারে একটি জাতির ইতিহাস। যেমন- সম্প্রতি নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নতত্ত্ব আবিষ্কার। এই আবিষ্কারের ফলে বাংলার প্রাচীন সভ্যতার নবদিগন্ত উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে বাংলার প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে অনেক ধারণা। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো নতুন ভাবে লিখতে হবে বাংলার প্রাচীন ইতিহাস।