ফুল্লরার বারোমাস্যা
মুকুন্দরাম চক্রবর্তী
কবি-পরিচিতি
মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (আনুমানিক ১৫৪০-১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ) মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারার অন্যতম প্রধান কবি। তাঁর পিতা হৃদয় মিশ্র এবং মাতা দৈবকী। তাঁর পৈতৃক নিবাস বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার দামুন্যা গ্রামে। সম্ভবত ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে মুকুন্দরাম পৈতৃক নিবাস ত্যাগ করে মেদিনীপুর জেলার আড়রা গ্রামে আশ্রয় নেন এবং সেখানকার জমিদারপুত্রের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। পরে জমিদার রঘুনাথ রায়ের সভাকবিরূপে তাঁরই প্রেরণায় ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্য রচনা করেন। উল্লেখযোগ্য এ কবিকর্মের জন্য জমিদার তাঁকে ‘কবিকঙ্কণ উপাধিতে ভূষিত করেন। মুকুন্দরামের পর্যবেক্ষণশক্তি ছিল অসাধারণ। মঙ্গলকাব্যের প্রথাগত সীমার মধ্যে থেকেও তিনি এতে বাস্তব জীবনচিত্র উপস্থাপনে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর কাব্যে সাধারণ বাঙালি জীবন, সমকালীন সমাজ ও পারিপার্শ্বিকতা, মানব চরিত্র চিত্রণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা অসামান্য রূপ লাভ করেছে। গণজীবনের করুণ চিত্র বিশ্বস্ততার সাথে অঙ্কনের জন্য তাঁকে দুঃখবাদী কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও তাঁর কাব্য মানবজীবনরসে পূর্ণ। স্বভাবগত কবিত্বশক্তির প্রসাদে তিনি তাঁর কাব্যে নাট্যগুণ ও উপন্যাসের বর্ণনা-নৈপুণ্যের সমন্বয় ঘটান। তাঁকে বাংলা সাহিত্যের ঔপন্যাসিকদের অগ্রদূত বলা হয়ে থাকে।
পাশেতে বসিয়া রামা কহে দুঃখবাণী।
ভাঙ্গা কুড়্যা ঘরখানি পত্রে ছাউনি ॥
ভেরাণ্ডার খাম তার আছে মধ্য ঘরে।
প্রথম বৈশাখ মাসে নিত্য ভাঙ্গে ঝড়ে ॥
পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রচণ্ড তপন।
খরতর পোড়ে অঙ্গ রবির কিরণ ॥
পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস ।
বেঙচের ফল খায়্যা করি উপবাস ॥
আষাঢ়ে পুরিল মহী নবমেঘে জল।
বড় বড় গৃহস্থের টুটয়ে সম্বল ॥
মাংসের পসরা লয়্যা বুলি ঘরে ঘরে।
কিছু খুদ-কুড়া মিলে উদর না পার॥
শ্রাবণে বরিষে মেঘ দিবস রজনী।
সিতাসিত দুই পক্ষ একই না জানি ॥
অভাগ্য মনে গুণি অভাগ্য মনে গুণি।
কত শত খায় জোঁক নাহি খায় ফণী ॥
ভাদ্রপদ মাসে বড় দুরন্ত বাদল ।
নদনদী এককার আটদিকে জল ॥
আশ্বিনে অম্বিকা পুজা করে জনে জনে।
ছাগল মহিষ মেষ দিয়া বলি দানে ॥
উত্তম বসনে বেশ করয়ে বনিতা।
অভাগী ফুল্লরা করে উদরের চিন্তা॥
কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ।
যগজনে করে শীত-নিবারণ বাস॥
নিযুক্ত করিলা বিধি সভার কাপড় ।
অভাগী ফুল্লরা পরে হরিণের ছড় ॥
মাস মধ্যে মাস্যর আপনে ভগবান ।
হাটে মাঠে গৃহে গোঠে সভাকার ধান॥
উদয় পুরিয়া অন্ন দৈবে দিলা যদি।
যম-শম শীত তথি নিরমিলা বিধি ৷
পউষে প্রবল শীত সুখী যগজন।
তুলি পাড়ি পাছড়ি শীতের নিবারণ॥
হরিণী বদলে পাইনু পুরাণ খোসলা।
উড়িতে সকল অঙ্গে বরিষয়ে ধুলা |
মাঘে কুজ্বটিকা প্রভু মৃগয়াতে যায় ।
আন্ধারে লুকায় মৃগ দেখিতে না পায়॥
সহজে শীতল ঋতু ফাল্গুন যে মাসে।
পোড়ায় রমণীগণ বসন্ত বাতাসে ॥
অনল সমান পোড়ে চইতের খরা।
চালু সেরে বান্ধা দিনু মাটিয়া পাথরা॥
দুঃখ কর অবধান দুঃখ কর অবধান ।
আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ্যমান ॥