পরিচয়
কিতাব শব্দের অর্থ লিপিবদ্ধ বা লিখিত বস্তু। এর প্রতিশব্দ হলো গ্রন্থ, পুস্তক, বই ইত্যাদি। আসমানি কিতাব হলো এমন গ্রন্থ যা আল্লাহ তায়ালা থেকে অবতীর্ণ হয়েছে ।
ইসলামি পরিভাষায়, যেসব কিতাব আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির হিদায়াতের জন্য দিকনির্দেশনা স্বরূপ নাজিল করেছেন তাকে আসমানি কিতাব বলে। অন্যকথায় আল্লাহ তায়ালার বাণী সম্বলিত গ্রন্থাবলিকে আসমানি কিতাব বলা হয়। সুতরাং আসমানি কিতাব হলো আল্লাহর বাণীসমষ্টি। আল্লাহ তায়ালা জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে তাঁর বাণী রাসুলগণের নিকট প্রেরণ করেছেন। অতঃপর নবি-রাসুলগণ তা মানুষের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন ।
আসমানি কিতাবের বিষয়বস্তু
আল্লাহ তায়ালা আসমানি কিতাবসমূহে নানা বিষয়ের আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। যেমন-
- আল্লাহ তায়ালার সত্তাগত পরিচয় ।
- আল্লাহ তায়ালার গুণাবলির বর্ণনা ।
- নবি-রাসুলগণের বর্ণনা ।
- পূর্ববর্তী জাতিসমূহের বিবরণ ।
- অবাধ্য ও কাফিরদের পরিণতির বিবরণ
- হালাল-হারামের বর্ণনা।
- বিধি-বিধান সংক্রান্ত বিবরণ ।
- শাস্তি ও সতর্কীকরণ বিষয়ে আলোচনা ।
- উপদেশ ও সুসংবাদ সম্পর্কে বিবরণ ।
- আকিদা সংক্রান্ত বিষয়সমূহের বিবরণ ।
- পরকাল সংক্রান্ত বিষয়সমূহের বিবরণ ইত্যাদি ।
প্রসিদ্ধ আসমানি কিতাবসমূহ
আল্লাহ তায়ালা সর্বমোট ১০৪ খানা আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন। এর মধ্যে ৪ (চার) খানা বড় ও প্রসিদ্ধ এবং ১০০ খানা ছোট কিতাব। ছোট কিতাবগুলোকে সহিফা বলা হয়। বড় চারখানা কিতাব চারজন প্রসিদ্ধ রাসুলের উপর নাজিল হয়। এগুলো হলো-
১. তাওরাত – হযরত মুসা (আ.)-এর উপর নাজিল হয়েছে।
২. যাবুর হযরত দাউদ (আ.)-এর উপর নাজিল হয়েছে।
৩. ইঞ্জিল – হযরত ঈসা (আ.)-এর উপর নাজিল হয়েছে।
৪. কুরআন বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর উপর নাজিল হয়েছে।
আর ১০০ খানা সহিফা মোট চারজন নবির উপর নাজিল হয়। এঁরা হলেন-
- হযরত আদম (আ.)। তাঁর উপর ১০ খানা সহিফা নাজিল হয়েছে।
- হযরত শিস (আ.)। তাঁর উপর ৫০ খানা সহিফা নাজিল হয়েছে।
- হযরত ইবরাহিম (আ.)। তাঁর উপর ১০ খানা সহিফা নাজিল হয়েছে।
- হযরত ইদরিস (আ.)। তাঁর উপর ৩০ খানা সহিফা নাজিল হয়েছে।
আসমানি কিতাবে বিশ্বাসের গুরুত্ব
আসমানি কিতাবসমূহে বিশ্বাস স্থাপন করা ইমানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । আসমানি কিতাবসমূহে বিশ্বাস স্থাপন না করলে ইমানের মূল বিষয়ই নড়বড়ে হয়ে যায়। কেননা আসমানি কিতাবগুলোর মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহ তায়ালা, নবি-রাসুল, ফেরেশতা, পরকাল ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পেরেছে। এসব বিষয় সম্পর্কে পবিত্র আল-কুরআনের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি। যদি কেউ আসমানি কিতাবসমূহ ও তাতে বর্ণিত বিষয়সমূহে অবিশ্বাস করে তবে স্বভাবতই সে ইমানের অন্যান্য বিষয়গুলোও অস্বীকার করে। সুতরাং ইমান আনার জন্য আসমানি কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য । অন্যথায় পূর্ণ মুমিন হওয়া যায় না । আসমানি কিতাবসমূহ হলো সকল জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস। এর মাধ্যমেই আমরা সৃষ্টিজগৎ, মানবসৃষ্টি, পরকাল ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে জানতে পারি। মানব জীবনে চলার পথ সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনা আসমানি কিতাবসমূহেই পাওয়া যায়। আসমানি কিতাবসমূহে বিশ্বাসই এসব বিষয়কে আমাদের বাস্তবজীবনে অনুশীলনের অনুপ্রেরণা দেয় ।
সর্বশেষ আসমানি কিতাব ‘আল-কুরআন’
আল-কুরআন আল্লাহ তায়ালার বাণী । মানবজাতির হিদায়াতের লক্ষ্যে আল্লাহ তায়ালা হযরত জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর উপর এ কিতাব নাজিল করেন। আল-কুরআনই হলো সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব ।
নবি করিম (স.)-এর ৪০ বছর বয়সে হেরাগুহায় ধ্যানমগ্ন থাকাবস্থায় সর্বপ্রথম সূরা আলাকের প্রথম ৫টি আয়াত নাজিল হয়। এভাবে পবিত্র কুরআন নাজিল শুরু হয়। অতঃপর রাসুল (স.)-এর নবুয়তের ২৩ বছরে অল্প অল্প করে প্রয়োজন মাফিক সম্পূর্ণ কুরআন নাজিল হয় । আল-কুরআন ৩০টি খণ্ডে বিভক্ত । এগুলোর প্রত্যেকটিকে এক একটি পারা বলা হয় । এর সূরা সংখ্যা ১১৪টি এবং রুকু সংখ্যা ৫৫৮টি।
কুরআনের নামকরণ
কুরআন অর্থ পঠিত। আল-কুরআন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পঠিত গ্রন্থ। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে বাধ্যতামুলকভাবে কুরআন তিলাওয়াত করা হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ মহাগ্রন্থকে কুরআন বলা হয় । কুরআনের অন্য অর্থ একত্র করা বা জমা করা। আল-কুরআনে পূর্ববর্তী সকল আসমানি কিতাবের শিক্ষা ও মূলনীতি একত্র করা হয়েছে বিধায় একে কুরআন বলা হয় ।
আল-কুরআনের বেশকিছু নাম রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রসিদ্ধ নাম-
১. আল-কিতাব (الكتاب) – গ্রন্থ
২. আল-ফুরকান (الفرقان) – (সত্য-মিথ্যার) পার্থক্যকারী
৩. আল-হিকমা (الحكمة) – জ্ঞান, প্রজ্ঞা
৪. আল-বুরহান (البرهان) – সুস্পষ্ট প্রমাণ
৫. আল-হক (الحق) – সত্য
৬. আন-নুর (النور) – জ্যোতি
৭. আল-হুদা (الهدى) – পথনির্দেশ
৮. আয-যিকর (الذكر) – উপদেশ
৯. আশ-শিফা (الشفاء) – নিরাময়
১০. আল-মজিদ (المجيد) – সম্মানিত, মহিমান্বিত
১১. আল-মাওয়িযা (المعوذّة) – সদুপদেশ
১২. আর-রাহমাহ (الرحمة) – অনুগ্রহ, দয়া
কুরআনের বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্য
আল-কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে মর্যাদাবান গ্রন্থ। এটি দুনিয়ার সকল গ্রন্থ, এমনকি অন্যান্য আসমানি কিতাবের তুলনায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এর সমকক্ষ আর কোনো কিতাব নেই ।
আল-কুরআন পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ কিতাব। এ গ্রন্থ সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধার। সব বিষয়ের মূলনীতি এ গ্রন্থে বিদ্যমান। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَبَ مِنْ شَيْءٍ
অর্থ : “আমি এই কিতাবে কোনো কিছুই বাদ দেইনি।” (সূরা আল-আনআম, আয়াত ৩৮)
সুতরাং আল-কুরআন হলো পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। মানবজীবনের প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ের যথাযথ নির্দেশনা এ কিভাবে বিদ্যমান।আল-কুরআন সর্বশেষ আসমানি কিতাব। আল্লাহ তায়ালা মহানবি (স.)-এর মাধ্যমে ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ফলে পৃথিবীতে আর কোনো নবি-রাসুল আসবেন না । কোনো আসমানি কিতাবও নাজিল হবে না। কুরআনের শিক্ষাই কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। তাছাড়া পূর্ববর্তী সকল আসমানি কিতাবের সার-নির্যাসও কুরআনে রয়েছে। সুতরাং এটি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব । আল-কুরআন সন্দেহমুক্ত কিতাব। দুনিয়ার কোনো গ্রন্থই নির্ভুল বা অকাট্য নয়। কিন্তু কুরআন নির্ভুল এবং এটি সন্দেহেরও বাইরে । সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে এমন কোনো বিষয়ই এতে নেই । আল্লাহ তায়ালা বলেন-
ذلِكَ الْكِتُبِ لَا رَيْبَ فِيهِ
অর্থ : “এটি (কুরআন) সেই কিতাব, যাতে কোনো সন্দেহ নেই।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২)
সর্বজনীন কিতাব হিসেবেও আল-কুরআনের মর্যাদা অনন্য। এটি কোনো দেশ, কাল বা জাতির জন্য সীমাবদ্ধ নয় । বরং সকল যুগের সব মানুষের জন্য এটি উপদেশ ও পথনির্দেশক। সুতরাং এটি সর্বজনীন কিতাব। আল-কুরআন একমাত্র অবিকৃত গ্রন্থ । নাজিলের পর থেকে আজ পর্যন্ত এর একটি হরকত বা নুকতাও পরিবর্তিত হয়নি। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এর রক্ষক। তিনি বলেন-
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِكرَ وَإِنَّا لَهُ لَحفِظُونَ
অর্থ : “আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং অবশ্য আমিই এর সংরক্ষক।” (সুরা আল-হিজর, আয়াত ৯)
বস্তুত আল-কুরআন অবিকৃত ও অপরিবর্তিত গ্রন্থ। আজ পর্যন্ত এতে কোনোরূপ সংযোজন, সংশোধন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন বা বিয়োজন হয়নি, আর ভবিষ্যতেও হবে না ।
কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ও মর্যাদাপূর্ণ কিতাব। এতে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য, ইতিহাস, ভবিষ্যদ্বাণী, বিজ্ঞান, সৃষ্টি রহস্য ইত্যাদি বিষয় খুব সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এটি যেহেতু আল্লাহ্ তায়ালার বাণী সুতরাং এর মর্যাদাও তাঁরই ন্যায় অতুলনীয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন–
بَلْ هُوَ قُرْآنٌ مَّجِيدٌ لا فِي لَوْحٍ مَّحْفُوظ
অর্থ : “বস্তুত এটি সম্মানিত কুরআন। সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ।” (সূরা আল-বুরুজ, আয়াত ২১-২২) আল-কুরআন মহান আল্লাহর বাণী। এটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও মহিমায় ভাস্বর। এটি পরিবর্তন, বিকৃতি, সংযোজন-বিয়োজন থেকে মুক্ত ও পবিত্র । এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ আসমানি কিতাব ।
আমরা পবিত্র কুরআনের মাহাত্ম্য অনুধাবন করব । ভক্তি ও সম্মান সহকারে আমরা কুরআন পাঠ করব এবং এর শিক্ষা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান লাভ করে তা আমাদের বাস্তব জীবনে কার্যকর করব। কুরআনই হবে আমাদের জীবন চলার পাথেয়।