ভূমিকা
সময়ের অন্তহীন যাত্রাপথে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হচ্ছে জীবন। এই যাত্রায় নেই কোনো বিরতি, নেই কোনো ফিরে তাকানো। মহাকালের নিরবধি স্রোতে ক্ষণস্থায়ী মানুষের জীবন যেন একটি ক্ষুদ্র ভেলা, যা সময়ের বিশাল সমুদ্রে ভেসে চলে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। মানুষের জীবনে যে সামান্য সময় পাওয়া যায়, তা অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য ও অমূল্য। তাই মানুষ প্রায়শই হাহাকার করে ওঠে—”নেই যে সময়, নেই নেই!” জীবনের শেষে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে—”জীবন এত ছোট কেন?” এইজন্যই প্রতিটি মুহূর্তই মানুষের জীবনে অপরিসীম মূল্যবান।
মানবজীবনে সময়ের গুরুত্ব
অনন্ত কালের তুলনায় মানুষের জীবনে সময় খুবই সীমিত। এই ক্ষণিক সময়ও প্রতিনিয়ত অতীত হয়ে যায়। কবি হেমচন্দ্রের ভাষায়—
“দিন যায়, ক্ষণ যায়, সময় কাহারো নয়;
বেগে ধায়, নাহি রহে স্থির।”
জীবনের সাফল্য, সৌন্দর্য ও সার্থকতা নির্ভর করে সময়ের সঠিক ব্যবহারের উপর। অনেকেই সময়ের মূল্য বোঝে না, তাকে অবহেলা করে, আলস্যে ভোগে এবং অকর্মণ্য হয়ে পড়ে থাকে। ফলে জীবনের অমূল্য সময় অপচয় হয়। এই অপচয়ের মূল্য দিতে হয় ব্যর্থতা ও হতাশার মাধ্যমে। কারণ, একবার চলে যাওয়া সময় আর কখনো ফিরে আসে না। তাই কর্মময় ও সৃজনশীল জীবনের জন্য সময়ের গুরুত্ব অনুধাবন করাই একান্ত প্রয়োজন।
বাঙালির সময়চেতনা
দুঃখজনক হলেও সত্য, বাঙালির মধ্যে সময় সচেতনতা এখনও পর্যাপ্তভাবে গড়ে ওঠেনি। এর মূল কারণ নিহিত আছে আমাদের প্রাচীন সমাজব্যবস্থায়। দীর্ঘদিন ধরে বাঙালির জীবন ছিল গ্রামকেন্দ্রিক, যেখানে জীবনের গতি ছিল ধীর ও সরল। অল্প পরিশ্রমে কৃষিতে সোনালি ফসল ফলত, ফলে জীবন ছিল অবসরে ভরা। বারো মাসে তেরো পার্বণ ছিল সেই জীবনের চিত্র। বাইরের দুনিয়ার অগ্রগতির প্রতি বাঙালির আগ্রহ কম ছিল।
কিন্তু ইংরেজ আগমনের পর পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে পৃথিবীর অগ্রগতি ও সময়-সচেতনতার যে চিত্র ধরা পড়ল, তাতে বোঝা গেল বাঙালির অনেকটা পিছিয়ে থাকা। এরপর থেকে বাঙালি ধীরে ধীরে সময়ের গুরুত্ব বুঝতে শিখছে বটে, তবে পুরোনো অলস অভ্যাসের ছায়া এখনও কাটেনি। ফলে ‘বাঙালি সময়জ্ঞান’ নিয়ে যে ঠাট্টা-বিদ্রুপ সমাজে প্রচলিত, তা থেকে আজও পুরোপুরি মুক্ত হতে পারিনি।
সময় সচেতনতার গুরুত্ব
জীবনের সার্থকতার জন্য সময়নিষ্ঠা এক অপরিহার্য শর্ত। ইংরেজি প্রবাদ “Time and tide wait for none” মনে রাখলেই বোঝা যায়, প্রতিটি মুহূর্ত কত অমূল্য। স্বাস্থ্য হারালে তা পুনরুদ্ধার সম্ভব, হারানো সম্পদও ফিরে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যে সময় একবার চলে যায়, তা আর কখনোই ফিরে আসে না। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষণ পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানোই বুদ্ধিমানের কাজ।
ইংরেজদের আরেকটি প্রবাদ—“Time is money”—এই কথাটির তাৎপর্য অনেক গভীর। যদিও সব সময় সময়জ্ঞান সরাসরি অর্থ উপার্জনে সাহায্য করে না, তবুও সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করে মানুষ অর্থ, জ্ঞান, সৃজনশীলতা ও দক্ষতায় জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে। সময়ের সদ্ব্যবহার মানুষকে করে তোলে সফল, পূর্ণতা দেয় জীবনে।
ছাত্রজীবন ও সময়নিষ্ঠা
ছাত্রজীবন হলো ভবিষ্যতের ভিত গড়ে তোলার শ্রেষ্ঠ সময়। এই সময়েই গড়ে ওঠে সময়ানুবর্তিতার অভ্যাস, যা ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য এক মহামূল্যবান সম্পদ। ছাত্রজীবনের প্রতিটি কাজ—পাঠ্যচর্চা, খেলাধুলা, বিশ্রাম কিংবা বিনোদন—সবকিছুর জন্য প্রয়োজন সুশৃঙ্খল সময় পরিকল্পনা।
যে শিক্ষার্থী আলস্যে ডুবে থাকে, সময়ের সদ্ব্যবহার করে না, সে কেবল পড়াশোনাতেই পিছিয়ে পড়ে না—জীবনের প্রতিটি ধাপে তাকে হোঁচট খেতে হয়। তাই অন্যান্য শিক্ষার পাশাপাশি সময়জ্ঞান অর্জন ছাত্রজীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হওয়া উচিত। এই বয়সেই যদি সময়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য গড়ে ওঠে, তবে ভবিষ্যৎ জীবন হবে অধিক ফলপ্রসূ ও গঠনমূলক।
মনীষীদের জীবনে সময়নিষ্ঠার গুরুত্ব
ইতিহাসের যেসব মহান মানুষ স্মরণীয় হয়ে আছেন, তাঁদের জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল সময়ের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা। তাঁরা জানতেন, সীমিত জীবনে বড় কিছু অর্জন করতে হলে প্রতিটি মুহূর্তের সঠিক ব্যবহার করতে হয়। সময়কে সঙ্গী করেই তাঁরা হয়ে উঠেছেন কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে অমর।
বিশ্ববিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীরা অল্প সময়েই সৃষ্টি করেছেন অনন্যসাধারণ সাহিত্য ও শিল্পকর্ম। বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা সময়ের প্রতিটি ক্ষণ সাধনায় ব্যয় করে সমৃদ্ধ করেছেন জ্ঞানভাণ্ডার। ধর্মপ্রচারক, রাষ্ট্রনায়ক ও সমাজচিন্তকেরা সীমিত জীবনে রেখেছেন অসীম অবদান। তাঁদের প্রতিটি মুহূর্তের সদ্ব্যবহার আমাদের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
এইসব মহামানবদের জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি—সময়ের সঠিক ব্যবহার কীভাবে জীবনকে মহান করে তোলে। তাঁরাই দেখিয়েছেন, সময়ানুবর্তিতা ও সময়-সচেতনতা মানুষকে করে তোলে অমর।
উপসংহার
আধুনিক যুগে জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছে অত্যন্ত জটিল ও বহুমুখী। বিজ্ঞানের উন্নতি, জীবন সংগ্রামে প্রতিযোগিতা ও সামাজিক জীবনের নানান চাপ—সব কিছুই আমাদের প্রতিদিনের সিদ্ধান্ত ও কর্মে প্রভাব ফেলছে। পারিবারিক, শিক্ষাগত ও পারিপার্শ্বিক জীবনে প্রতিনিয়ত নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। বিনোদন ও বিশ্রামের জন্যও সময় দেওয়া প্রয়োজন। তাই আমাদের জীবনযাত্রা যদি সফল ও সার্থক হতে চায়, তবে সময়ের সঠিক ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সময়ের সঠিক ব্যবহারের গুরুত্ব কেবল ব্যক্তিগত জীবনের সীমায় আবদ্ধ নয়, এটি জাতীয় জীবনের জন্যও সমানভাবে জরুরি। আজকের বিশ্বে যেখানে প্রতিযোগিতা তীব্র এবং প্রযুক্তি ও গণনা এগিয়ে যাচ্ছে বিস্ময়কর গতিতে, সেখানে সুপরিকল্পিত সময়নিষ্ঠা ছাড়া কোনো দেশ বা জাতি উন্নতির পথে এগোতে পারবে না। শুধুমাত্র ব্যক্তি জীবন নয়, জাতীয় জীবনে সময়ের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলেই আমরা পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে অগ্রসর হতে পারব। তাই সফলতা অর্জনে, দেশ ও জাতির সমৃদ্ধির জন্য, সময়নিষ্ঠা ও সময়ের প্রতি সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।
একই প্রবন্ধ আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো
ভূমিকা
‘বার বার কারো পানে ফিরে চাহিবার
নাই যে সময়,
নাই নাই।’
—-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সময়ের তটভূমিতেই মানুষের ভাঙা-গড়ার ইতিহাস। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের, জন্ম থেকে মৃত্যুর এক অন্তহীন স্রোত। নদীর স্রোতের মতোই সময়ের ধর্ম হলো বহমানতা—কারো জন্যে অপেক্ষা নেই, কোনো কিছুতেই তার আকর্ষণ বা পিছুটান নেই। মুহূর্তের জন্যেও সে থামে না। শুধু চলে, চলে আর চলে। মহাকালের সেই প্রবাহে ক্ষণবন্দি মানুষের জীবন। একে একে হারিয়ে যেতে থাকে প্রতিটি মুহূর্ত, আর মানুষের জীবনে যে-খণ্ড সময় পাওয়া যায় তা এত দুর্লভ, এত মূল্যবান যে মানুষ বারবার হাহাকার করে—‘নাই যে সময়, নাই নাই’। নদী যেমন সমুদ্রে গিয়ে তার কলতান থামায়, মানুষও সময়ের সঙ্গে মিশে তার জীবনের পূর্ণতা খোঁজে। তাই পৃথিবীতে এক মুহূর্তও থেমে থাকার সুযোগ নেই—একটি সময়ও নষ্ট করার অবকাশ নেই।
সময়ের গুরুত্ব
সময় হলো অনন্ত এক দুর্লভ ঐশ্বর্য। মানুষের জীবনে শ্রেষ্ঠ সম্পদ হল জীবন, আর জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হল সময়। সময় সবার জন্য মূল্যবান, কিন্তু এর মূল্য কখনোই নির্ধারণ করা সম্ভব নয়, কারণ পার্থিব জীবনের কোনো কিছুর বিনিময়ে চলে যাওয়া সময়কে আর কখনোই ফিরে পাওয়া যায় না।
“একটা দিন চলে যাওয়া মানে জীবন থেকে একটা দিন ঝরে যাওয়া।”
—রবার্ট ব্রাউনিং
জীবন সীমিত ও সংক্ষিপ্ত। আর এই সংক্ষিপ্ততার কারণেই জীবনের প্রতি আকর্ষণ অগাধ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই জীবনে কত কিছু হারাতে হয়, কত কিছু অর্জন করতে হয়। জীবন এমনই—বেশি সময় নেই, তাই অনন্ত সময় থেকে কিছু ক্ষণ আহরণ করার জন্য মানুষের অন্তহীন আকুতি। সময়ের প্রতি সচেতনতা, ক্ষণস্থায়ী জীবনে ভালো কাজ করার তাগিদ—এগুলোই আমাদের জীবনের পাথেয়। জীবনের কার্যকলাপের মাধ্যমেই মানুষের পরিচিতি, যশ, খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, এবং প্রতিপত্তি গড়ে ওঠে। তবে, এই পৃথিবীতে “Life is short but art is long”—জীবন ক্ষণস্থায়ী হলেও, মানুষের কর্মের ছাপ দীর্ঘকাল থাকে। তাই সময়ের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে না পারলে জীবনের সার্থকতা থাকে না।
এ প্রসঙ্গে মহাত্মা গান্ধী বলেছেন,
“Time is life, life is time. Balance between life and time can help one reach the highest apex of success.”
যত দ্রুত এবং সঠিকভাবে জীবনকে সময়ের সাথে মিলিয়ে কাজ করা যায়, ততই জীবনের সার্থকতা বৃদ্ধি পায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সময়ের সদ্ব্যবহার করে অনেক সাধারণ ব্যক্তি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন, আবার যারা সময়ের মূল্য বুঝতে পারেননি, তারা প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও জীবন থেকে অপূরণীয় কিছু হারিয়ে ফেলেছেন। এই কারণে সময়ের গুরুত্ব অস্বীকার করা অসম্ভব। লালনগীতি প্রমাণিত করে—
“সময় গেলে সাধন হবে না।”
সময়ের সদ্ব্যবহার
‘মানবজাতির প্রতি বিধাতার শ্রেষ্ঠ দান হচ্ছে মহামূল্য সময়।’
— আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
সময়ই মানব জীবনে উন্নতির অরুণোদয় ঘটায়, আবার সময়ই কখনো অবনতির অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়। একমাত্র সময়ের সদ্ব্যবহারে মানুষের ক্ষণস্থায়ী জীবন চিরকালীন সার্থকতায় রূপান্তরিত হতে পারে। মানবজীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীতে অবিনশ্বর কীর্তি স্থাপন করাই জীবনের চরম সার্থকতা। সময়ের সীমিত খণ্ডে, যে মুহূর্তগুলোর মধ্যে মানুষ তার জীবন গঠন করে, তাদের যথার্থ প্রয়োগই জীবনকে করে তোলে সার্থক ও সুন্দর। পৃথিবীতে এমন কোনো মনীষী নেই, যিনি বড় হয়েছেন অথচ সময়ের সদ্ব্যবহার সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন না।
সময়ের অবহেলার পরিণাম
জীবনের সীমাবদ্ধ সময়ের মধ্যে, যে ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তগুলো আমাদের হাতে আসে, তার সদ্ব্যবহারই জীবনকে সুখময় এবং সার্থক করে তোলে। যদি আমরা সেই সময়কে অবহেলা করি, যদি আলস্য বা অবহেলায় সময় নষ্ট করি, তাহলে একদিন আমরা সেই অপব্যয়ের দুঃখে ভুগতে হব। তখন আর সময় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। কবি যেমন বলেছেন—
“রাত্রে যদি সূর্য শোকে ঝরে অশ্রুধারা,
সূর্য কভু নাহি ফেরে, ব্যর্থ হয় তারা।”
সময় চোখে দেখা যায় না, তার চলার ধ্বনি শোনা যায় না, কিন্তু তার তীব্রতা অনুভব করা যায় যখন আমরা সময়ের মূল্য ভুলে যাই। অলসতা ও কর্মবিমুখতা মানুষকে সময়ের প্রতি অজ্ঞ বা অচেতন করে তোলে। সময়কে অবহেলা করলে মহাকাল তার প্রতিশোধ নেয় এবং মানুষ দুঃখের সাথে শোধ করে তার জন্ম-ঋণ। কিন্তু যাঁরা সময়ের সদ্ব্যবহার করেন, তাঁরা নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্য দিয়ে কল্যাণকর্মে সময়কে উৎসর্গ করে, তাঁদের উপর কালের দেবতার অপার করুণাধারা বর্ষিত হয়। সময় সত্যিই দুর্লভ, আর এই দুর্লভ মানবজন্মও। আমাদের জীবনের যথাসময়ে সঠিক কাজ করাই আমাদের সোনালী ফসল পেতে সাহায্য করবে।
বাঙালির সময়জ্ঞান
বাঙালির সময়জ্ঞান সাধারণত কম থাকে, এবং এর কারণ হিসেবে বাঙালির প্রাচীন জীবনযাত্রা ও অভ্যাসকে দায়ী করা যায়। দীর্ঘকাল ধরে বাঙালির সমাজ জীবন ছিল গ্রামকেন্দ্রিক, যেখানে জীবনে কম জটিলতা ছিল। অল্প পরিশ্রমে সোনার ফসল পেতে প্রচুর অবসর ছিল, এবং এই সময়গুলোতে বাঙালি তার আনন্দ-উল্লাসে মগ্ন থাকত। বাইরের বিশ্বের পরিবর্তন কিংবা অগ্রগতি সম্পর্কে খুব বেশি ভাবনা ছিল না।
তবে, ইংরেজদের আগমনের পর পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে বাঙালির জীবনযাত্রায় একটি বড় পরিবর্তন আসে। দেখা যায়, পৃথিবী যেমন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি বাঙালির সময়-সচেতনতা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বর্তমানে বাঙালি সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে চেষ্টা করছে, তবে পুরনো অলস অভ্যাসের কারণে এই পরিবর্তন পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। বাঙালির সময়জ্ঞান নিয়ে যে ঠাট্টা-বিদ্রুপ চলে, তা এখনো সমূলে মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি।
সময়ের সদ্ব্যবহারের উপায়
সময়ের যথাযথ ব্যবহারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হচ্ছে সময়কে ভাগ করে নেওয়া এবং কাজের পরিমাণ অনুযায়ী সেই সময় নির্ধারণ করা। যে কাজটি সময়মতো করা উচিত, তা যদি পরে করা হয়, তবে তা আর কখনো সঠিকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। এই কারণে, ‘সময়ের একফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’—এটি মনে রাখতে হবে। জীবনের সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে সমস্ত দায়দায়িত্ব সুসম্পন্ন করতে, আমাদের উচিত সময়কে পরিকল্পিতভাবে ভাগ করে নেওয়া। যেমন স্কুল বা কলেজে রুটিন মেনে সময় ব্যবস্থাপনা করা হয়, তেমনি আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও প্রতিটি কাজের জন্য উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করা উচিত। কর্ম, বিশ্রাম, বিনোদন—সবই সময়মতো করতে হবে। এইভাবে সময়কে কাজে লাগানোর জন্য প্রতিটি মুহূর্তকে মূল্যবান ভাবতে হবে এবং যেমনটি কবি বলেছেন,
“Work while you work, play while you play,
And that is the way to be happy and gay.”
ছাত্রজীবনে সময়ের মূল্য
পবিত্র বাইবেলে বলা হয়েছে,
“এই পৃথিবীতে প্রত্যেক কাজে একটা উদ্দেশ্য, একটা কাল ও একটা সময় আছে। জন্মের একটা সময় আছে, মরনেরও একটা সময় আছে। গাছ রোপণ করার একটা সময় আছে আর রোপিত গাছ উপড়ে ফেলারও একটা সময় আছে।”
ছাত্রজীবন হচ্ছে সময়ের সঠিক ব্যবহার শিখার উপযুক্ত সময়। ছাত্রজীবনে সময়ের সঠিক মূল্যায়ন একজন সফল কর্মজীবী হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ। যেমন কৃষক বীজ বপন করেন, তেমনি ছাত্রজীবনেও সঠিক সময়ে পড়াশোনা এবং প্রস্তুতির মাধ্যমে জীবনের সফলতা নিশ্চিত করা যায়। ছাত্রজীবনে সময়ের প্রতি সঠিক মনোভাব গড়ে তোলা, ভবিষ্যতের সার্থকতা এবং সফলতার জন্য অত্যন্ত জরুরি। শ্রমবিমুখ, অলস ছাত্র শুধুমাত্র পড়াশোনায় পিছিয়ে থাকে না, তার বৃহত্তর জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার একদম সঠিক বলেছেন,
“সময়ের প্রতি যাদের শ্রদ্ধা নেই, তারা পৃথিবীতে নিঃস্ব, বঞ্চিত ও পরমুখাপেক্ষী।”
তাহলে, ছাত্রজীবন থেকেই সময়ের গুরুত্ব বুঝতে হবে এবং সেই অনুযায়ী সময়ের সদ্ব্যবহার করতে হবে।
মনীষীদের জীবনে সময়ের তাৎপর্য
বিশ্বের যেসব মনীষী ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন, তাঁদের সবার জীবনেই সময়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও সচেতনতা ছিল। তাঁদের এই সময়ের ব্যবহারের কারণে তাঁদের জীবন হয়ে উঠেছে পরম সফলতা ও সাফল্যের প্রতীক। সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করে তাঁরা ইতিহাসের পথিকৃত হয়েছেন এবং অমর সৃষ্টি রেখে গেছেন। কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক—সবাই তাঁদের জীবনকাল সীমিত হলেও, সময়ের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে মহান সৃষ্টির পথে এগিয়েছেন।
বিশ্ববিখ্যাত মনীষীদের মধ্যে যেমন হযরত মুহম্মদ (স), কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সক্রেটিস, আইনস্টাইন, নিউটন, শেক্সপিয়ার, মিলটন, উমর খৈয়াম—এরা সবাই তাঁদের মূল্যবান সময়কে কাজে লাগিয়ে ইতিহাসের এক উজ্জ্বল দিক সৃষ্টি করেছেন। সময়ের প্রতি শ্রদ্ধা এবং শৃঙ্খলা ছিল তাঁদের জীবনের মূল মন্ত্র। সময়ের যথাযথ ব্যবহারের কারণেই ইংল্যান্ড, আমেরিকা, জাপান, রাশিয়া, জার্মানি ইত্যাদি দেশ শিক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্প ও সংস্কৃতিতে অগ্রগতি অর্জন করেছে।
সময়ের অপব্যবহার ও আমাদের কর্তব্য
যারা সময়ের সঠিক ব্যবহার করেন না এবং তার মূল্যায়ন করেন না, তাদের জীবন হয়ে ওঠে এক ধরনের শূন্যতার প্রতীক। সময়ের অপব্যবহার কেবল ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষতি করে না, তা বৃহত্তর জীবনের ক্ষেত্রে পরাজয়ের কারণও হতে পারে। যেমন, ‘ওয়াটার-লু’র যুদ্ধে নেপোলিয়নের সেনাপতি নির্দিষ্ট সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছাতে না পারায়, নেপোলিয়ন পরাজিত হয়েছিলেন। এ ধরনের বাস্তব উদাহরণ দেখায়, সময়ের প্রতি অবহেলা ব্যক্তির ও জাতির জন্য বিপদজনক হতে পারে। এমন অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি আছেন, যারা সময়ের অপব্যবহারে তাঁদের সম্ভাবনা ও শক্তি হারিয়েছেন।
এ বিষয়ে একজন কবি যথার্থই বলেছেন,
“ঘড়ির কাঁটাটি টিক্ টিক্ করে যেন ঠিক এ কথাটিই বলে চলেছে,
‘সাবধান! আমাকে ভুলো না, তোমার সুপ্ত চৈতন্য জাগ্রত কর, কল্যাণ তোমারই হবে।’”
এটি এক ধরনের সতর্কবার্তা, যা আমাদের সময়ের প্রতি সচেতন হতে বলছে। সময়ের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সতর্কতা জীবনের সার্থকতা নিশ্চিত করে।
উপসংহার
সময়জ্ঞান একজন মানুষের সার্বিক উন্নতির চাবিকাঠি। ব্যক্তি জীবনে সময়ের গুরুত্ব বোঝা, শুধু ব্যক্তিগত সফলতার জন্য নয়, বরং জাতীয় জীবনের অগ্রগতির জন্যও অপরিসীম। সময়ের সদ্ব্যবহারেই এক একটি জাতি এবং সমাজ অগ্রসর হতে পারে। যেমন পাশ্চাত্য দেশে বলা হয়,
“Time is money.”
এটি প্রমাণ করে যে সময় কেবল অর্থের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং একটি জাতির অগ্রগতি, প্রগতি এবং শৌর্যের সাথে গভীরভাবে জড়িত।
যে জাতি সময়ের মূল্য বুঝতে পারে, সেই জাতি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করে। সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমেই দেশ ও জাতি তাদের উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পারে। এটি কেবল একটি ব্যক্তি বা সমাজের দায়িত্ব নয়, বরং একটি জাতির সাফল্যের মূল সূত্র।