ভূমিকা
বিশ্বজগতের সর্বত্রই বিরাজমান এক অদৃশ্য নিয়ম-নীতি ও শৃঙ্খলার রাজত্ব। সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্র—সবই নির্দিষ্ট গতিপথে চলছে অনড় নিয়মে। পৃথিবী ঘুরছে নিজ কক্ষপথে, সূর্য প্রতিদিন পূর্বে উদয় হয়ে পশ্চিমে অস্ত যায়, ঋতু পরিবর্তন হয় নির্দিষ্ট ধারায়। দিন আসে রাতের পরে—সবকিছুই চলে এক সুশৃঙ্খল নিয়মে। এই মহাবিশ্বের শুরুর মুহূর্ত থেকেই নিয়মের সূচনা, আর এই নিয়মই টিকে থাকবে শেষ পর্যন্ত। তাই তো বিখ্যাত সেনানায়ক নেপোলিয়ন যথার্থই বলেছেন—
“Discipline is the keystone to success which is compulsory to follow to balance the system.”
প্রাণিজগতে নিয়ম
প্রাণিজগতে নিয়ম-শৃঙ্খলা অনিবার্য। পশু-পাখি সকলেই প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলে। পাখিরা ভোরে জেগে গান গায়, দিনে খাবারের সন্ধানে উড়ে বেড়ায়, রাতে বিশ্রামে যায়—সবই এক নিয়মমাফিক চক্রে আবদ্ধ। মৌমাছি ও পিঁপড়া দলবদ্ধভাবে কাজ করে, তাদের জীবনে শৃঙ্খলা ও নেতৃত্ব মেনে চলার এক অনন্য দৃষ্টান্ত গড়ে তোলে। মৌমাছিরা নিখুঁতভাবে মৌচাক নির্মাণ করে, যার পেছনে থাকে কঠোর নিয়ম ও নিরবিচার পরিশ্রম। প্রকৃতপক্ষে, নিয়ম না মানলে প্রাণিজগতে নেমে আসে বিশৃঙ্খলার ছায়া।
সমাজ জীবনে নিয়ম
সমাজ জীবনের মূল ভিত্তি হলো শৃঙ্খলা ও নিয়মের প্রতি আনুগত্য। বিবাহ, ধর্মীয় উৎসব, খাওয়া-পরা—সব কিছুতেই রয়েছে নির্দিষ্ট নিয়মাবলি। এসব নিয়ম না মানলে সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সামাজিক নিয়ম-শৃঙ্খলার মাধ্যমেই মানুষ পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সহাবস্থানের পরিবেশ গড়ে তোলে। আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব, সহযোগিতা—সবই গড়ে ওঠে নিয়মমাফিক আচরণের মাধ্যমে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন—
“যে সমাজে শৃঙ্খলা আছে, ঐক্যের বিধান আছে,
সকলের স্বতন্ত্র ও সধিকার আছে,
সেই সমাজেই পরকে আপন করিয়া লওয়া সহজ।”
মানবজীবনে নিয়ম
মানবজাতি অন্যান্য জীবজগৎ থেকে আলাদা কারণ সে বুদ্ধিসম্পন্ন ও শৃঙ্খলাবোধসম্পন্ন। মানবজীবনকে সার্থক, সুশৃঙ্খল ও উন্নতির পথে পরিচালিত করতে প্রয়োজন কঠোর নিয়মমাফিক জীবনযাপন। আহার-বিহার, পরিশ্রম-বিশ্রাম, আচরণ-চিন্তা—সবক্ষেত্রেই নিয়মের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। যে ব্যক্তি নিয়মিতভাবে নিজের কর্তব্য পালন করে, সে জীবনে সফলতা অর্জন করে নিশ্চিতভাবে।
এ প্রসঙ্গে মহাত্মা গান্ধী বলেছেন—
“Discipline maintains system,
System maintains development,
Development vibrates human-life.
So, discipline must be followed.”
ছাত্রজীবনে নিয়মানুবর্তিতা
ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় গুণ। এই সময়টাই হলো জীবনের বীজ বপনের সময়—যেখানে অভ্যাস, আচরণ ও মূল্যবোধের ভিত্তি গড়ে ওঠে। একজন ছাত্রকে নিয়মিত পড়াশোনা, নির্ধারিত সময়মতো বিদ্যালয়ে যাওয়া, পাঠ প্রস্তুত রাখা, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা ইত্যাদি কাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হয়। এই অভ্যাস তার ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত্তি নির্মাণে সহায়ক হয়।
একথা ঠিকই বলা হয়েছে—
“Read while you read,
Play while you play,
That is the way,
To be happy and gay.”
অর্থাৎ সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে একজন দায়িত্ববান ও সফল মানুষ।
সৈনিক জীবনে শৃঙ্খলা
সৈনিক জীবন নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রকৃত পাঠশালা। সেখানে প্রতিটি কাজ—from ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, প্যারেড, অস্ত্রচর্চা, আহার-বিশ্রাম—সবই চলে নির্দিষ্ট নিয়মে। সেনানায়কের আদেশ মেনে চলাই সৈনিকের প্রধান দায়িত্ব। কারণ, একজন সৈনিকের সামান্য শৃঙ্খলাভঙ্গ পুরো ইউনিটের বিপর্যয় ঘটাতে পারে। তাই সেনাবাহিনীতে নিয়মানুবর্তিতা ভঙ্গ করলেই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকে। এখানে শৃঙ্খলা মানে জীবনরক্ষা।
নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজনীয়তা
জীবনের প্রতিটি স্তরে—পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, এমনকি পেশাগত ক্ষেত্রেও নিয়মানুবর্তিতা এক অপরিহার্য গুণ। খেলার মাঠ, কল-কারখানা, দোকান, হাসপাতাল, রেলওয়ে, বিমান—সবখানেই নিয়ম না মানলে নেমে আসে বিশৃঙ্খলা ও ক্ষয়িষ্ণুতা। একটি সুপরিচালিত প্রতিষ্ঠানও নিয়ম-শৃঙ্খলার অভাবে ধ্বংস হতে পারে। খেলার মাঠে নিয়ম না মানলে দল হারে, যুদ্ধক্ষেত্রে শৃঙ্খলার অভাবে পরাজয় অনিবার্য। তাই সার্থক ও সফল জীবন গড়তে হলে শৃঙ্খলা ও নিয়মের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
নিয়মানুবর্তিতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা
অনেকে মনে করেন, কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ব্যক্তি স্বাধীনতার পথে বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এ ধারণা ভ্রান্ত। বরং শৃঙ্খলা মেনে চলার মাধ্যমেই প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করা যায়। শৃঙ্খলা ব্যক্তি বিকাশের পথে বাধা নয়, বরং তা সেই পথকে সুগম করে। নিয়ম না মানলে জীবনে স্বেচ্ছাচারিতা প্রবেশ করে, যা শেষমেশ আনে বিশৃঙ্খলা ও দুঃখ।
এ কথা মনে রাখা জরুরি—
স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতা এক নয়।
স্বাধীনতা মানে দায়িত্বশীলতা, আর শৃঙ্খলা সেই দায়িত্ব পালনের পথপ্রদর্শক।
নিয়মানুবর্তিতা ভঙ্গের পরিণতি: বিপর্যয়ের অশনিসংকেত
নিয়মানুবর্তিতার ব্যত্যয় সর্বদাই অনাকাঙ্ক্ষিত এবং বিপর্যয় ডেকে আনে। তা ব্যক্তিজীবন হোক কিংবা সামাজিক বা জাতীয় পর্যায়—যেখানেই শৃঙ্খলার অভাব, সেখানেই গড়ে ওঠে বিশৃঙ্খলার দেয়াল। প্রকৃতি যেমন নিয়মভঙ্গ সহ্য করে না, তেমনি মানবজীবনেও এর ফলাফল সর্বদা ভয়াবহ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর নির্দেশ অমান্য করে ওহুদের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী যখন শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলে, তখনই তারা পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ গ্রহণ করে।
নিয়ম না মানার কারণে প্রতিভা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে—এর বাস্তব উদাহরণ মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, যিনি তাঁর প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও শৃঙ্খলার অভাবে জীবনের শেষ পরিণতিতে দুঃখ ও বঞ্চনার শিকার হন। সুতরাং, নিয়মানুবর্তিতা ভঙ্গ মানেই জীবনে গ্লানি, ব্যর্থতা ও বিপদের আশঙ্কা বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়া।
উপসংহার
নিয়মানুবর্তিতা ছাড়া জীবনে সফলতা কল্পনা করাও যায় না। ব্যক্তি থেকে শুরু করে সমাজ এবং রাষ্ট্র—সব পর্যায়েই শৃঙ্খলার গুরুত্ব অপরিসীম। শৃঙ্খলা না থাকলে গড়ে ওঠে বিশৃঙ্খলা, নেমে আসে অরাজকতা, আর মানুষ পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে ক্ষতির মুখে। পাশ্চাত্যের দেশসমূহ আজ উন্নত ও শক্তিশালী—এর মূলেও রয়েছে তাদের কঠোর শৃঙ্খলা ও নিয়মমাফিক জীবনযাপন। তাই আমাদেরও জাতীয় অগ্রগতির পথে অগ্রসর হতে হলে প্রথম শর্তই হলো নিয়মানুবর্তিতা।
এক কথায় বলা চলে—
“নিয়মানুবর্তিতাই উন্নতির চাবিকাঠি।”