মানব সমাজে কিছু মানুষের আচরণ এমনই বিচিত্র যে, তারা কারও মহামূল্য উপকারের ঋণ ভুলে গিয়ে নিজের একবিন্দু তুচ্ছ দানের অহঙ্কারে গগন বিদারী ঢোল বাজায়। যেন তারা দান করে ঋণ শোধ করে দেয়, বরং দাবি করে কৃতজ্ঞতা। এমন আচরণ বড়োই করুণ এবং আত্ম-অবমাননাকর।
শৈবালের জন্ম, বাঁচা, বেড়ে ওঠা সবই দিঘির জলের দান। সেই জলই তার প্রাণের আধার, অস্তিত্বের অবলম্বন। অথচ সেই শৈবাল, যখন নিজের মাথায় বসা এক ফোঁটা শিশিরকে দিঘির বুকে গড়িয়ে দিতে দেখে, তখন সে বলে ওঠে—“দেখো, আমিও কিছু দিলাম!” সে ভুলে যায় তার সমগ্র সত্তাই তো দিঘিরই দান। সেই শিশিরবিন্দুটিও প্রকৃতির—না তার নিজের, না তার উপার্জিত। তবুও সে দাম্ভিক ঘোষণায় নিজের দান প্রচার করে যেন সে দিঘিকে পূর্ণ করল।
এই শৈবাল-প্রতিম মানুষরা আমাদের সমাজেও বিরল নয়। হাজারো উপকার পেয়ে তারা থাকে নির্বিকার, কৃতজ্ঞতার এক বিন্দুও দেখায় না। আর একবার যদি কাউকে নিজের পকেট থেকে একটি তুচ্ছ সাহায্য করে, তবে সে উপকারকে করে তোলে মহাকাব্যের মতো—প্রচার করে, আত্মগর্বে ফেটে পড়ে। অথচ প্রকৃত মহৎ মানুষ, যাঁরা নীরবে, নিঃস্বার্থে, আত্মবিসর্জনের মাধ্যমে যুগে যুগে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যান—তাঁরা কখনো নিজের অবদানের কথা বলে বেড়ান না। তাঁদের অন্তরের ঋণবোধই তাঁদের পরোপকারে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁরা জানেন—দান করতে গিয়ে দান প্রকাশ করলে দানের মহিমাই হারায়।
শৈবালের মতো যারা এক ফোঁটা শিশির দান করেও শত দিঘির দানের হিসাব দেয় না, তারা মানবিক সৌন্দর্যের নয়, আত্মকেন্দ্রিক অপমানের প্রতীক। আত্মপ্রচারে নয়, আত্মত্যাগে মানুষ বড়ো হয়। জ্ঞানের, ভালোবাসার কিংবা ত্যাগের মহিমা তখনই চিরস্থায়ী হয়, যখন তা নিঃশব্দে বয়ে চলে—দিঘির মতো, যাকে দিয়ে দিতে হয়, দাবি না করে।
সত্যই,
“দান যদি করে চঞ্চল মুখে,
সে দান হারায় তার রূপ-গন্ধ সুখে।”
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ : “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: অর্থ সম্পদের বিনাশ আছে, কিন্তু জ্ঞান সম্পদ কখনও বিনষ্ট হয় না
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: মিথ্যা শুনিনি ভাই / এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: জাল কহে, “পঙ্ক আমি উঠাব না আর” / জেলে কহে, “মাছ তবে পাওয়া হবে ভার”
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: সবলের পরিচয় আত্মপ্রসারে, আর দুর্বলের স্বস্তি আত্মগোপনে
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: যাহা চাই ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, আছে যার ভুরি ভুরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল
✅ আরও পড়ুন : ভাবসম্প্রসারণ: শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে