বাংলায় স্বাধীন সুলতানি শাসনের ইতিহাস ও ইলিয়াস শাহি বংশ

বাংলায় স্বাধীন সুলতানি শাসনের ইতিহাস ও ইলিয়াস শাহি বংশ

বাংলায় স্বাধীন সুলতানি শাসনের ইতিহাস

দিল্লির সুলতানগণ ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দুইশ’ বছর বাংলাকে তাঁদের অধিকারে রাখতে পারেন নি। প্রথমদিকে দিল্লির সুলতানের সেনাবাহিনী আক্রমণ চালিয়েছে। চেষ্টা করেছে বাংলাকে নিজের অধিকারে আনার জন্য । অবশেষে সফল হতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছে। তাই, এ সময়ে বাংলার সুলতানগণ স্বাধীনভাবে এবং নিশ্চিন্তে এদেশ শাসন করতে পেরেছেন। ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের মাধ্যমে স্বাধীনতার সূচনা হলেও ইলিয়াস শাহি বংশের সুলতানদের হাতে বাংলা প্রথম স্থিতিশীলতা লাভ করে ।

স্বাধীন সুলতানি আমল (১৩৩৮ – ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ)

১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সােনারগাঁয়ের শাসনকর্তা বাহরাম খানের মৃত্যু হয়। বাহরাম খানের বর্মরক্ষক ছিলেন ফখরা নামের একজন রাজকর্মচারী। প্রভুর মৃত্যুর পর তিনি স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ’ নাম নিয়ে সােনারগাঁয়ের সিংহাসনে বসেন। এভাবেই সূচনা হয় বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের। দিল্লির মুহম্মদ-বিন-তুঘলকের এ সময় বাংলার দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সুযােগ ছিল না।

তাই, সােনারগাঁয়ে স্বাধীনতার সূচনা হলেও ধীরে ধীরে স্বাধীন অঞ্চলের সীমা বিস্তৃত হতে থাকে। পরবর্তী দুইশ’ বছর এ স্বাধীনতা কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। দিল্লির শাসনকর্তাগণ সােনারগাঁয়ের ফখরুদ্দিনের স্বাধীনতা ঘােষণাকে সুনজরে দেখেননি। তাই, দিল্লির প্রতিনিধি লখনৌতির শাসনকর্তা কদর খান ও সাতগাঁয়ের শাসনকর্তা ইজ্জউদ্দিন মিলিতভাবে সােনারগাঁ আক্রমণ করেন। কিন্তু তাঁরা সফল হতে পারেনি। কদর খান ফখরুদ্দিনের সৈন্যদের হাতে পরাজিত ও নিহত হন।

একজন স্বাধীন সুলতান হিসেবে ফখরুদ্দিন নিজ নামে মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন। তাঁর মুদ্রায় খােদিত তারিখ দেখে ধারণা করা যায়, তিনি ১৩৩৮ থেকে ১৩৪৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সােনারগাঁয়ে রাজত্ব করেন। ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ তাঁর রাজসীমা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কিছুটা বৃদ্ধি করেছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম জয় করেন।

তিনি চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি রাজপথ তৈরি করিয়েছিলেন বলে জানা যায় । ১৩৪৯ খ্রিষ্টাব্দে সােনারগাঁ টাকশাল থেকে ইখতিয়ার উদ্দিন গাজি শাহ নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচলন করা হয়। গাজি শাহের নামাঙ্কিত মুদ্রায় ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তারিখ পাওয়া যায়। সুতরাং বােঝা যায়, ফখরুদ্দিনপুত্র গাজি শাহ পিতার মৃত্যুর পর সােনারগাঁয়ের স্বাধীন সুলতান হিসেবে সিংহাসনে বসেন এবং ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিন বছর রাজত্ব করেন।

ইলিয়াস শাহি বংশ

সােনারগাঁয়ে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ যখন স্বাধীন সুলতান তখন লখনৌতির সিংহাসন দখল করেছিলেন সেখানকার সেনাপতি আলি মুবারক । সিংহাসনে বসে তিনি আলাউদ্দিন আলি শাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন। লখনৌতিতে তিনিও স্বাধীন রাজ্য গড়ে তােলেন। পরে রাজধানী স্থানান্তর করেন পাণ্ডুয়ায় (ফিরােজাবাদ)। আলি শাহ ক্ষমতায় ছিলেন ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। তার দুধভাই ছিলেন হাজি ইলিয়াস। তিনি আলি শাহকে পরাজিত ও নিহত করে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ’ নাম নিয়ে বাংলায় একটি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন।

এই রাজবংশের নাম ইলিয়াস শাহি বংশ। এরপর ইলিয়াস শাহের বংশধরগণ অনেক দিন বাংলা শাসন করেন। মাঝখানে কিছুদিনের জন্য হিন্দু রাজত্বের উত্থান ঘটেছিল। ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে ফিরােজাবাদের সিংহাসন অধিকারের মাধ্যমে ইলিয়াস শাহ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলার অধিপতি হন। সােনারগাঁ ও সাতগাঁও তখনও তাঁর শাসনের বাইরে ছিল।

ইলিয়াস শাহের স্বপ্ন ছিল সমগ্র বাংলার অধিপতি হওয়া। তিনি প্রথম দৃষ্টি দেন পশ্চিম বাংলার দিকে। ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে সাতগাঁও তাঁর অধিকারে আসে। ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে নেপাল আক্রমণ করে বহু ধনরত্ন হস্তগত করেন। এ সময় তিনি ত্রিহুত বা উত্তর বিহারের কিছু অংশ জয় করে বহু ধনরত্ন হস্তগত করেন। উড়িষ্যাও তার অধিকারে আসে। তবে ইলিয়াস শাহের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য ছিল পূর্ব বাংলা অধিকার। ইখতিয়ার উদ্দিন গাজি শাহ ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে সােনারগাঁয়ে ইলিয়াস শাহের হাতে পরাজিত হন।

সােনারগাঁ দখলের মাধ্যমে সমগ্র বাংলার অধিকার সম্পন্ন হয়। তাই বলা হয়, ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ বাংলার স্বাধীনতার সূচনা করলেও প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেন ইলিয়াস শাহ ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে। বাংলার বাইরেও বিহারের কিছু অংশ- চম্পারণ, গােরক্ষপুর এবং কাশী ইলিয়াস শাহ জয় করেছিলেন। কামরূপের কিছু অংশও তিনি জয় করেন। মােটকথা, তাঁর রাজ্যসীমা আসাম থেকে বারাণসী পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে ।

ইলিয়াস শাহ দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজ নামে খুৎবা পাঠ ও মুদ্রা জারি করায় সুলতান ফিরুজ শাহ তুঘলক অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। প্রথম দিকে দিল্লির সুলতান বাংলার এ স্বাধীনতা মেনে নেননি। সুলতান ফিরুজ শাহ তুঘলক ১৩৫৩ থেকে ১৩৫৪ ৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইলিয়াস শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তাঁর চেষ্টা ছিল বাংলাকে দিল্লির অধিকারে নিয়ে আসা।

কিন্তু তিনি সফল হননি। ইলিয়াস শাহ দুর্ভেদ্য একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদিকে বর্ষা এলে জয়ের কোনাে সম্ভাবনা না থাকায়, ফিরােজ শাহ সন্ধির মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতাকে মেনে নিয়ে ইলিয়াস শাহের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে দিল্লি ফিরে যান। শাসক হিসেবে ইলিয়াস শাহ ছিলেন বিচক্ষণ ও জনপ্রিয় । তার শাসনামলে রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজিত ছিল। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

হাজিপুর নামক একটি শহর তিনি নির্মাণ করেছিলেন। ফিরােজাবাদের বিরাট হাম্মামখানা তিনিই নির্মাণ করেন। এ আমলে স্থাপত্য শিল্প ও সংস্কৃতি যথেষ্ট পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেছিল। তিনি একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। তিনি ফকির-দরবেশদের খুব শ্রদ্ধা করতেন। ইলিয়াস শাহ লখনৌতির শাসক হিসেবে বঙ্গ অধিকার করলেও দুই ভূখণ্ডকে একত্রিত করে বৃহত্তর বাংলার সৃষ্টি করেছিলেন। এ সময় থেকেই বাংলার সকল অঞ্চলের অধিবাসী বাঙালি’ বলে পরিচিত হয়। ইলিয়াস শাহ শাহ-ই বাঙ্গালা’ ও ‘শাহ-ই-বাঙালিয়ান’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।

শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সিকান্দার শাহ (১৩৫৮-১৩৯৩ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলার সিংহাসনে বসেন। পিতার মতাে তিনিও দক্ষ এবং শক্তিশালী শাসক ছিলেন। দিল্লির সুলতান ফিরােজ শাহ তুঘলক ১৩৫৮ থেকে ১৩৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। কিন্তু এবারও ফিরােজ শাহ তুঘলককে ব্যর্থ হতে হয় ।

পিতার মতাে সিকান্দার শাহও একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধির মাধ্যমে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। সন্ধির শর্ত অনুযায়ী জাফর খানকে সােনারগাঁয়ের শাসন ক্ষমতা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু জাফর খান এ পদ গ্রহণে রাজি হলেন না। ফিরােজ শাহ তুঘলকের সঙ্গে তিনিও দিল্লিতে ফিরে গেলেন।

সােনারগাঁ এবং লখনৌতিতে আবার আগের মতােই সিকান্দার শাহের কর্তৃত্ব অক্ষুন্ন রইল । ইলিয়াস শাহ যে স্বাধীন সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সিকান্দার শাহ সেভাবেই একে আরও শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করতে সক্ষম হন। সুলতান সিকান্দার শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ’ (১৩৯৩-১৪১১ খ্রিষ্টাব্দ) উপাধি গ্রহণ করে বাংলার সিংহাসনে বসেন।

ইলিয়াস শাহ ও সিকান্দার শাহ যুদ্ধবিগ্রহ ও স্বাধীনতা রক্ষায় নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের কৃতিত্ব ছিল অন্যত্র । তিনি তার প্রজারঞ্জক ব্যক্তিত্বের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি তার রাজত্বকালে আসামে বিফল অভিযান প্রেরণ করেন। জৌনপুরের রাজা খান জাহানের সঙ্গে তিনি বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। চীনা সম্রাট ইয়াংলাে তাঁর দরবারে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন। তিনিও শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে চীনা সমাটের নিকট মূল্যবান উপঢৌকন প্রেরণ করেন।

মােটকথা,আযম শাহ কোনাে যুদ্ধে না জড়ালেও পিতা এবং পিতামহের গড়া বিশাল রাজত্বকে অটুট রাখতে পেরেছিলেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ একজন ন্যায়বিচারক ছিলেন। রিয়াজ-উসসালাতিন গ্রন্থে তার ন্যায় বিচারের এক অতি উজ্জ্বল কাহিনির বর্ণনা আছে। সুপণ্ডিত হিসেবে সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল। কবি-সাহিত্যিকগণকে তিনি সমাদর ও শ্রদ্ধা করতেন। তিনি কাব্যরসিক ছিলেন এবং নিজেও ফার্সি ভাষায় কবিতা রচনা করতেন। পারস্যের প্রখ্যাত কবি হাফিজের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ হতাে।

মুসলমান শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ এবং বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকতার জন্য গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ বঙ্গের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর রাজত্বকালেই প্রথম বাঙালি মুসলমান কবি শাহ্ মুহম্মদ সগীর ‘ইউছুফ-জুলেখা’ কাব্য রচনা করেন। আযম শাহের রাজত্বকালেই বিখ্যাত সুফি সাধক নূর কুতুব-উল-আলম পাণ্ডুয়ায় আস্তানা গড়ে তােলেন।

ফলে পাণ্ডুয়া ইসলাম শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। সুলতান মক্কা ও মদিনাতেও মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণের জন্য অর্থ ব্যয় করতেন। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ ছিলেন বঙ্গের শ্রেষ্ঠ সুলতানদের অন্যতম এবং ইলিয়াস শাহি বংশের শেষ সুলতান। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই এ বংশের পতন শুরু হয়।

Leave a Reply