শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সংকট

শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সংকট

প্রায় ছয় মাস ধরে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। দেশের সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে গেছে দেশের। জনগণ। তারই জেরে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন পদত্যাগী প্রেসিডেন্ট গােতাবায়া রাজাপক্ষে। পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন গােতাবায়ার ভাই তথা দেশের প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ্রা রাজাপক্ষে। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ দখল করে নিয়েছিল জনসাধারণ। তারপরই নতুন নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হয়।

গত ২০ জুলাই ২০২২ পার্লামেন্টে ভােটাভুটি হয়। নির্বাচনে দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রনিল বিক্রমাসিংহে। প্রেসিডেন্ট পদে যে তিন প্রার্থী লড়েন, তাঁদের মধ্যে রনিল ছাড়াও ছিলেন শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন দল পদুজানা পেরামুনা পার্টির সংসদ সদস্য দুল্লাস আলাহাপেরুমা ও ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ারের নেতা কুমারা দেসানায়েকে।

১৩৪ ভােট পেয়ে রনিল প্রার্থীদের মধ্যে সবাইকে ছাড়িয়ে যান, তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী দুল্লাস আলাহাপেরুমা পান ৮২ ভােট। দেসানায়েকের বাক্সে পড়ে মাত্র ৩ ভােট। এদিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরপরই বিক্ষোভ দমনে কঠোর অবস্থানে যান রনিল। রাজধানী কলম্বােয় সরকারি দপ্তরগুলাে থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। অভিযান চালিয়ে বিক্ষোভকারীদের হটিয়ে দেন।

শ্রীলঙ্কার সংকটের পেছনে কী

কয়েক দশকের মধ্যে শ্রীলঙ্কা সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অর্থনৈতিক সংকট থেকেই রাজনৈতিক সংকটের শুরু। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, রাসায়নিক সারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেশটির অর্থনৈতিক ক্ষতির একটি কারণ। তবে এর পেছনে আরও অনেক কারণ রয়েছে।

আরও পড়ুন :  বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রস্তুতির জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ১ম পর্ব

এ ছাড়া শ্রীলঙ্কার আর্থিক সংকটের কারণ হিসেবে দেশটির সরকার। পর্যটকের সংখ্যা কমে যাওয়াকে দায়ী করেছে। করােনা মহামারির কারণে পর্যটননির্ভর শ্রীলঙ্কা অনেকটাই পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ে। ফলে শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে পড়ে। আমদানির জন্য এই বৈদেশিক মুদ্রা দেশটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তবে শ্রীলঙ্কার এই সংকট নতুন নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তামিল টাইগারদের সঙ্গে গৃহযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসারের বদলে অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য সরবরাহের দিকে মন দেয়। রপ্তানি থেকে দেশটির আয় কমে যায়। আর আমদানির ব্যয় বাড়তেই থাকে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় জ্বালানি ও ওষুধের মতাে প্রয়ােজনীয় পণ্য আমদানির জন্য অর্থ পরিশােধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক বেশি হারে কর কমানাে, ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণ, বড় বড় অবকাঠামাের জন্য খরচের কারণেও দেশটির অর্থনীতি সংকটে পড়েছে।

আর এই অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব পড়েছে জনগণের দৈনন্দিন জীবনে। ফলে জনরােষের মুখে পড়ে শ্রীলঙ্কার সরকার। আর তার ধারাবাহিকতাতেই বেড়েছে রাজনৈতিক সংকট।

শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সংকটের ঘটনাপ্রবাহ নিম্নরূপ

৩ এপ্রিল ২০২২ : ৩ এপ্রিল গভীর রাতে শ্রীলঙ্কার মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্য ইস্তফা দেন। এতে গােতাবায়া-মাহিন্দা কোণঠাসা হয়ে পড়েন।

আরও পড়ুন :  বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস

৪ এপ্রিল ২০২২ : ৪ এপ্রিল দেশটির বিরােধীদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব দেয় সরকার। কিন্তু বিরােধীরা তা নাকচ করেন।

৯-১২ এপ্রিল ২০২২ :  ৯ এপ্রিল সরকারের পদত্যাগের দাবিতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন হাজারাে মানুষ। ১২ এপ্রিল সরকার ৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক ঋণখেলাপির ঘােষণা দেয়। অতিপ্রয়ােজনীয় পণ্য কিনতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শেষের দিকে বলে জানানাে হয়।

১৮-২৮ এপ্রিল ২০২২ : ১৮ এপ্রিল মন্ত্রিসভার নতুন সদস্য নিয়ােগ দেয় সরকার। তবে এই সরকারেও মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাখেন গােতাবায়া। টানা কয়েক সপ্তাহের সরকারবিরােধী বিক্ষোভে ১৯ এপ্রিল পুলিশের গুলিতে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ২৮ এপ্রিল দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটে থমকে যায় শ্রীলঙ্কা।

৬ মে ২০২২ : ৬ মে আবার ধর্মঘট ডাকা হয়। এদিন আবার জরুরি অবস্থা ঘােষণা করে শ্রীলঙ্কা সরকার।

৯ মে ২০২২ : ৯ মে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালান সরকার সমর্থকেরা। বিক্ষোভকারীরাও পাল্টা হামলা করেন। সংঘর্ষের পর মাহিন্দা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগে  বাধ্য হন। প্রেসিডেন্ট গােতাবায়ার ওপর চাপ আরও বাড়ে। তিনি একা হয়ে পড়েন।

১২ মে ২০২২ : সংকট উত্তরণে রনিল বিক্রমাসিংহেকে শ্রীলঙ্কার নতুন প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ১২ মে তিনি শপথ নেন। এর আগে তিনি পাঁচবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

আরও পড়ুন :  বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগাে মিউজিয়াম

৯ জুলাই ২০২২ : ৯ জুলাই সরকারবিরােধী বিক্ষোভ নাটকীয় মােড় নেয়। এদিন বিক্ষোভকারীরা দেশটির প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢুকে পড়েন। তার আগেই প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ছাড়েন গােতাবায়া।

১২ জুলাই ২০২২ : গণবিক্ষোভের মুখে ১২ জুলাই রাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে মালদ্বীপে যান গােতাবায়া। তার অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয় রনিল বিক্রমাসিংহেকে। এই পদক্ষেপে দেশটিতে জনরােষ আরও বাড়ে।

১৩ জুলাই ২০২২ : ১৩ জুলাই শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা। জারি করেন রনিল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারে নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রয়ােজনীয় সবকিছু করার নির্দেশ দেন তিনি। এদিন ক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে হামলা চালান। কার্যালয় দখলে নেন। তারা অবিলম্বে রনিলেরও পদত্যাগ দাবি করেন। দ্রুত অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দাবি জানান।

১৪ জুলাই ২০১২ : ১৪ জুলাই মালদ্বীপ থেকে সিঙ্গাপুরে যান গােতাবায়া। গােতাবায়া সিঙ্গাপুরে গিয়ে ১৪ জুলাই শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের স্পিকারের কাছে ই-মেইলে তার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।

১৫ জুলাই ২০২২ :  ১৫ জুলাই গােতাবায়ার পদত্যাগপত্র। গ্রহণের আনুষ্ঠানিক ঘােষণা দেন। দেশটির পার্লামেন্ট স্পিকার। একই সঙ্গে রনিল দেশটির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন।

২০ জুলাই ২০১২ : পার্লামেন্ট সদস্যদের (এমপি) ভােটে শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রনিল বিক্রমাসিংহে।
২২ জুলাই ২০১২। শ্রীলঙ্কার নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মহাজনা একসাথ পেরামুনা পার্টির দিনেশ গুনাবর্ধনে।

Leave a Reply