সভ্যতা কী?
অনেক সমাজবিজ্ঞানী সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে এক করে দেখেন। কিন্তু সংস্কৃতি ও সভ্যতা এক জিনিস নয়। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ডন মার্টিন ডেল বলেন যে, উন্নত ধরনের শিল্পকলা, বিজ্ঞান ও ধর্ম-এরই সম্মিলিত অর্থে সভ্যতা শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
সভ্যতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ম্যাকাইভার ও পেজ বলেন, “সভ্যতা অর্থে আমরা বুঝি মানুষ তার জীবন ধারণের ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে যান্ত্রিক ব্যবস্থা, কলাকৌশল ও সংগঠন সৃষ্টি করেছে, তারই সামগ্রিক রূপ।” সুতরাং সভ্যতা বলতে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানকে বােঝায় যার দ্বারা মানুষ প্রাকৃতিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। অর্থাৎ নানা ধরনের কারিগরি কলাকৌশল ও যন্ত্রপাতি সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত।
সংস্কৃতি ও সভ্যতার সম্পর্ক
সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে সম্পর্ক জানতে হলে তাদের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে জানা প্রয়ােজন। সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে নিম্নলিখিত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
(১) সংস্কৃতি হল মানুষের অবতুগত (Im-material) সৃষ্টি। যেমন- জ্ঞান, বিশ্বাস, সংগীত, নৃত্যকলা ইত্যাদি। এগুলাে হল সংস্কৃতি। অন্যদিকে সভ্যতা হল মানুষের বতুগত (Material) সৃষ্টি। যেমন- ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, ঘড়ি, টেলিভিশন, মােটরগাড়ি ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে ম্যাকাইভার বলেন, “আমরা যা সেটাই আমাদের সংস্কৃতি, আর আমাদের যা আছে’ বা আমরা যা ব্যবহার করি সেটাই হল সভ্যতা।”
(২) জার্মান দার্শনিক কান্ট (Kant) বলেন যে, সংস্কৃতি ব্যক্তির মনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার; সভ্যতার সঙ্গে ব্যক্তির বাহ্য আচরণের সম্পর্ক।
(৩) দক্ষতার ভিত্তিতে সভ্যতার পরিমাপ করা যায়, কিন্তু সংস্কৃতির বিচার হয় মানুষের মানসিক উৎকর্ষের ভিত্তিতে। যেমন- একটি ট্রাক ঘােড়ার গাড়ির তুলনায় অধিক দ্রুতগামী, একটি উড়ােজাহাজ ট্রাকের চেয়ে বেশি দ্রুতগামী। অন্যদিকে সংস্কৃতিকে কোনাে কিছু দিয়ে বিচার করা যায় না। যেমন- একটি ভালাে চিত্র কারাের কাছে সুন্দর, আবার কারাের কাছে অসুন্দর লাগতে পারে।
(৪) সভ্যতা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করা যায়, কিন্তু সংস্কৃতি অর্জন করতে হয়। যেমন- উত্তরাধিকার সূত্রে কোনাে ব্যক্তি একটি হারমােনিয়াম পেতে পারে, কিন্তু ঐ হারমােনিয়াম বাজানাের কৌশল তাকে শিখতে হয়।
(৫) সভ্যতার অবদানকে সহজেই উপলব্ধি করা যায়, কিন্তু সংস্কৃতির অবদান সাধারণ মানুষ অতি সহজেই উপলব্ধি করতে পারে না। সাধারণ লােক সামান্য শিক্ষা পেলেই আধুনিক যন্ত্রপাতির কলাকৌশল বা ব্যবহার বুঝে নিতে পারে। কিন্তু কোনাে লােককে কবিতা লেখার নিয়ম শিখালেই যে সে ঐ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
(৬) সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, কিন্তু সংস্কৃতি সহজে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না। যেমন নর্ডিক জাতি রােমানদের পরাজিত করে রােমান সভ্যতা ধ্বংস করে দিয়েছিল, কিন্তু তারা রােমান ভাষা, আইন, প্রথা, ধর্ম প্রভৃতি সংস্কৃতির উপাদান ধ্বংস করতে পারে নি, বরং সেগুলাে গ্রহণ করেছিল।
(৭) সভ্যতার গতি খুব দ্রুত, সংস্কৃতির গতি তেমন দ্রুত নয়।
সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও এদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। চারাগাছের বৃদ্ধি ও পুষ্টির জন্য যেমন উপযুক্ত মাটি ও জলবায়ুর প্রয়ােজন, তেমনি সংস্কৃতির বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ দরকার। সভ্যতার বিভিন্ন উপাদান এ পরিবেশ সৃষ্টি করে। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতির যেমন উন্নতি সাধিত হয়, ঠিক তেমনি সভ্যতার অবদানকে উপেক্ষা করে সংস্কৃতি নিজেকে বিকশিত করতে পারে না। কাজেই সভ্যতাকে সংস্কৃতির একটি অংশ হিসেবে গণ্য করাই যুক্তিসঙ্গত।