অন্যান্য

স্নায়ুযুদ্ধ উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

ইংরেজি Cold War -এর বাংলা প্রতিশব্দ স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠান্ডা লড়াই। এ লড়াইয়ে একদিক যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব আর অন্যদিকে, সােভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া। দুই পরাশক্তির মেরুকরণে বিশ্ব বিভাজিত এবং সার্বক্ষণিক যুদ্ধের উত্তেজনা ঘিরে রাখে। ইরান-সৌদি দ্বন্দ্বে ২০২০ সালের শুরুতে জেনারেল সুলাইমানিকে হত্যা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন সরাসরি যুদ্ধে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত অনেকটা স্নায়ুযুদ্ধের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।

ধারণা

সরাসরি কোনাে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে, শক্তি প্রদর্শনে যুদ্ধের মহড়া চালিয়ে যাওয়াকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় স্নায়ুযুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়। আভিধানিকভাবে স্নায়ুযুদ্ধ কথাটির উদ্ভব হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব বার্নাড বারুচ সাউথ ক্যারােলিনায় এক ভাষণে সর্বপ্রথম স্নায়যুদ্ধ প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন বলে জানা যায়। তবে তিনি স্নায়ুযুদ্ধ বলতে কোনাে যুদ্ধাবস্থা বােঝাননি। বিভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কে উত্থান-পতন এবং প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব, সম্পর্কে তিক্ততা কিংবা মতবিরােধ এ যুদ্ধকে প্রণােদিত করে।

উদ্ভব

স্নায়ুযুদ্ধের সূচনাপর্বে কোন শক্তি স্নায়ুযুদ্ধকে প্রণােদিত করে সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলা কঠিন। বিশ্লেষকগণ এ যুদ্ধের সূচনা পর্বে সােভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বিস্তারের যে প্রবণতা, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্য বাধা হয়ে না দাঁড়ালে তাদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখিন হতে পারে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৫ মার্চ ১৯৪৬ যুক্তরাজ্যের তঙ্কালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ফুলটন বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, রাশিয়া একমাত্র শক্তি প্রয়ােগ ব্যতীত আর কোনাে ভাষা বােঝে না। তাই বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য রাশিয়ার ওপর শক্তি প্রয়ােগের বিকল্প নেই। আর এ নীতি শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় স্নায়ুযুদ্ধে।

স্নায়ুযুদ্ধকালীন বিশ্ব

স্নায়ুযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে ইউরােপে সােভিয়েত ইউনিয়নের মতাদর্শিক সমাজতান্ত্রিক শিবিরের উদ্ভব, ট্রম্যান নীতি, মার্শাল পরিকল্পনা, বার্লিন সংকট, ওয়ারশ চুক্তি, ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি, কিউবা সংকট প্রভৃতি বিষয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সােভিয়েত ইউনিয়নের সম্প্রসারণবাদে ভয় পেয়ে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রম্যানের ১৯৪৭ সালে দেওয়া তত্ত্বের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ছিল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় ঐক্য রক্ষার নামে অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অজুহাত প্রতিহত করা।

পাশাপাশি ট্রম্যান তত্ত্বের আলােকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে সােভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে হস্তক্ষেপ করছিল তা প্রতিরােধেও একটি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা চালানাে হয়। এর প্রেক্ষিতে ইউরােপের ১৬টি কমিউনিস্ট বিরােধী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোট গঠন করে। এ দেশগুলাের মধ্যে অনেক দেশ আমেরিকার কাছ থেকে সহযােগিতা নিয়ে তাদের আর্থিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটায় বলে তাদের দেখে আরও অনেক দেশ অনুপ্রাণিত হয়।

৪ এপ্রিল ১৯৪৯ ন্যাটো’ নামক একটি আন্তর্জাতিক সামরিক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটায় আমেরিকা। অন্যদিকে, ন্যাটোর। বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়াও এ সময় ওয়ারশ চুক্তি করে। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে রাশিয়ার উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার হস্তক্ষেপ থেকে তার অধীনে থাকা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলােকে রক্ষা করা। ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের উদ্ভবের মধ্য দিয়ে স্নায়ুযুদ্ধ অন্যদিকে মােড় নেয়। ইউরােপকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হলেও তা ক্রমেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৪৫-১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ইউরােপে কেন্দ্রীভূত স্নায়ুযুদ্ধ কোরিয়া যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ১৯৫০ সালে এশিয়া মহাদেশে প্রবেশ করে। ২৫ জুন ১৯৫০ সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবাধীন উত্তর কোরিয়া মার্কিন প্রভাবাধীন দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করে। ১৯৫৩ সালে কোরিয়ায় যুদ্ধবিরতি ঘােষিত হলেও এবং শীর্ষ নেতাদের মধ্যে একাধিক বৈঠক হলেও দুই জোটের মধ্যে উত্তেজনা, সন্দেহ ও যুদ্ধাবস্থা অব্যাহত থাকে। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল সংকটকে কেন্দ্র করে মার্কিন ও সােভিয়েত দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। খালের মালিকানা নিয়ে মিসর ও যুক্তরাজ্য মুখােমুখি হয়। সােভিয়েত ইউনিয়ন মিসরকে আর যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যকে সমর্থন দেয়। ১৯৬২ সালে কিউবায় মিসাইল নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধ তীব্র হয়।

তারপর ভিয়েতনাম যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ ইত্যাদিতে সােভিয়েত ও মার্কিনরা পেছন থেকে পরস্পর বিরােধী অবস্থানে লড়তে থাকে। ৭০ দশকে আফগানিস্তানে সােভিয়েত আগ্রাসন হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুজাহিদদের অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য দেয়। সে সময় মাটিতে যুদ্ধের পাশাপাশি তারকা যুদ্ধও শুরু হয়। বস্তুতপক্ষে, সব সময় সরাসরি যুদ্ধ না হলেও বিভিন্ন পক্ষের পেছনে থেকে মার্কিন ও সােভিয়েতরা যুদ্ধ কিংবা যুদ্ধাবস্থার মধ্যে পুরাে পৃথিবীতে ফেলে দেয়। স্নায়ুযুদ্ধের সুদীর্ঘ সময়কালে।

স্নায়ুযুদ্ধের অবসান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শুরু হয় ১৯৯০-এর দশকে বার্লিন দেয়াল ভেঙে দুই জার্মানির একত্রীকরণ এবং পরিশেষে খােদ সােভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্রের অবসানের ফলে ৪৫ বছরব্যাপী স্নায়ুযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। একই সঙ্গে দ্বিমেরু বিশ্বে একমেরু কেন্দ্রিক ক্ষমতা-কেন্দ্রের মাধ্যমে বিশ্ব নেতৃত্ব চলে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র কজায়। তবে পূর্ববর্তী সােভিয়েত্রে উত্তরাধিকারী ও পারমাণবিক শক্তি পেয়ে রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদে আসে। দুই জার্মান এক হয়ে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে। চীন আর্থিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম স্থানে চলে আসার অবস্থাও তৈরি হয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button