পরিবার কি? পরিবারের শ্রেণিবিভাগ ও কার্যাবলি – বিস্তারিত বিশ্লেষণ

পরিবার
সমাজ স্বীকৃত বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বামী-স্ত্রীর একত্রে বসবাস করাকে পরিবার বলে। অর্থাৎ বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে এক বা একাধিক পুরুষ ও মহিলা, তাদের সন্তানাদি, পিতামাতা এবং অন্যান্য পরিজন নিয়ে যে সংগঠন গড়ে উঠে- তাকে পরিবার বলে । ম্যাকাইভারের মতে, সন্তান জন্মদান ও লালন-পালনের জন্য সংগঠিত ক্ষুদ্র বর্গকে পরিবার বলে । আমাদের দেশে সাধারণত মা-বাবা, ভাই-বােন, চাচা-চাচি ও দাদা-দাদির সমন্বয়ে পরিবার গড়ে উঠে। তবে শুধু একজন মহিলা বা একজন পুরুষকে পরিবার বলা হয়। মূলত পরিবার হলাে স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালােবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গঠিত ক্ষুদ্র সামাজিক প্রতিষ্ঠান।
পরিবারের শ্রেণিবিভাগ
আমরা সবাই পরিবারে বাস করি। কিন্তু সব পরিবারের প্রকৃতি ও গঠনকাঠামাে এক রকম নয়। কতগুলাে নীতির ভিত্তিতে পরিবারের শ্রেণিবিভাগ করা যায়। যেমন- (ক) বংশ গণনা ও নেতৃত্ব (খ) পারিবারিক কাঠামাে ও (গ) বৈবাহিক সূত্র।
ক. বংশ গণনা ও নেতৃত্ব : এ নীতির ভিত্তিতে পরিবারকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা পিতৃতান্ত্রিক ও মাতৃতান্ত্রিক পরিবার । পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে সন্তানরা পিতার বংশপরিচয়ে পরিচিত হয় এবং পিতা পরিবারে নেতৃত্ব দেন। আমাদের দেশের অধিকাংশ পরিবার এ ধরনের । অন্যদিকে, মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে মায়ের বংশপরিচয়ে সন্তানরা পরিচিত হয় এবং মা পরিবারে নেতৃত্ব দেন । যেমন- আমাদের দেশে গারােদের মধ্যে এ ধরনের পরিবার দেখা যায় ।
খ. পারিবারিক কাঠামাে: পারিবারিক গঠন ও কাঠামাের ভিত্তিতে পরিবারকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায় । যথা- একক ও যৌথ পরিবার। একক পরিবার মা-বাবা ও ভাই-বােন নিয়ে গঠিত হয়। এ ধরনের পরিবার ছােট হয়ে থাকে। যৌথ পরিবারে মা-বাবা, ভাই-বােন, দাদা-দাদি, চাচা-চাচি ও অন্যান্য পরিজন একত্রে বাস করে। যৌথ পরিবার বড় পরিবার। বাংলাদেশে উভয় ধরনের পরিবার রয়েছে। তবে বর্তমানে একক পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। মূলত যৌথ পরিবার কয়েকটি একক পরিবারের সমষ্টি।
গ. বৈবাহিক সূত্র : বৈবাহিক সূত্রের ভিত্তিতে তিন ধরনের পরিবার লক্ষ করা যায়। যথা- একপত্নীক, বহুপত্নীক ও বহুপতি পরিবার। একপত্নীক পরিবারে একজন স্বামীর একজন স্ত্রী থাকে। আর বহুপত্নীক পরিবারে একজন স্বামীর একাধিক স্ত্রী থাকে। আমাদের সমাজের অধিকাংশ পরিবার একপত্নীক, তবে বহুপত্নীক পরিবারও কদাচিৎ দেখা যায়। বহুপতি পরিবারে একজন স্ত্রীর একাধিক স্বামী থাকে। বাংলাদেশে এ ধরনের পরিবার দেখা যায় না ।
পরিবারের কার্যাবলি
পরিবারের সদস্যদের সুন্দর ও নিরাপদ জীবন গড়ে তােলার জন্য পরিবার বহুবিধ কাজ করে। পরিবার সাধারণত যেসব কার্য সম্পাদন করে, সেগুলাে নিম্নরূপ
১. জৈবিক কাজ :
আমাদের মা-বাবা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলেই আমরা জন্মগ্রহণ করেছি এবং তাদের দ্বারা লালিত-পালিত হচ্ছি। অতএব, সন্তান জন্মদান ও লালন-পালন করা পরিবারের অন্যতম কাজ। পরিবারের এ ধরনের কাজকে জৈবিক কাজ বলা হয়।
২. শিক্ষামূলক কাজ :
আমাদের মধ্যে অনেকে বিদ্যালয়ে যাওয়ার পূর্বেই পরিবারে বর্ণমালার সাথে পরিচিত হই । তাছাড়া মা-বাবা, ভাই-বােন ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের পারস্পরিক সহায়তায় সততা, শিষ্টাচার, উদারতা, নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলির শিক্ষা লাভের প্রথম সুযোেগ পরিবারেই সৃষ্টি হয়। এগুলাে পরিবারের শিক্ষামূলক কাজ। আর পরিবারে শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বলে পরিবারকে শাশ্বত বিদ্যালয় বা জীবনের প্রথম পাঠশালা বলা হয় ।
৩. অর্থনৈতিক কাজ :
পরিবারের সদস্যদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি চাহিদা পূরণের দায়িত্ব পরিবারের। পরিবারের সদস্যরা বিভিন্নভাবে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে এসব চাহিদা মিটিয়ে থাকে। পরিবারকে কেন্দ্র করে কুটির শিল্প, মৎস্য চাষ, কৃষিকাজ, পশু পালন ইত্যাদি অর্থনৈতিক কাজ সম্পাদিত হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট কাজের জায়গাগুলাে অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হয়েছে এবং নতুন নতুন কাজের সুযােগ সৃষ্টি হয়েছে। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে হ্রাস পেয়েছে। তবে আজও পরিবার আমাদের সকল প্রকার অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করছে।
৪. রাজনৈতিক কাজ :
পরিবারে সাধারণত মা-বাবা কিংবা বড় ভাই-বােন অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে। আমরা ছােটরা তাদের আদেশ-নির্দেশ মান্য করে চলি। তারাও আমাদের অধিকার রক্ষায় কাজ করেন । বুদ্ধি, বিবেক ও আত্মসংযমের শিক্ষা দেন, যা আমাদের সুনাগরিক হতে সাহায্য করে। এভাবে পারিবারিক শিক্ষা ও নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে পরিবারেই শিশুর রাজনৈতিক শিক্ষা শুরু হয়। এ শিক্ষা পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় জীবনে কাজে লাগে। এছাড়া বড়দের রাজনৈতিক আলােচনা শুনে ও সে আলােচনায় অংশগ্রহণ করে আমরা দেশের রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠি।
৫. মনস্তাত্ত্বিক কাজ :
পরিবার মায়ামমতা, স্নেহ-ভালােবাসা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের মানসিক চাহিদা পূরণ করে। নিজের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সাথে ভাগাভাগি করে প্রশান্তি লাভ করা যায়। যেমন- কোনাে বিষয়ে মন খারাপ হলে মা-বাবা, ভাই-বােনদের সাথে আলাপ-আলােচনা করে তার সমাধান করা যায়। এ ধরনের আলােচনা মানসিক শান্তি-ক্লান্তি মুছে দিতে সাহায্য করে। তাছাড়া পরিবার থেকে শিশু উদারতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা প্রভৃতি গুণগুলাে শিক্ষা লাভ করে, যা তাদের মানসিক দিককে সমৃদ্ধ করে।
৬. বিনােদনমূলক কাজ :
পরিবারের সদস্যদের সাথে গল্প-গুজব, হাসি-ঠাট্টা, গান-বাজনা, টিভি দেখা, বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা বিনােদন লাভ করি। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে পরিবারের উল্লিখিত কাজগুলাে কিছুটা হ্রাস পেলেও সদস্যদের সর্বাধিক কল্যাণ সাধনে পরিবারের এসব কাজের গুরুত্ব অপরিসীম।
পরিবার সম্পর্কিত এমসিকিউ
১. পরিবার কাকে বলে?
ক) একদল বন্ধুর সমষ্টি
খ) সমাজের একটি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান
গ) একই পেশার লোকদের সমষ্টি
ঘ) একই ধর্মের লোকদের সমষ্টি
উত্তর: খ) সমাজের একটি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান
২. ম্যাকাইভারের মতে, পরিবার কিসের জন্য গঠিত?
ক) আর্থিক উন্নতির জন্য
খ) সন্তান জন্মদান ও লালন-পালনের জন্য
গ) সামাজিক পরিবর্তনের জন্য
ঘ) শিক্ষা প্রদানের জন্য
উত্তর: খ) সন্তান জন্মদান ও লালন-পালনের জন্য
৩. আমাদের দেশে সাধারণত কোন ধরনের পরিবার বেশি দেখা যায়?
ক) মাতৃতান্ত্রিক
খ) যৌথ
গ) একক
ঘ) বহুপত্নীক
উত্তর: গ) একক
৪. কোন পরিবারে পিতা পরিবার প্রধান হিসেবে বিবেচিত হন?
ক) মাতৃতান্ত্রিক
খ) পিতৃতান্ত্রিক
গ) একক
ঘ) যৌথ
উত্তর: খ) পিতৃতান্ত্রিক
৫. বাংলাদেশে গারোদের মধ্যে কোন পরিবার বেশি দেখা যায়?
ক) মাতৃতান্ত্রিক
খ) পিতৃতান্ত্রিক
গ) একক
ঘ) যৌথ
উত্তর: ক) মাতৃতান্ত্রিক
৬. পরিবারের শ্রেণিবিভাগ কয়টি প্রধান নীতির ভিত্তিতে করা হয়?
ক) ২টি
খ) ৩টি
গ) ৪টি
ঘ) ৫টি
উত্তর: খ) ৩টি
৭. নিচের কোনটি পরিবারের একটি কাজ?
ক) সামাজিক ভাঙন তৈরি করা
খ) সন্তান জন্মদান ও লালন-পালন
গ) রাজনৈতিক দল গঠন করা
ঘ) ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করা
উত্তর: খ) সন্তান জন্মদান ও লালন-পালন
৮. পরিবারকে “শাশ্বত বিদ্যালয়” বলা হয় কেন?
ক) কারণ এটি শিক্ষার প্রথম উৎস
খ) কারণ এখানে পরীক্ষা হয়
গ) কারণ এটি শিক্ষার শেষ ধাপ
ঘ) কারণ এটি বিদ্যালয়ের বিকল্প
উত্তর: ক) কারণ এটি শিক্ষার প্রথম উৎস
৯. বাংলাদেশে কোন ধরনের পরিবার বেশি দেখা যায়?
ক) বহুপতি
খ) বহুপত্নীক
গ) একপত্নীক
ঘ) মাতৃতান্ত্রিক
উত্তর: গ) একপত্নীক
১০. যৌথ পরিবার সাধারণত কাদের সমন্বয়ে গঠিত হয়?
ক) বাবা-মা ও সন্তান
খ) বাবা-মা, ভাই-বোন ও অন্যান্য পরিজন
গ) শুধু স্বামী-স্ত্রী
ঘ) শুধু সন্তান ও তাদের বাবা
উত্তর: খ) বাবা-মা, ভাই-বোন ও অন্যান্য পরিজন
১১. পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে সন্তান কার পরিচয়ে পরিচিত হয়?
ক) মায়ের
খ) পিতার
গ) আত্মীয়দের
ঘ) পিতামাতার সমানভাবে
উত্তর: খ) পিতার
১২. কোনটি পারিবারিক কাজ নয়?
ক) অর্থনৈতিক কাজ
খ) রাজনৈতিক কাজ
গ) বিনোদনমূলক কাজ
ঘ) শিল্প প্রতিষ্ঠা করা
উত্তর: ঘ) শিল্প প্রতিষ্ঠা করা
১৩. পরিবারে শিশুদের রাজনৈতিক শিক্ষা কীভাবে শুরু হয়?
ক) বিদ্যালয়ে গিয়ে
খ) বড়দের নির্দেশনা মেনে চলার মাধ্যমে
গ) ভোট দেওয়ার মাধ্যমে
ঘ) সরকারি কাজের অংশগ্রহণের মাধ্যমে
উত্তর: খ) বড়দের নির্দেশনা মেনে চলার মাধ্যমে
১৪. পরিবারে অর্থনৈতিক কাজের উদাহরণ কোনটি?
ক) গল্প বলা
খ) কুটির শিল্প
গ) খেলাধুলা
ঘ) টিভি দেখা
উত্তর: খ) কুটির শিল্প
১৫. কোনটি পরিবারে মানসিক প্রশান্তির কারণ হতে পারে?
ক) সদস্যদের মধ্যে ভালোবাসা ও সহানুভূতি
খ) প্রতিযোগিতা ও সংঘর্ষ
গ) সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ
ঘ) ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা
উত্তর: ক) সদস্যদের মধ্যে ভালোবাসা ও সহানুভূতি
১৬. পরিবার কীভাবে সদস্যদের বিনোদন দেয়?
ক) খেলাধুলা ও গল্পের মাধ্যমে
খ) অফিসের কাজের মাধ্যমে
গ) বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে
ঘ) কঠোর শৃঙ্খলা রক্ষা করে
উত্তর: ক) খেলাধুলা ও গল্পের মাধ্যমে
১৭. পরিবারে শিক্ষামূলক কাজের মূল লক্ষ্য কী?
ক) শিশুদের কঠোর জীবনযাপন শেখানো
খ) সামাজিক মূল্যবোধ ও আচরণ শেখানো
গ) ব্যবসায় দক্ষতা শেখানো
ঘ) শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের পদ্ধতি শেখানো
উত্তর: খ) সামাজিক মূল্যবোধ ও আচরণ শেখানো
১৮. পরিবারে শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কী?
ক) বাবা-মায়ের ভালোবাসা ও যত্ন
খ) কঠোর শাস্তি
গ) পরিবারের প্রতি উদাসীনতা
ঘ) সম্পদের প্রাচুর্য
উত্তর: ক) বাবা-মায়ের ভালোবাসা ও যত্ন
১৯. একক পরিবারের একটি বৈশিষ্ট্য কী?
ক) এতে অনেক সদস্য থাকে
খ) এটি সাধারণত ছোট আকারের হয়
গ) এতে দাদা-দাদি ও চাচা-চাচি থাকে
ঘ) এটি শুধুমাত্র শহরে দেখা যায়
উত্তর: খ) এটি সাধারণত ছোট আকারের হয়
২০. পরিবারের গুরুত্ব কমছে কেন?
ক) প্রযুক্তির উন্নতি ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের ফলে
খ) মানুষের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা বেড়ে যাওয়ায়
গ) পরিবারে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে
ঘ) পরিবারের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ার ফলে
উত্তর: ক) প্রযুক্তির উন্নতি ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের ফলে