ভূমিকা: উৎসব সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর মধ্যে নিহিত থাকে একটি জনপদের ইতিহাস- ঐতিহ্য, কিংবদন্তী এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষের বিশ্বাস ও ভালো-মন্দ লাগার উপাদান। কোনো দেশ বা সমাজের উৎসব সম্পর্কে জানা থাকলে সেই দেশ বা সমাজের মানুষকেও অনেকখানি জানা হয়ে যায়। উৎসব হতে পারে কোনো জনগোষ্ঠীকেন্দ্রিক, আবার হতে পারে জনপদ বা ভূখণ্ডকেন্দ্রিক। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের উৎসবের প্রচলন রয়েছে। তবে অধিকাংশ উৎসবই কোনো না কোনো ঋতু বা মাসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এসব উৎসব মানুষের মনে কেবল আনন্দেরই সঞ্চার করে না বরং এর মধ্য দিয়ে দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সামগ্রিক চিত্রটি ফুটে ওঠে।
বাংলাদেশের প্রধান কয়েকটি উৎসব সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো।
বাংলা বর্ষবরণ: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো সর্বজনীন উৎসব বাংলা বর্ষবরণ। পুরানো দিনের দুঃখ, ব্যথা, ক্লান্তি, গ্লানি ভুলে নতুনকে বরণ করে নেওয়ার উৎসব এটি। এই উৎসব বাংলাদেশের সর্বত্র পালিত হয়। ধর্ম- বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল শ্রেণি-পেশা-বয়সের মানুষ এই উৎসব পালন করে। এ উপলক্ষে মেলা ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ব্যবসায়ীরা এই দিনে হালখাতা নামে হিসাবের নতুন খাতা খোলেন এবং বকেয়া আদায় উপলক্ষে গ্রাহকদের নিমন্ত্রণ করে মিষ্টিমুখ করান। বৈশাখের প্রথম দিনটিতে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে সামর্থ্য অনুযায়ী মজাদার খাবারের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক আড়ম্বরে উদযাপন করা হয় বাংলা নববর্ষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। নতুন বছরের সূর্যোদয়ের মুহূর্তে রমনার বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
বৈসাবি: বাংলাদেশে তিনটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি’। শব্দটি বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু– এই তিন নামের আদ্যক্ষর নিয়ে গঠিত। বৈসু, সাংগ্রাই ও বিজু যথাক্রমে ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমাদের বর্ষবরণ উৎসব। সাধারণত বছরের শেষ দুই দিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় বৈসাবি উদ্যাপিত হয়।
নবান্ন: নবান্ন হলো নতুন ধানের উৎসব। হেমন্ত কালে ঘরে ঘরে নতুন ধান ওঠে। এ সময়ে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যায়। আত্মীয়-পরিজন ও প্রতিবেশীদের উপস্থিতিতে ঘরে ঘরে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে ৷
একুশে ফেব্রুয়ারি: একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির দীর্ঘ দিনের সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের ইতিহাস। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিলকারীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। তাদের উপর তৎকালীন সরকারের নির্দেশে পুলিশ গুলি চালায়। এতে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেকে শহিদ হন। এই আত্মত্যাগ এবং দীর্ঘ সংগ্রামের ফলস্বরূপ ১৯৫৪ সালে বাংলা পায় রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি। শহিদদের স্মৃতিকে স্মরণ করতে ও শ্রদ্ধা জানাতে পরের বছর থেকেই দিনটি উদ্যাপিত হয়ে আসছে। নগ্ন পায়ে প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণ, শহিদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, আলোচনা সভা ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে সারা দেশে দিবসটি পালিত হয়। শহিদদের আত্মদান ও পৃথিবীর সকল মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশসহ জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির এই আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করতে কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস: ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয়। সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগের মধ্য দিয়ে দিনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয়। অফিসে, বাড়িতে, সড়কে, যানবাহনে সর্বত্র বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা শোভা পায়। এদিন জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ সারা দেশের স্মৃতিসৌধগুলোতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। একই সঙ্গে শিশুকিশোরসহ বিভিন্ন বাহিনীর কুচকাওয়াজ, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপিত হয়।
বিজয় দিবস: ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস। স্বাধীনতা ঘোষিত হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানি দখলদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষে ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় অর্জন করে। দিনটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত আনন্দের ও গৌরবের। তাই ডিসেম্বর এলেই সমগ্র দেশ লাল-সবুজে সেজে ওঠে। ১৬ই ডিসেম্বর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ সারা দেশের স্মৃতিসৌধগুলোতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক উৎসব, ক্রীড়া অনুষ্ঠান ও বই মেলার আয়োজন করা হয়।
বইমেলা: বইমেলা বাংলাদেশের আরেকটি প্রধান সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বইমেলার আয়োজন করা হয়। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বইমেলা – ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এই বইমেলা পরিণত হয় পাঠক ও লেখকের মিলনমেলায়। বইমেলায় অনেক লেখক তাঁদের নতুন বই যেমন প্রকাশ করেন, তেমনি পূর্বে প্রকাশিত বইও মেলায় পাওয়া যায়। বইমেলা এখন আর কেবল বই কেনাবেচার মেলা নয়, এটি পরিণত হয়েছে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক উৎসবে।
ঈদ: ঈদ মুসলমানদের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসব। ঈদ মানে আনন্দ, খুশি। ঈদ আসে আনন্দ আর মিলনের বার্তা নিয়ে। এই দিনে ধনী-নির্ধন ভেদাভেদ ভুলে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেয়। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে সাড়ম্বরে ঈদ উৎসব পালিত হয়। বছরে দুটি ঈদ। প্রথমে আসে ঈদ-উল ফিতর এবং পরে ঈদ-উল আজহা। রমজান মাসের শেষে হিজরি শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেলে ঈদ-উল ফিতর উদ্যাপিত হয়। জিলহজ মাসের দশম দিনে পালিত হয় ঈদ-উল আজহা। ঈদ-উল আজহায় পশু কোরবানি করা হয়। একে বলা হয় আত্মত্যাগের ঈদ। দুটি ঈদেই মুসলমানরা নতুন পোশাক পরে, ধনীরা গরিবদের দান করে। ঈদগাহে ঈদের নামাজের আয়োজন করা হয়। নামাজের পর একে অন্যের সঙ্গে কোলাকুলি করে। বাড়িতে ভালো খাবারের আয়োজন করা হয়। নিজে খেয়ে এবং অন্যকে খাইয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়।
দুর্গা পূজা: হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পুজা। শরৎকালে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তমী অষ্টমী নবমী এই তিন দিন দুর্গাপুজা অনুষ্ঠিত হয়। তবে সপ্তমীর আগের দিন ষষ্ঠী তিথিতে দেবীর বোধন অনুষ্ঠান হয়। নবমীর পরদিন দশমীর উৎসবকে বলা হয় বিজয়া দশমী। বোধন থেকে বিসর্জনের দিনগুলো বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনকে আন্দোলিত করে। পাড়ায় পাড়ায় তৈরি হয় পূজা মণ্ডপ, থাকে প্রসাদের আয়োজন। বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয় মেলা। দুর্গাপূজা হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব হলেও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও আনন্দ নিয়ে পূজামণ্ডপে ঘুরতে যায়। অষ্টমীর দিন আনন্দ আর জাঁকজমক থাকে বেশি। রাতে হয় আরতি। দশমীর দিন দেবী-বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা।
বুদ্ধ পূর্ণিমা: বুদ্ধ পূর্ণিমা বৌদ্ধদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে উদযাপিত হয় বলে এর অন্য নাম বৈশাখী পূর্ণিমা। এই দিনের সঙ্গে গৌতম বুদ্ধের জন্ম, তিরোধান ও বোধিলাভের স্মৃতি জড়িত। প্রার্থনা ও দান-দক্ষিণার মাধ্যমে এবং ফানুশ উড়িয়ে এই উৎসব পালন করা হয়।
বড়ো দিন: বাংলাদেশের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা পালন করে বড়ো দিন। যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে তারা এ উৎসব পালন করে। প্রতি বছর ২৫শে ডিসেম্বর বড়ো দিনের উৎসব পালিত হয়। গির্জায় প্রার্থনা করে, কেক কেটে, চকলেট বিতরণ করে, গান গেয়ে এই উৎসব পালন করা হয়।
অন্যান্য উৎসব: এছাড়া সারা বছরই বাংলাদেশে কোনো না কোনো উৎসব পালিত হয়। যেমন: রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী, লালন-উৎসব, মধুমেলা, মহররম, ঈদ-ই মিলাদুন নবি, সরস্বতী পূজা, লক্ষ্মী পূজা, প্রবারণা পূর্ণিমা, ইস্টার সানডে ইত্যাদি।
উপসংহার: মানুষের জীবনে উৎসবের তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর। উৎসব মানুষের মধ্যে সাম্য ও মৈত্রী গড়ে তোলে। আনন্দমুখর উৎসব প্রাঙ্গণে ঘুচে যায় মানুষে মানুষে ভেদাভেদ। উৎসব ছাড়া সকল শ্রেণির মানুষের মিলনমেলার চিত্র কল্পনাই করা যায় না। জাতীয় উৎসবগুলো মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমকে জাগ্রত করে। উৎসবের মধ্যে যে মূল্যবোধের বীজ আছে তাকে জাগ্রত করতে পারলে নিজস্ব সংস্কৃতি যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি মানুষের মধ্যে গড়ে উঠবে প্রীতি ও সৌহার্দ্য।”