- হোম
- একাডেমি
- সাধারণ
- নবম-দশম শ্রেণি
- পলিমার
পাঠ্যবিষয় ও অধ্যায়ভিত্তিক একাডেমিক প্রস্তুতির জন্য আমাদের উন্মুক্ত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করুন।
পলিমার
তন্তু থেকে সুতা তৈরি
তনু দিয়ে কি সরাসরি কাপড় বানানো যায়? না, যায় না। তন্তু দিয়ে প্রথমে সুতা তৈরি করা হয়, অতঃপর সেই সুতা দিয়ে কাপড় তৈরি হয়। তন্তু থেকে কোন প্রক্রিয়ায় সুতা তৈরি হবে, সেটা নির্ভর করে তন্তুর বৈশিষ্ট্যের ওপর। একেক রকমের তনুর জন্য একেক রকম পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়। তাহলে এখন আমরা সুতা তৈরির বিভিন্ন ধাপ সম্পর্কে জেনে নিই।
তন্তু সংগ্রহ
যেকোনো ধরনের সুতা তৈরির প্রথম ধাপ হলো তন্তু সংগ্রহ। উৎস অনুযায়ী তন্তু সংগ্রহ ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন- তুলার বেলায় গাছ থেকে কার্পাস ফল সংগ্রহ করে বীজ থেকে তুলা আলাদা করে ফেলা হয়। এই প্রক্রিয়ার নাম হলো জিনিং। জিনিং প্রক্রিয়ায় পাওয়া তনুকে বলে কটন লিন্ট। অনেকগুলো কটন লিন্ট একসাথে বেঁধে গাঁট তৈরি করা হয়। এই গাঁট থেকেই স্পিনিং মিলে সুতা কাটা হয়।
তোমরা বলো দেখি, পাট বা পাটজাতীয় (যেমন-শণ, তিসি ইত্যাদি) গাছ থেকে কী একই পদ্ধতিতে তনু সংগ্রহ করা যাবে? না, যাবে না। কারণ, এক্ষেত্রে বীজ থেকে তন্তু সংগ্রহ করা হয় না, তন্তু সংগ্রহ করা হয় সরাসরি গাছের বাকল থেকে। এর জন্য গাছ কেটে পাতা ঝরানোর জন্য প্রথমে কয়েক দিন মাঠেই একসাথে জড়ো করে রাখা হয়। এতে সাধারণত ৫-৮ দিন সময় লাগে। এলাকাভেদে জড়ো করে রাখা গাছকে চেল্লা বা পিল বলে। এভাবে জড়ো করে রাখার ফলে উদ্ভিদের পাতায় পচন ধরে, তাই একটু ঝাঁকুনি দিলেই সেগুলো গাছ থেকে ঝরে যায়। তবে খেয়াল রাখতে হয় গাছের পাতা যেন পুরোপুরি পচে না যায়। তখন পচা পাতা গাছের গায়ের সাথে লেগে যায়, যা সরানো কষ্টসাধ্য। পাতা ঝরানোর পর গাছগুলো একসাথে আটি বেঁধে ১০-১৫ দিন পানিতে ডুবিয়ে পচানো হয়। পচে গেলে খুব সহজেই গাছ থেকে আঁশ বা তন্তু আলাদা করা যায়। গাছ থেকে আঁশ আলাদা করে পানিতে ধুয়ে সেগুলো রৌদ্রে শুকানো হয়। শুকনো আঁশ একত্রিত করে গাঁট বা বেল বাঁধা হয়। তুলার মতোই এই গাঁট বা বেল সুতা কাটার জন্য স্পিনিং মিলে নেওয়া হয়।
এবার প্রাণিজ তন্তু কীভাবে সংগ্রহ করা হয়, সেটা দেখা যাক। তোমরা আগেই জেনেছ যে, রেশমি সুতা তৈরি হয় রেশম তন্তু থেকে। এক্ষেত্রে সরাসরি সুতা উৎপাদিত হয়, অন্য কোনো প্রক্রিয়ার দরকার হয় না। কৃত্রিম তন্তুর বেলাতেও কিন্তু রেশম তনুর মতো সরাসরি সুতা তৈরি হয়। তবে উল বা পশমি সুতার জন্য দরকারি প্রাণিজ তন্তু অর্থাৎ প্রাণিজ পশম, লোম বা চুল। এগুলো সংগ্রহ করা হয় বিভিন্ন প্রাণীর শরীর থেকে কেটে নিয়ে। এভাবে প্রাণীর দেহ থেকে লোম, পশম, চুল কেটে নিলে কি তাদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়? আসলে তেমন কোনো ক্ষতি হয় না, পশম বা লোম কেটে নেওয়ার পর কিছু দিনের মধ্যে আবার লোম গজায়, যা বড় হলে আবার কেটে সংগ্রহ করা হয়। তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে একই পশুর গা থেকে বারবার পশম সংগ্রহ করা যায়। আমরা আগেই বলেছি, এভাবে সংগ্রহ করা পশম, লোম বা চুলকে ফ্লিস উল বলা হয়। এই ফ্লিস উল বস্তায় করে সুতা কাটার জন্য স্পিনিং মিলে আনা হয়।
সুতা কাটা (Spinning)
সুতা কাটা হয় স্পিনিং মিলে (চিত্র ৬.০৩)। সাধারণত একটি মিল বা কারখানায় এক ধরনের তন্তু থেকে সুতা কাটা হয়। কারণ সুতা কাটার যে বিভিন্ন ধাপ রয়েছে, তা একেক ধরনের তনুর জন্য একেক রকম। এজন্য ভিন্ন ভিন্ন তন্তু থেকে তৈরি সুতার কারখানাও আলাদা। তবে তন্মভেদে সুতা কাটার পদ্ধতিতে ভিন্নতা থাকলেও কিছু কিছু মিলও আছে। এখন আমরা তন্তু থেকে সুতা কাটার পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে জেনে নিই।
ব্লেন্ডিং ও মিক্সিং
কারখানায় আনা তনুর বেল বা গাঁট ব্লেন্ডিং রুমে নিয়ে প্রথম খুলে ফেলা হয়। এরপর বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে একসাথে গুচ্ছাকারে থাকা তনুকে কেটে যথাসম্ভব ছোট ছোট গুচ্ছে পরিণত করা হয়। এ সময় তনুর সাথে থাকা ময়লার ছোট ছোট টুকরা, বীজ বা পাতার কাটা কোনো অংশ থাকলেও তা দূর করা হয়। এরপর বিভিন্ন রকম তুলার একটি মিশ্রণ তৈরি করা হয়। এই মিশ্রণ তৈরি করা হয় কেন? তার কারণ হলো, গুণে এবং মানে ঠিক একই রকম তুলা সব সময় পাওয়া সম্ভব হয় না। বিভিন্ন রকম তুলার মিশ্রণ না করলে একেক সময় একেক রকম সুতা তৈরি হবে, কখনো ভালো, কখনো মন্দ অর্থাৎ সুতার মান এক হবে না। এছাড়া বিভিন্ন রকম তুলা মিশিয়ে সুতা তৈরি করলে উৎপাদন খরচও কম হয়। এটি বাংলাদেশের জন্য বেশি প্রযোজ্য। কারণ এখানে বাণিজ্যিকভাবে তুলার উৎপাদন হয় না বললেই চলে। বেশির ভাগ তুলা বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। একেক দেশের তুলার মানও একেক রকম হয়। একই রকম তুলার জোগান পাওয়া বাস্তবে প্রায় অসম্ভব। এজন্য বিভিন্ন রকম তুলা সংগ্রহ করে সেগুলোর মিশ্রণ তৈরি করা হয়। বেল বা গাঁট থেকে তুলার এই মিশ্রণ তৈরিই হলো ব্লেন্ডিং এবং মিক্সিং। তবে পাট তনুর বেলায় এই প্রক্রিয়াকে ব্যাচিং (Batching) বলে।
কার্ডিং ও কম্বিং (Carding & Combing)
সুতা কাটার দ্বিতীয় ধাপ হলো কার্ডিং ও কম্বিং। তুলা, লিনেন, পশম-এসব তনুর বেলায় এই ধাপটি প্রয়োগ করা হয়। তনুর বৈশিষ্ট্য ও দৈর্ঘ্য অনুযায়ী কার্ডিং এবং কম্বিংয়ের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র ঠিক করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ব্যবহার অনুপযোগী অতি ছোট তন্তু বাদ দেওয়া হয় এবং ধুলাবালি বা ময়লার কণা থাকলে সেগুলোও দূর করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু কার্ডিং করলেই চলে। তবে মিহি মসৃণ ও সরু সুতা তৈরি করতে হলে কম্বিং দরকার হয়। লিনেন তনুর জন্য বিশেষ ধরনের কম্বিং করা হয়, যা হেলকিং নামে পরিচিত। হেলকিং করলে সুতা অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং মিহি হয়।
কার্ডিং ও কম্বিং করে প্রাপ্ত তন্তু পাতলা আস্তরের মতো হয় এবং এটিকে স্লাইভার (Sliver) বলে। এ স্পাইভার পাকালেই সুতা তৈরি হয়। পাকানোই হলো মূলত স্পিনিং। এ পর্যায়ে স্পাইভারকে টেনে ক্রমশ অধিকতর সরু করা হয়। এক সময় স্লাইভারের শেষ প্রান্তে মাত্র কয়েক গোছা তন্তু বিদ্যমান থাকে। এভাবে পরিবর্তিত স্লাইভারকে মোচড়ানো হয় বা পাক দেওয়া হয়। স্লাইভারকে টেনে সরু করার প্রক্রিয়া হলো রোডিং আর টুইস্টিং (Twisting)। স্লাইভারকে পাক দেওয়া বা মোচড় দেওয়ার ফলে তন্তুগুলো একে অন্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে লেগে যায় এবং সুতায় পরিণত হয়। পাকানো কিংবা মোচড় কম-বেশি করে সুতা শক্ত বা নরম করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই মোচড় বেশি দিলে সুতা বেশি শক্ত হয়, তবে মোচড় অতিরিক্ত হলে সুতা ছিঁড়ে যেতে পারে। পাকানো বা মোচড়ের পরিমাণ নির্ভর করে মূল তন্তুর বৈশিষ্ট্যের উপর। সাধারণত লম্বা তন্তুর বেলায় (যেমন- পাট বা লিনেন) তুলনামূলকভাবে বেশি মোচড় দিতে হয়। টুইস্ট কাউন্টার (Twist Counter) নামের একধরনের যন্ত্রের সাহায্যে এ কাজ করা হয়।
রেশম তন্তু থেকে রেশম সুতা তৈরি
রেশম পোকা থেকে তৈরি হয় একধরনের গুটি। একে কোকুন (Cocoon) বলে। পরিণত কোকুন বা গুটি সাবান পানিতে লোহার কড়াইয়ে সেদ্ধ করা হয়। এতে কোকুনের ভেতরকার রেশম পোকা মরে যায় এবং গুটি কেটে বের হয়ে রেশমের গুটি নষ্ট করতে পারে না। সিদ্ধ করার কারণে কোকুন নরম হয়ে যায় এবং ওপর থেকে খোসা খুব সহজেই আলাদা হয়ে যায়। খোসা উঠে গেলে রেশমি তনুর প্রান্ত বা নাল পাওয়া যায়। এই নাল ধরে আস্তে আস্তে টানলে লম্বা সুতা বের হয়ে আসে (চিত্র ৬.০৪)। চিকন বা মিহি সুতার জন্য ৫-৭টি কোকুনের নাল আর মোটা সুতার জন্য ১৫-২০টি কোকুনের নাল একত্রে করে টানা হয়। এ কাজে চরকা ব্যবহার করা হয়। ছবিতে চরকার সাহায্যে কোকুন থেকে সুতা তৈরি দেখানো হয়েছে। নালগুলো একত্রিত করলে এদের গায়ে লেগে থাকা আঠার কারণে একটি আরেকটির সাথে লেগে গিয়ে সুতার গোছা তৈরি হয়।
কৃত্রিম তন্তু থেকে সুতা তৈরি
কৃত্রিম তন্তু থেকে সুতা তৈরির পদ্ধতি প্রায় সব তনুর ক্ষেত্রে একই রকম। একের অধিক ক্ষুদ্র আঁশ ও উপযুক্ত দ্রাবকের সাহায্যে ঘন ও আঠালো দ্রবণ তৈরি করা হয়। এই দ্রবণ হলো স্পিনিং দ্রবণ। এই স্পিনিং দ্রবণকে স্পিনারেট (চিত্র ৬.০৪ এ প্রদর্শিত) নামক বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে অতি ক্ষুদ্র ছিদ্রপথে উচ্চ চাপে প্রবাহিত করা হয়। দ্রবণকে জমাট বাঁধানোর জন্য এর সাথে প্রবাহপথে উপযুক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। এতে স্পিনারেট থেকে সুতার দীর্ঘ নাল বের হয়ে আসে, যা সরাসরি ব্যবহারযোগ্য। এই সুতা কাপড় তৈরি বা বয়নের কাজে ব্যবহার করা হয়।
বিভিন্ন ধরনের সুতার বৈশিষ্ট্য
সব ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, সুতার বৈশিষ্ট্য তার তনুর বৈশিষ্ট্যের মতো। তোমরা যেহেতু তনুর বৈশিষ্ট্য জেনেছ, তাই নিশ্চয়ই সুতার বৈশিষ্ট্য কেমন হবে সেটি বুঝতে পারছ।
সম্পর্কিত প্রশ্ন সমূহ